আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুণ্ড্রনগর বগুড়ায় দুইদিনের সাহিত্যভ্রমণ : স্মৃতিপটের অক্ষয় সঞ্চয়

কবিতা ও যোগাযোগ

পুণ্ড্রনগর বগুড়ায় দুইদিনের সাহিত্যভ্রমণ : স্মৃতিপটের অক্ষয় সঞ্চয় তপন বাগচী বগুড়ায় গিয়েছি জীবনে দুইবার। দুইবারেই যাওয়ার কারণ ছিল সাহিত্যপ্রেম। বছরখানেক আগে গিয়েছিলাম ঘণ্টাচারেকের জন্য। এবার কাটালাম দুইদিন। সেবারের যাওয়া ছিল একেবারেই অনির্ধারিত।

রংপুরে অভিযাত্রিক সাহিত্য সংগঠনের আমন্ত্রণে কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি কাজী রোজী, কবি কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী (বর্তমানে বিটিভির ডিজি), কবি মতিন বৈরাগী, কবি রবীন্দ্র গোপ (বর্তমানে সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের পরিচালক), কবি আসলাম সানী (বর্তমানে জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক) প্রমুখের সঙ্গে আমিও ছিলাম। মূলত কবি সাবেদ আল সাদের সৌজন্যেই আমরা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই। এই সাহিত্যভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন প্রায় ৪০ জন। অনুষ্ঠানের দিনই কোনও এক অভিমানে কবি কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ঢাকা ফিরে এলেন। পরের দিন কবি সমুদ্র গুপ্ত সস্ত্রীক গেলেন কুড়িগ্রাম অঞ্চলে বেড়াতে।

আর সকলে ঢাকায় ফিরেও এলেও আমি গেলাম লালমনিরহাটে ভাওয়াইয়াগানের ওপর আমার গবেষণার ক্ষেত্রসমীক্ষায়। বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া গীতিকার নীলকমল মিশ্রের সাক্ষাৎকার নিয়ে ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিই। আমার সঙ্গে ছিলেন গীতিকার তৌহিদুল আলম এবং গবেষক রাশিদুল হাসান। কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়কের বড়বাজারের কাছে দূরপাল্লার গাড়ি থামছে না দেখে বগুড়াগামী গেটলক গাড়িতে উঠে পড়লাম। ভাবলাম, ওখান থেকে ঢাকার গাড়ি।

কিন্তু গেটলক গাড়ির যে কত স্টপেজ! বগুড়ায় পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বগুড়ার কাউকে তেমন চিনি না। তবে মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদের ফেলোশিপের বিজ্ঞাপনে আমার নাম থাকায় ‘জনকণ্ঠে’র সাংবাদিক সমুদ্র হক, ‘প্রথম আলো’র সাংবাদিক মিলন রহমান এবং ‘ডেইলি স্টারে’র সাংবাদিক হাসিবুর রহমান বিলু ফোন করেছিলেন। তাঁদের নম্বর সংরক্ষণ করা ছিল। ফোনে পেলাম মিলন ভাইকে।

ঢাকায় যাওয়ার পথ ও গাড়ির তথ্য জানতে চাইলেন বললেন, এখন আর গাড়ি পাবেন না, নাইটকোচ ছাড়া উপায় নেই। কী আর করা! আড্ডার লোভে ঢুকে পড়ি আকবরিয়ার গলিতে ‘প্রথম আলো’র ব্যুরো অফিসে। সেখানে দেখা হয় খ্যাতিমান সাংবাদিক সমুদ্র হক এবং প্রথম আলো বন্ধুসভার সহসভাপতি ও সাংবাদিক সেলিনা শিউলীর সঙ্গে। সেলিনা শিউলীর গবেষণা-প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সম্মতি ও সুপারিশ করেছিলেন সমুদ্র হক। কিন্তু ওই প্রস্তাবটি ওই বছর মনোনীত না হওয়ায় সমুদ্র হক বেশ বিরাগ প্রকাশ করলেন।

