আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিভেদের দেওয়ালঘেরা বৈশাখী বর্ষবরণের

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
গত কয়েক বছর ধরে আমরা পয়লা বৈশাখে জাতীয়ভাবে আনন্দউল্লাস করছি। নেচে গেয়ে রং মেখে সঙ সেজে রংবেরংয়ের মুখোশ বানিয়ে হরেক রকমের কাগজের মূর্তি বানিয়ে এক মহাযজ্ঞের আদলে আমাদের সেই প্রাচীন বাঙলার বৈশাখ এখন দাঁড়িয়ে গেছে কর্পোরেট ‘ফাস্ট বোশেখ ফেস্টিভেলে’! এর বাইরে রাজধানীর বাইরে সেই সুদূর মফস্বল শহর গুলোতে এখনো পয়লা বৈশাখ বাঙালির আদি এবং অকৃত্রিম প্রাণের উৎসব। বাঙালির নিরেট ভালোবাসার দিন। ধর্মাধর্মীর বেড়াজাল ছেঁড়া মুক্ত স্বাধীন আনন্দ আবাহন। আজো গ্রাম বাঙলায় পয়লা বৈশাখ মানে দোকানীর হালখাতা, লাল রঙের জাব্দা খাতায় ফি বছরের বাকিতে পণ্য নেওয়া আটপৌরে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি।

হালখাতার দিনে দোকানে দোকানে ক্রেতার ভিড়। যে যেমন পারেন ধার শোধ করেন, আর শালপাতা বা কাগজের ঠোঙায় মিষ্টি মিষ্টান্ন নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আবার নতুন খাতায় নাম লিখিয়ে শুরু হয় সারা বছরের প্রচলিত কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দেওয়ার লিখন! যদিও এখন আর আগেকার সেই মহাজনের শোষণ নেই, কিন্তু ভিন্নমাত্রায় নব্য কর্পোরেট শোষণে জর্জরিত বাঙালি কিছুতেই তার আগেকার সেই সহজীয়া সংস্কৃতি খুঁজে পায় না। পাবেও না, কেননা সেখানে এখন বীরদর্পে আবির্ভূত হয়েছে নিখুঁত মাপের ভাঁজ করা এক নব্য কালচার, যাকে আদর করে বলা হচ্ছে- কর্পোরেট কালচার! এই কর্পোরেট আগ্রাসনে এখন সব কিছু আক্রান্ত। রাজনীতি, অর্থনীতি তো গেছেই, বাকি ছিল গ্রাম্য সংস্কৃতি।

সেটার ওপরও নজর পড়েছে মাফিয়াদের। মাফিয়ারা সেই গ্রাম্য ঐতিহ্যগুলোকে কমোডিটিজ বানিয়ে বিক্রি করছে। বিক্রি মানেই মুনাফা। কর্পোরেট মুনাফা মানে মোটা দাগে ব্যাপক অঙ্কের মুনাফা। বড়ো মুনাফার ধর্ম হলো প্রয়োজনে সে মানুষ খুন করে।

আমরা আগামীতে বড়ো বড়ো মাফিয়া ব্যাপারিদের মধ্যে বর্ষবরণ নিয়ে প্রতিযোগিতা দেখবো। রেষারেষি দেখবো। এর পর দেখবো খুনোখুনি। প্রতিবারই যার আলামত (পৃথক হয়ে যাওয়া খণ্ড হয়ে যাওয়া) দেখা যাচ্ছে। দেশজ আর লোকজ সংস্কৃতি যখন বহুজাতিক কোম্পানি আর কর্পোরেট ব্যাপারিদের হাতে পড়ে তখন তার ঐতিহ্য হারাতে বাধ্য।

