চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)
ভ্রমণে বেরোলেই অপরিচিত মুখগুলোকে কেন আমার পরিচিত মনে হয়? এমন না যে এটা আজকেই ঘটছে। আমি আগেও খেয়াল করেছি, সহযাত্রীদের, অপেক্ষমাণ মানুষের মুখ আমার কাছে আপন মনে হয় খুব। অথচ সেই মুখটাকেই এই স্টেশন, প্ল্যাটফর্মের বাইরে দেখলে আমি ফিরেও তাকাতাম না! ঘরের বাইরে বেরিয়ে আমি কি কিছুটা বিপন্ন হয়ে পড়ি? এজন্যে অচেনাকেও আপন মনে হয়? অথবা আমি একটু সাহসী রোমাঞ্চপ্রিয় হয়ে উঠি, তাই অপরিচিতকেই ভাল লাগে! এই সব আবোলতাবোল ভাবছিলাম।
রাত বাড়তে থাকে, আমি স্থবির বসে অপেক্ষা করি। আমার চারপাশে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে।
তারা সবাই বেরুচ্ছে এই শহর থেকে। ব্যাগগুলো কালো, খয়েরি, নীল, সবুজ, বেগুনি রঙয়ের। পেটমোটা ভারি ব্যাগ কাঁধে হাতে কিংবা টেনে এনে কাউন্টারে রেখে সবাই একটু একটু হাঁপায়। আমি বসে বসে সেই চেহারা গুলো দেখি, মাপি। সেখানে আমি আশাজনক কিছু খুঁজে পাইনা।
মুখগুলো ক্লান্ত, বিমর্ষ আর হতাশ।
কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে যাওয়াতে হতাশ।
কেউ আওয়ামীলীগ সরকার পত্তনে হতাশ।
কেউ বিএনপি হেরে যাওয়ায় হতাশ।
কেউ হয়তো জামাতে-পিছলামি হেরে যাওয়াতে হতাশ (!)।
কেউ সামরিক অফিসারদের মরে যাওয়াতে ক্ষুব্ধ, কেউ গুলি খাওয়া রিকশাওয়ালা আর সাধারন্যের জন্যে কাতর, কেউবা বিডিআর জওয়ানদের জন্যে সমব্যথী।
আমাদের সকলের চোখে মুখে আমি সেই দুঃখবোধ ঝরে পড়তে দেখি। শাদা-ধূসর হয়ে ওঠে পটভূমি। সেখানে আমি শ্রান্ত রাতের শেষ বাসের তীক্ষ্ণ হর্ণ শুনতে থাকি। সেই অশ্লীল চিৎকার ঢাকতে আমি কানে ধুম ধাড়াক্কা গান গুঁজে দেই।
আমি আজকে এই শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। আজকের রাতে আটত্রিশ বছর আগে কালো কালো ছোপ ছোপ রক্তে ঢাকা শহর ভিজে গিয়েছিল। কত রক্ত একরাতে ঝরেছিল? মৃত, নিথর মানুষগুলোর শরীরের রক্তে কতগুলো সুইমিংপুল বানানো যেত? সার সার দেহ। আমি ছোটবেলায় যখন প্রথম শাদাকালো ছবিগুলো দেখেছিলাম, আমার ভয় লেগেছিল; আর কান্না পেয়েছিল। আর মনে আছে আমি বইটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
কারণ আমি ভেবেছিলাম বই খুলে রাখলে ঐ সার সার দেহগুলো উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়াবে হই হই করতে করতে!
কোন কারণ ছাড়াই এভাবে লাশ হয়ে যাওয়া যায়!! এখনও নির্মিত হয় মানুষের লাশ। কোন নিখুঁত কারিগর এই দেহ বানায়, তারপরে সেখানের অণু-পরমাণুর টান তুচ্ছ করে মাংশ-পেশী-রক্ত-চর্বি-হাড়গোড় সব নির্জীব হয়ে যায়! এই সব লাশেরা নোনতারক্ত মেখে আমার কানের ভেতরে ভারি সীসার মত ঢুকে পড়ে। আমার কয়েকজন বন্ধু এসে আমাকে সেখান থেকে টেনে তোলে।
ওদের সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো আজ। আমার ভালো লাগতে থাকে।
আমি তাদের সাথে গল্প-আড্ডায় মেতে লাশগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে চাই। ছবিগুলো ভুলে থাকতে হবে আমাকে। যাবতীয় জাগতিক ভণ্ডদের ছেড়ে আমি কিছুদিন ছুটি নিতে চাই। ওরা সাধারন গল্প ফাঁদে। পুরনো দিনের গল্প, যখন আমরা সবুজ ছিলাম সে সময়ের গল্প।
যখন আমরা দুইটাকার চা তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে জিব পুড়িয়ে ফেলতাম, দুপুরে দৌড়াতে দৌড়াতে ল্যাবে ঢুকতাম অ্যাটেন্ডেন্স মিস হয়ে যাবার ভয়ে। তখন আমরা অল্প অল্প ঘুমাতাম, সারারাত জাগতাম আর স্বপ্ন দেখতাম জেগে জেগে। সেইসব দিনের কথা বলতে বলতে আমার চেহারার ময়লা রঙের মাঝে কিছুটা সবুজ ফিরে আসে। লাশেরা কবরের গভীরে নীরব হয়, আপাতত!