কিন্তু ক্ষুব্ধ কথামালার ভেতরেও তাঁর ভালোত্ব আমার কাছে ঠিকই ধরা পড়ে। এই মানুষটির প্রতি আমি আগেই শ্রদ্ধাশীল ছিলাম লেখা পড়ে, এবার তা বেড়ে গেল সাক্ষাৎ পরিচয়ে। তো সেই পরিচয়ের প্রায় এক বছর পরে আবার বগুড়ায় যাওয়ার প্রস্তাব পাওয়ায় প্রথম যাওয়ার স্মৃতিটা বেশ মনে পড়ছিল। বগুড়া সাহিত্য কল্যাণ পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক হাকিম শান যখন আমাকে টেলিফোনে আমার সম্মতি চায় বিশেষ অতিথি হিসেবে যাওয়ার জন্য, আমি প্রথমে রাজি হতে চাইনি। কিন্তু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর শেখ রজিকুল ইসলাম, অধ্যাপক ডক্টর সরিফা সালোয়া ডিনা, সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর রহমান হাবীব ও ডক্টর শেখ রেজাউল করিম, ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও কবিবন্ধু ডক্টর রিষিণ পরিমল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর খালেদ হোসাইন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর হারুণ অর রশীদ ও অধ্যাপক ডক্টর ডক্টর শহীদুর রহমান যাবেন জেনে রাজি হয়ে যাই।

বাংলাবিদ্যার এইসকল পণ্ডিতদের কাতারে কিছুটা সময় কাটানোর লোভেই হয়তো বগুড়া যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হই। হাকিম শান এবং তাঁদের সভাপতি জকিউল আলম সোহেল আমাকে ঢাকায় এসে আমন্ত্রণ জানান। হাকিম শান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়েন আর সোহেল একটি সরকারি কলেজে বাংলার পড়ান। প্রভাষক ভদ্রলোক আমাকে বোঝালেন যে, তাঁরা বিশাল কাজ করে চলছেন। এর আগে দুইবার তাঁরা স্বর্ণপদক, সাহিত্যপদক ও সাহিত্য সম্মাননা দিয়েছেন সবমিলিয়ে প্রায় দুইশ’ ব্যক্তিকে।

আমি বিস্মিত হই! সারাদেশ থেকে খুঁজে খুঁজে যাঁদের পুরস্কার দিচ্ছেন, তারা কি আসলেই লেখক? আমার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক একটি পুরনো স্যুভেনির উপহার দেন। আমি নামগুলো পড়ে একজন সাহিত্যিকও আবিষ্কার করতে পারি না। তাই বিশেষ অতিথি হওয়ার লোভ সম্বরণ করি। কিন্তু সভাপতি ও সাংগঠনিক সম্পাদক নাছোড়বান্দা। তাঁরা আমাকে যে কোনো মূল্যে নিতে চান।

‘এবারও কি ১০০ জনকে পুরস্কৃত করা হবে?’ বললেন, ‘সে যাই হোক, স্বর্ণপদক পাবেন ১০ জন। ’ বুঝলাম অন্য পুরস্কারগুলো আসলে অংশগ্রহণমূলক। তাই ওটি নিয়ে আর ঘাঁটালাম না। কিন্তু স্বর্ণপদকপ্রাপকদের নাম তিনি লুকোতে চান। আমি বললাম, ‘তাহলে তো আমি যাব না।

আমি যে মানেরই লেখক হই না কেন, আমার আদর্শের বাইরে যদি কেউ পুরস্কার পান, আমি তো তার হাতে তুলে দিতে নিজের কাজ ছেড়ে অত দূরে যেতে পারি না। ’ আর বিশেষ অতিথির কাছে সভাপতির এই লুকোচুরি আমার ভালো লাগেনি। সেটি বুঝতে পেরে সভাপতি মহোদয় তিনজনের নাম বলেন। ওই তিনজন আমার পছন্দের এবং তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ডক্টর শেখ রজিকুল ইসলাম, ডক্টর সরিফা সালোয়া ডিনা, ডক্টর রহমান হাবীব গবেষণাক্ষেত্রে অবদানের জন্য আরো বড় স্বীকৃতি পেতে পারেন।