তখন তা নিছক বিকিকিনির এক মচ্ছব হয়ে দাঁড়ায়। আর পুলিশে যার শৃঙ্খলা রক্ষা করতে চায় তার শৃঙ্খলার বারোটা বেজে যায়। গতবার বটমূলের অনুষ্ঠান আর রমনা-সোহরাওয়ার্দী এলাকায় ৬ হাজার পুলিশ, বিডিআর, র‌্যাব নামানো হয়েছিল,এবারো ঠিক তেমনি র‌্যাব-পুলিশ আর অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা চাদরে মুড়ে ফেলা হবে সমগ্র রমনা আর এর আশেপাশের এলাকাগুলো। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে প্রত্যেকের শরীর চেক করে করে ঢোকানো হয়েছিল, এবারো তাই হবে। ঠাঠা রোদের মধ্যে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ পার্কে ঢুকে একে অপরের মুখে দেখছে আর প্রশ্ন করেছে, কী দেখতে এলাম? ফেরিঅলাদের প্রবেশঅধিকার ছিল না পার্কে।

তপ্ত রাজপথে বসতে হয়েছিল। গাছের ছায়া ওদের জন্য হারাম করা হয়েছিল। কচি কচি বাচ্চারা রোদের মধ্যে পুতুল, মিষ্টি কিনতে গিয়ে চাঁদিফাটা কষ্ট পেয়েছে। নিরাপত্তার নামে অস্ত্রধারীরা বর্ষবরণকে প্যারেড স্কয়ার বানিয়েছে। পুলিশ ক্যাম্প বানিয়েছে।

এই সরকারি পিটি-প্যারেডে বাঙালির বাংলা হাওয়া হয়ে জায়গা দখল করেছে রাজনীতিকদের পান্তা খেকো মানসিকতা। আমি পুরো এলাকাটা ঘুরে কোথাও কারো মধ্যে কোনো আনন্দ দেখলাম না। যদিও কেউই জানে না কিসে আনন্দ, কেন আনন্দ? এবারো সেই একই রকম আনন্দ আনন্দ খেলা চলবে। মানুষ উন্মাদের মত আনন্দের পেছনে ছুঁটবে আর মিছে আনন্দ খুঁজে ফিরবে। কর্পোরেট কালচারের অন্যতম নিয়ম হলো সব কিছুর ভেতর প্রফেশনালিজম! কড়া ভাঁজের প্রফেশনালিজম।

যার একটু চুন থেকে পান খসবে না। এই প্রফেশনালিজমের কোন এক নিভৃত কোণে হয়ত হতদরিদ্র মানুষগুলোর ছেলে-মেয়েরা একটা হাওয়াই মিঠাইতেই আনন্দ হাতড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। প্রতিবার তা-ই করে ওরা। অথচ কর্পোরেট কালচারের যারা ধীমান, যারা শিখরকর্তা, যারা তরফদার-গাতিদার তাদের কিন্তু আনন্দ গ্যাদারের নিয়ম এরকম না! তারা পাট খোলা লাল-সাদা গারদ বা সিল্কের ভাঁজে ভাঁজে ফরাসী সৌরভ ছড়িয়ে দেবেন, খোঁপায় দুধসাদা বেলিফুলের মালা জড়াবেন, কপালে বড় করে লাল-কালো টিপ পরবেন, গলায় পুঁতির মালা অথবা বেলিফুলের মালা ঝোলাবেন, হাতে কনুইঅব্দি কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি বাজাবেন খোঁপায় একটা গোলাপ কিংবা গাঁদা অথবা জবা গুঁজে নেবেন এবং হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে দুইগালে লোকজ সংস্কৃতির চিহ্ন এঁকে একে অপরকে অহেতুক ভালবাসার আহ্বান জানাবেন। পাশাপাশি আর এক দল সাদা কিংবা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী,চুড়িদার পাজামা, অথবা রং বে রংয়ের ফতুয়া গলায় কড়ের মালা, হাতে হরেক রকমের বালা অথবা নানা রঙের টিশার্টের বাহারে গোটা বোশেখজোন আলোকিত হয়ে উঠবে।

হাই ভ্যালুর পান্তা-ইলিশ সাথে একেবারে খাঁটি বাঙাল রিসালতের বিলাস ছড়াবেন। সেই সাথে কর্পোরেট দোকানগুলো এই সমগ্র উৎসব বা মচ্ছবের বিভিন্ন ক্যাটাগরির আইটেমে স্পন্সর হবেন। কোন কোম্পানী পানি সাপ্লাই দেবে তো কোনটা দেবে হাতপাখা। কেউ কেউ স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমোডিটিজের ব্যাপার-বাণিজ্যও করে নেবেন। বাড়িতে বাড়িতে বাঙাল ঘরানার বিশেষ খানাপিনার আয়োজন চলবে, একটা বিশেষ দিনে সবাই কেবলই মাটির সানকিতে খেতে চাইবেন, কারোই মাথায় কাটলেট,পিৎজ্জা,বার্গার, চপ, আইসক্রিম,বিরিয়ানীর খায়েশ চাপবে না।