আমার যাত্রা শুরু হয়। আমি যাব অনেক দূরে, তিনশ কিলোমিটারেরও বেশি।
স্থানিক দূরত্বের চেয়েও আমার কাছে বেশি জরুরি মানসিক দূরত্বটা। আমি এই শহর ছেড়ে বেরুচ্ছি। ঢাকা শহরের মাদকে গত ছয় বছরে আমি ক্রমশ ডুবেছি, ভেসেছি, সাঁতরেছি। এই শহরের সবকিছুই আমার ভাল লাগে। প্রচণ্ড বেহিসেবী জ্যাম, ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার মতো ক্লান্ত দিনরাত, ধোঁয়া ধুলো চিৎকার হর্ণ মানুষ গাড়ি বাস সিএনজি রিকশার জটা-কালো সময় আমার হৃদয়ে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দিয়েছে।
আমি অনেকটাই এখন নির্ভর করি ঢাকার উন্মাদনার উপরে। এই শহরের খারাপ জিনিশগুলোও আমার এখন ভালো লাগে।
কিন্তু সেই আমিও এখন একটু নির্ভার হতে চাই, এই শহরটা ছেড়ে কিছুদিন ছুটি চাই। অনেক জোরে জড়িয়ে ধরলে যেমন হাসফাঁস লাগে, আমার কিছুদিন ধরে তেমনই লাগছে বলে আমি পালাতে চাই। রাতের আঁধারে, ব্যাকপ্যাকে করে কয়েকদিনের রসদ নিয়েই আমি পালাই।
সাথে একটা ক্যামেরা নিয়েছি গলায় ঝুলিয়ে। আর কানের মধ্যে বেশি করে অর্ণব, ফুয়াদ, রক অন, দিল্লী ৬, কোল্ডপ্লে, ড'ট্রিকে পুরেছি। আমি সব ইন্দ্রিয়গুলোকে একটু ঝালাই করতেও চাই।
সাথে গত পাঁচবছরের দোসররাও যাচ্ছে। সবারই গত এক বছরে বয়স বেড়ে গেছে, দেখলেই মনে হয় পৃথিবীর ভার একটু একটু করে সবার কাঁধকে ভারি করে দিচ্ছে।
কেউ কেউ ইতিমধ্যেই ঢাকা, বাংলাদেশ ছেড়েছে। আরো কয়েকজন এবছরই ছেড়ে যাবে! তাই এই শেষ ভ্রমণ, অনাগত ভবিষ্যতের আগে।
বাসের দোল খেতে খেতে আমি বুঝে যাই এসব কথা। এই দোসরদের সাথে কাটানো এই কয়েকটা দিন পরবর্তীতে অশরীরীর মতো ঘুরে বেড়াবে। আমি ছবি তুলে বেঁধে রাখলেও ফ্রেমের বাইরে চলে যাবে যাবতীয় আনন্দ, হাসি আর গানের সুরগুলো! বাইরে তখন মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছে।
আমি ঢাকার প্রান্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছি। মুজিব হয়েছে বন্দী, পুলিশ লাইনে রক্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রক্ত ততক্ষণে নালা ভরে ফেলেছে। পরের দিনগুলোতে যারা উর্ধ্বশ্বাসে পালাবে আমিও তাদের মতো পালাচ্ছি। পার্থক্য অনেক; তবুও...।
কুমিল্লা পেরোনোর পরে বাস থামল।
গিঁটে খিল কাটানোর জন্যে নিচে নামলাম। রাতেও সরব রেস্তোরাঁ। ঘুম ভাঙা মুখে সবাই খাচ্ছে। ভাত, মুরগী, মাছ কিংবা শুধুই চা। আমি পরোটা দিয়ে সব্জি খেলাম, সাথে চা।
তারপরে বাসে চেপে বসলাম। গানযন্ত্রের দম ফুরিয়ে গেছে। এখন কান নীরব, চোখ খোলা। চায়ের মাঝে কী ছিল, আর ঘুম আসে না। রাস্তায় হঠাৎ বাসচালকের কী হলো, গাড়ির গতি দেখি বেড়ে গেল।
ওভারটেকিং চলছে এদিকে ওদিকে হেলে পড়ে। এই দোলনেই, অথবা বাইরের সরে যাওয়া দৃশ্যপটে ভাসতে ভাসতে আমি আবার ঘুমে তলিয়ে যাই। তবে এই সন্তরণ খুব বিভ্রান্ত। আমি সেইঘুমের মাঝেও টের পাই এগিয়ে চলেছি দ্রুততায়...
বিদঘুটে কিছু স্বপ্ন দেখি সারারাত। অথবা হয়তো আমি দেখি নাই।
চলন্ত বাসের ভেতর শীতল বাতাসে স্বপ্ন দেখিনি কিন্তু অস্বস্তিকর যাত্রার কারণে মনে হয়েছে যে দেখেছি। সেটাও হতে পারে। সম্ভাবনার অঙ্কগুলো যে কেন শিখেছিলাম! ভোর যখন আসছে, জানালার বাইরের গাছগুলো ধীরে ধীরে সবুজ হয়ে উঠছে। আমার গায়ে, মুখে লেগে থাকা ময়লা সবুজটাও ধীরে ধীরে আরো সবুজ হয়ে উঠতে থাকে। আমি সাগরের কাছাকাছি চলে এসেছি।
এখন সামনের নীলের তীব্রতায় ঢাকাতে রেখে আসা লাশের স্মৃতি কিছুটা ম্লান হয়। আমি তাদেরকে কিছুদিন ঘুমুতে বলি। আবার ফিরে আসবো এই আশ্বাস পেয়ে তারা আমাকে আগামী তিন দিনের জন্যে ছেড়ে দেয়।
===
- অনীক আন্দালিব
১.৪.৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।