এই পুরস্কার আগে যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের চেয়ে এঁদের যোগ্যতা কোন অংশ কম নয়। আমি এঁদের নাম শুনে বগুড়া যাওয়ার পরিকল্পনা অব্যাহত রাখি। কিন্তু খেয়াল করে দেখি যে, তাদের পুরনো স্যুভেনিরে এবং আমন্ত্রণপত্রে সংগঠনের নামটিই ভুল ছাপা হয়েছে। ‘পূন্ডবর্ধণ’ শব্দটি শুদ্ধ নয়। বাংলার প্রভাষক জাকিউল আলম সোহেল বলেন, ‘অনেকেই এটিকে ভুল বলেছেন, কিন্তু আমি এটিকে শুদ্ধ মনে করি।

আমি এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছি। ’ বলেই ‘নক্ষত্রমেলা’ নামের একটি স্মরণিকার ফটোকপি দিলেন। আমি তাঁর লেখাটি পড়ে রীতিমতো বিরক্ত হয়েছি। এক পৃষ্ঠার লেখায় গোটা বিশেক বানান ভুল যে কতটা পীড়াদায়ক, তা লিখে বোঝাতে হয় না। আর বাক্যগঠন করতেও যে তিনি জানেন না, তার প্রমাণও রয়েছে ওই লেখায়।

তিনি সরকারি কলেজে বাংলা পড়ান কী করে, ভেবে অবাক হই। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা বানানটি আধুনিক বাংলা বানানের দিকে না তাকিয়ে পূরাকৃতি হিসেবে ‘ঊ’ ( ূ) কার ব্যবহার কররেও তাতে কোন ভুল হবার কথা নয়। অতএব.... বানান সঠিক আছে বলেই....’। মূর্খতা আর কাকে বলে! পুরাকীর্তিতে (নাকি কৃতিতে) তো দীর্ঘ ঊ-কার নেই। তিনি সেখান থেকে দীর্ঘ ঊ-কার নিলেন কী করে? তারপরে ‘বর্ধণ’ বানানে তো কখনেই মূর্ধণ্য ‘ণ’ ছিল না।

দন্ত্য ’ন’কে তিনি কোন অধিকারে মূর্ধণ্য ‘ণ’ বানিয়ে নিলেন? এসব কথার তিনি মুখোমুখি যে জবাব দিলেন, তা কেবলই হাস্যের উদ্রেক করে। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমরা তো কেবল শুরু করেছি। ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। আপনারা পরামর্শ দিলে, শুধরে নেয়ার চেষ্টা করব। আমরা তিন বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি।

এধরনের পরামর্শ কেউ দেননি। আপনি এলে কৃতজ্ঞ হবো। ’ আমি তাঁর এই নমনীয় আত্মসমর্পণে গলে যাই। তাই বলি, ‘সবাই তো যার-যার তার-তার, আমার বেলায়ও কি ওই দশা!’ সোহেল বলেন, ‘বলেন কি স্যার। আপনার যাওয়া-আসা এবং থাকা-খাওয়ার খরচ তো আমরাই দেব’।

এরপরেই মনটা কেমন যেন সায় দেয়। তবু হাকিম শান প্রায় প্রতিদিন যোগাযোগ রাখেন। তাই শেষতক বৃহস্পতিবার ৯ এপ্রিল বিকেলের বাসে বগুড়া রওয়ানা হই। পৌঁছতে রাত দশটার বেশি। সাত রাস্তায় নেমে রিকশায় চড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেস্ট হাউস।

সেখানে আছেন ডক্টর শেখ রজিকুল ইসলাম ও তাঁর পিএইচডি ফোলো আবু দাউদ মুন্সি। গেস্টহাউসের বাবুর্চি কাফিভাইয়ের রান্নায় বাটামাছের ঝোল খেয়ে তিনজনে তুমুল আড্ডায় রাত তিনটা বাজিয়ে ফেলি। আড্ডায় উঠে আসে বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার নানান খবর। সকালে তিনজনে একটা সিএনজি-অটো নিয়ে পৌঁছে যাই বগুড়া জেলা পরিষদ মিলনায়তনে। ‘একুশে টেলিভিশন’ ও ‘ডেইলি স্টারে’র স্টাফ রিপোর্টার হাসিবুর রহমান বিলু আমাদেরকে সঙ্গ দেন।