সবাই এই একটি বিশেষ দিনে ভয়ংকর ভাবে আদি এবং খাঁটি বাঙাল হয়ে উঠবেন। ঠিক ওই দিনের রাত অব্দি। রাত পোহালেই আবার যে যার আসল চেহারায় এবং আসল খোমায় আবির্ভূত হবেন। আবার যার যার নিজের পছন্দ অপছন্দের মূল ঘারানায় ফিরে যাবেন। দিন ক্রমশঃ গড়িয়ে যাবে।

এক একটা দিন আরো ধীরে ধীরে আরো একটি নতুন অনিশ্চিত দিনের দিকে ধেয়ে যাবে। এর থেকে অনেক দূরে যেখানে সূর্য যথারিতি ওঠে আর ডোবে, যেখানে রাত এলে কারো কাছেই মোহনীয় মায়াবী মনে হয়না, যেখানে কেউ পানি বা হাতপাখা কিংবা অন্য কিছুতে স্পন্সর করে না, যেখানে সন্ধ্যের আগে আগে কেরোসিনের অভাবে কুপিগুলো নিভে যায়, যেখানে খুব ভোরে সূর্য ওঠারও আগে মানুষগুলো বেরিয়ে যায় জীবিকার খোঁজে, যাদের বউগুলো আরো একটু পরে বড়রাস্তা ধরে দ্রুতলয়ে হেঁটে যায় শহরে কাজের আশায়, কিংবা তোলা কাজের বাড়িতে, যাদের কচি ছেলেমেয়েগুলো সারাটাদিন এক নিরেট নিথর অপেক্ষার প্রহর পার করে বাবা-মায়ের ফিরে আসার আশায়, সেখানে কোন বৈশাখী উৎসব নেই। সেখানে পয়লা বোশেখ নেই। হালখাতাও নেই!কেউ তাদের কোন মুখোশ বানিয়ে দেয়না। কেউ বাঁশি বাজিয়ে আবহনী সঙ্গীত শোনায় না, কেউ নাগরদোলায় চড়িয়ে উথাল-পাতালে চক্কর খাওয়ায় না।

তারা এমনিতেই সারা বছর ওই উথাল-পাথাল আর নাগরদোলার চক্করে আছে। তারা কোখনো দিন অতিবাহিত করে না, তাদের দিনগুলো অতিকষ্টে ঘেয়োকুকুরের মত হেঁচড়ে হেঁচড়ে কোনওমতে পেরিয়ে যায়। এবার এই দুই ধরণের বর্ষবরণের একত্রিকরণ কিংবা একিভূত করার চেষ্টায় আমরা দেখি সেই চিরায়ত ধনবৈষম্য আর শ্রেণীবৈষম্য। এটা থাকতেই পারে। খুব ভালভাবেই পারে।

থাকবেও, কিন্তু যে আমরা একটা নতুন বছরকে আবাহন জানানোর কাজটাও সার্বজনীন করতে পারিনি, সবার জন্য আনন্দময় করতে পারিনি, সেখানে কি করে আমরা ঢেরা পিটিয়ে বলি যে, পয়লা বোশেখ বাঙালির আদি সংস্কৃতির অনুষ্ঠান, প্রাণের মিলনক্ষেত্র, কিংবা বাঙালির নিজস্ব উৎসব? উৎসব কি আমরা রেখেছি? যেটুকু রেখেছি তা কি সবার জন্য? যদিও নামকা ওয়াস্তে সবার জন্য চাপাটা চালিয়েই দিই, তার পরও কি সেটা সবার জন্য হয়ে উঠেছে? মোটেই না। এটা আজ থেকে দশ-পনের বছর আগে তাও যেমন কিছু সাধারণ মানুষের মিলনমেলা ছিল, এখন তাও নেই। একটা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর আরোপিত কর্পোরেট ছেনালি, বা একদল আপহোল্ড মানুষের একদিনের বেলেল্লেপনা ছাড়া আর কি? হ্যাঁ একটা পর্যায় পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানকে বলা চলে সকল ধর্মের সহাবস্থান। সেটি ঠিক আছে, এখানে হিন্দু-মুসলমানের আলাদা কোন ভেদাভেদ নেই। কিন্তু তাতেই কি সার্বজনীন? চৈত্র সংক্রান্তির রাতে যে চাষা সারা বছরের ধারের টাকা শোধ করার তাড়নায় ঘুমুতে পারে না।