বর্ণাঢ্য র‌্যালির মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। র‌্যালির নেতৃত্ব দেন বগুড়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আহসানউল্লাহ। গিয়ে দেখি ঢাকা থেকে এসেছেন আমার আর এক গবেষক-বন্ধু ডক্টর জমির হোসেন। মঞ্চে উঠে দেখি বগুড়ার মেয়র প্রধান অতিথি, আর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসানউল্লাহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর মো. শহীদুর রহমান এবং আমি বিশেষ অতিথি। মুদ্রিত নামের আর কেউ আসেননি।

সকলেই আয়োজকদের প্রশংসা করলেন। আমিও সাধারণ বাঙালির মতো ভদ্রতার বাইরে যেতে পারি না। তবুও বিবেকের দংশনে বাধ্য হয়ে বললাম, ‘যাঁরা পুরস্কার পাচ্ছেন, এঁদের অনেককেই হয়তো আগামীকালই সাহিত্যের অঙ্গনে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবু আয়োজকদের ধন্যবাদ তাঁরা এই সুযোগে কিছু ভালো সাহিত্যিককেও সম্মান জানাচ্ছেন। ’ আমি তখনও তিনজন বাদে আর কোনো পুরস্কার প্রাপকের নাম জানি না। হোটেল আকবরিয়ায় দুপুরের খাবারের পরে আমরা পাশের গলিতে ‘প্রথম আলো’ কার্যালয়ে যাই।

সেখানে মিলনভাইয়ের আপ্যায়নে চা খেয়ে পত্রিকা পড়ে অনেক সময় আনন্দে কাটাই। সঙ্গে যোগ দেন প্রথম আলো বন্ধুসভার বর্তমান সভাপতি সাংবাদিক ও গবেষক সেলিনা শিউলী। তারপর বিকেলে দিকে অনুষ্ঠানস্থলে যাই। সেখানে গান শুনি। বিশেষ অতিথির আর কী কাজ? আগামীকাল বিকেলে স্বর্ণপদক তুলে দিতে হবে সকলের হাতে।

কাজটি নিশ্চিত আনন্দের। যে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা হয়নি, সেই পুরস্কার গুণী মানুষদের হাতে তুলে দেয়ার যে কী সৌভাগ্য, তা কি আর বলতে! সেই সৌভাগ্য অর্জনের জন্য আরো ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। কিছুক্ষণ পরে, টেলিফোন আসে হাসিবুর রহমান বিলুর। মহাস্থানগড়ে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। কিন্তু সঙ্গীদের ছেড়ে একা যাই কী করে! বাঙালির সংঘপরায়ণতাকে অস্বীকার করি কী করে।

তাছাড়া রোদের যে তাপ! ভয় পাই। কিছুক্ষণ পরে ফোন আসে মিলনভাইয়ের। তাঁর অফিসে বন্ধুসভার সদস্যরা এসেছে। তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। দৈনিক ‘প্রথম আলো’র একঝাঁক তরুণ পাঠক।

এদের অনেকেই লেখে। আমিও লেখালেখি করি এবং কর্মসূত্রে মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত জেনে, মিডিয়া সম্পর্কে নানান প্রশ্ন তাদের। আমি সাধ্যমতো জবাব দিই। ফিচার কী করে লিখতে হয়, সংবাদ উপস্থাপক কী করে হওয়া যায়, সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়া কতটা যৌক্তিক- এরকম নানান প্রশ্ন। আমার ভালো লাগে।

ওদের সঙ্গ ছেড়ে আবার আসি অনুষ্ঠানস্থলে। তখন শুরু হয়েছে ‘বেহুলা লক্ষীন্দর’ যাত্রাপালা। পরিবেশনা মান ভালো না হলেও খানিকটা উপভোগ করলাম। এরই মধ্যে জেনে গেলাম স্বর্ণপদক প্রাপক ১০ জনের নাম। আগের তিনজন ছাড়া আর কারো নাম আগে শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