দাদনে নেওয়া টাকার হিস্যা হিসেবে সারা বছরের ফসলের বড় একটা অংশ যাকে মহাজনের গোলায় তুলে দিতে হয়। মহাজনের (কিংবা ক্ষমতাবানের, কেননা আধুনিক সমাজে আজকাল ক্ষমতাবানেরা প্রাচীন মহাজনের আদল পরিবর্তন করে ক্ষমতাবান বা আধুনিক ব্যুরোক্র্যাট হয়েছেন) ইচ্ছার বাইরে মেয়েটিকে কাজে পাঠাতে পারে না, ছেলেটিকে মাদ্রাসার বদলে স্কুলে পড়াতে পারে না। জমিতে কাজ না থাকার মৌশুমে বিনা পারিশ্রমিকে বা মাহেন্দারী প্রথার আদলে সস্তা শ্রম দিতে বাধ্য করা হয় সেখানে একদিনের মিছে আনন্দ যে তাদের জন্য নয় সেটা মোটাদাগে কাউকেই আর দেখিয়ে দিতে হয় না! জ্বলজ্বলে সত্যের নিরেট গাঁথুনি দেওয়া দেওয়ালই তাদের এই বিভাজনরেখা পষ্ট করে তোলে। যা আমরা খুব পেশাদারী কায়দায় ওভারকাম করতে শিখেছি। আর সেটি হচ্ছে ক্লাস কোলাবরেশনের বেহায়া নির্লজ্জ প্রদর্শন! গার্মেন্ট সেক্টরের মেয়েগুলোর প্রানান্ত ঘর্মাক্ত ছুটোছুটি দেখে আমরা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, বুঝে নিতে চাইছি- এরই নাম বোধহয় সার্বজনীন আনন্দ! এই তো আমরা সবাই কেমন একসাথে থালা-বাঁশি-ঢোলডগর-কাসর-ভেঁপু-চন্দনচর্চিত মুখে ছুটে চলেছি.....এই যে আমরা টিভি ক্যামেরার সামনে নেচে গেয়ে আনন্দের পায়রা উড়িয়ে জগাই-মাধাইয়ের মত উদ্বাহু নেত্য করে চলেছি.....এই যে আমরা একে অপরকে খাঁটি বাঙাল কায়দায় অভিনন্দন জানাচ্ছি, একে অপরকে পার্টিতে ইনভাইট করছি, একে অপরকে শাড়ি-চুড়ি গহনাগাটি উপহার দিচ্ছি, খোলা মাঠে বসে শালপাতায় বা কলাপাতায় গিলছি, টাওয়েলের বদলে গামছায় মুখ মুছছি, এসবই কি চিরায়ত বাঙাল সংস্কৃতি নয়? নিশ্চই! আমরা বাঁশি কিনছি, কুলো কিনছি, ধামা কিনছি, দোতারা কিনছি- আর ধেই ধেই করে আদি বাঙাল সংস্কৃতির সূত্রধর হয়ে বিবেকের রোল প্লে করে চলেছি......চলেছি সেই প্রাচীরের পাশে, যেখানে আমাদের শ্রেণী বৈষম্য আরো মোটাদাগে বৈষম্য বাড়ানোর ইঁট-সিমেন্ট সহযোগে বিভেদের দেওয়াল তুলে দিচ্ছি.... আর নিয়ম-কানুন এবং প্রথা মিশিয়ে সেই দেওয়ালকে অনতিক্রম্য করে দিচ্ছি।

বৃত্ত কেবলই অনতিক্রম্যই থাকে!!
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।