কী লজ্জা! নিজের সীমাবদ্ধতাকে ধিক্কার দিতে থাকি। আর বলাই বাহুল্য স্বর্ণপদক ছাড়াও যাঁরা সাহিত্য পদক এবং সম্মাননা পেয়েছেন, সেই সব সৌভাগ্যবান লেখকদেরও আমি চিনতে পারছি না। এঁরা নিভৃতে চর্চা করেন। এঁরা প্রান্তবাসী। কেবল কবিতার জন্য তাঁরা ছুটে এসেছেন সুদূর সাতক্ষীরা কিংবা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে।

এঁদের সাহিত্যপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাঁদের সাধনার প্রতি আমি সম্মান জানাই। তাঁদেরকে ডেকে এনে এই যে পদক বিতরণ, তার উদ্দেশ্য তো অপরিষ্কার। তাঁদের লেখকসত্তা শাণিত হওয়ার আগেই পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করাকে ধন্যবাদ জানানো যায়। কিন্তু পুরস্কৃত লেখকের রচনাকে কেউ যদি আদর্শ ভাবে, তাহলে সাহিত্যের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

পুরস্কারের মাপকাঠি বুঝতে না পেরে যারা পুরস্কার দিচ্ছেন, তাঁদের দলে নাম লেখাতে আমার আপত্তি আছে। এই নিয়ে সাতপাঁচ ভাবছি। হঠাৎ একটি নাম জানা মনে হয়। যাঁর নাম এবার স্বর্ণপদকের শীর্ষে রয়েছে, তিনি তো ২০০৭ সালেও ‘পুণ্ডবর্ধন সাহিত্য কল্যাণ পরিষদ সাহিত্যিকী পদক’ পেয়েছেন। আমি ‘নক্ষত্রমেলা’ খুঁজে দেখি ২০০৬ সালেও তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছেন।

তিন বছর বয়সী এই পুরস্কারদান কর্মসুচিতে প্রতিবছরই যাঁকে পদক দেয়া হচ্ছে, তাঁর গুণপনা যা-ই হোক, যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের রুচি নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলা যায়। আর প্রতিবছর একই পুরস্কার নিতে তো তাঁরও লজ্জা করার কথা! ঘেঁটে দেখি, ২০০৬ সালে যাঁরা সংবর্ধনা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৭ নম্বর তালিকায় রয়েছে সংগঠনের সভাপতির নাম। সভাপতি নিজেকে সংবর্ধনা দিয়েছেন? আমার বিস্ময়ের সীমা থাকে না! আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট বিভাগের একজন বিচারপতি এসেছেন শেষদিনের পুরস্কার বিতরণপর্বের প্রধান অতিথি হিসেবে। আমি চলে গেলেও অনুষ্ঠানের অঙ্গহানি ঘটবে না।

রাতে ফিরে আসি গেস্টহাউসে। আবার সেই আড্ডা রাত তিনটা পর্যন্ত। সকালে আমরা যাই ‘প্রথম আলো’ অফিসে। সেখানে চা খেয়ে রজিকভাই এবং দাউদ যান অনুষ্ঠানস্থলে আর আমি যাই ঠনঠনিয়া বাসস্ট্যান্ডে। টিকেট কেটে শ্যামলী পরিবহনে ঢাকার পথে একাই রওয়ানা হই।

আমার এই নীরব প্রতিবাদ হয়তো কোনো কাজে আসবে না। আবার হয়তো ভুল বানানে লেখা হবে পুণ্ড্রবর্ধন, হয়তো ভুল লোককে দেয়া হবে স্বর্ণপদক, স্মরণিকা জুড়ে থাকবে হয়তো ভুলের ছড়াছড়ি, সাহিত্যের হয়তো কোনই উপকারে আসবে না বিবেচনাহীন এই সকল আয়োজন- তবু আমার নৈতিক অবস্থান রইল সাহিত্যের শুদ্ধযাত্রার প্রতি, সেটাই সান্ত্বনা। পুণ্ড্রনগর বগুড়ায় আমার এই দুই দিনের সাহিত্যভ্রমণ স্মৃতিপটে অক্ষয় সঞ্চয় হয়ে থাকবে এই সকল অযোগ্য অকর্মকাণ্ডের কারণে, সেটিও তো কম অর্জন নয়। ...............

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।