এলোমেলো ভাবনা সারাক্ষণ মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে
কয়েকবার কক্সবাজার গিয়েছি। কিন্তু এবার যাওয়াটা একটু ভিন্নধরণের। অফিসের অল স্টাফ মিটিংএ যোগদানের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার যেতে হয়েছিল। টানা ১৪ হতে ২০ মার্চ,২০০৯ থাকতে হয়েছে সেখানে। সকাল ৯ টা হতে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত অফিসের কাজ আর আগে পিছে ঘোরাঘুরি।
১৯ মার্চ ছিল সম্পূর্ণ নিজের মতো করে উপভোগ করার স্বাধীনতা।
সকালেই আমরা বেরিয়ে যেতাম সাগর তীরে হাঁটার জন্য, সকালের হাওয়া, ভেজা বালির গন্ধ, সাগরের বিশালতা সব মিলিয়ে চমৎকার এক অনুভূতি। শুধু হাটলেই কী আর হয়? সাগরের এই সিগ্ধ জলে গা ভিজাতে হবে না? ঢেউয়ের সাথে একটুসখানি কথা বলতে হবে না? যেই বলা সেই কাজ। কত ধরণের মানুষের যে আনাগোনা। কেউ গোছল করছে, কেউ বা ছবি তোলায় ব্যাস্ত, কেই বা বলছে বড় ঢেউয়ের ছবি খুব ভাল করেই নিতে হবে।
ছোট সোনামনিদের দেখে মনে হয়েছে তাদের ভয় বলে কিছু নেই, ওরা ভয়কে জয় করতে পেরেছে। কী যে খুশি। ওদের খুশি দেখে যেন সাগরও খু - উ - ব খুশি। এই সুন্দর ণে অফিসের সময়ের কথা মনে হলে মনটা বিষাদে ভরে যেত। বিষাদ ভরা মনটানে টেনে নিয়ে যেতে হতো মিটিং রুমে।
বিকালে আবার সাগর তীরে এসে প্রকৃতিকে উপভোগ করার পালা। পিছনে বালুরাশি। সামনে সাগর। কিছু ঝিনুক, তারা মাছ এদিক ওদিক ছড়ানো। ঢেউগুলো আছরে পড়ে তীরে, আবার আসে ঢেউ।
গোধুলী বেলায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনা চমৎকার দেখায়। দু একটা সী বার্ড এদিক ওদিক উড়ছে। সূষ্যি মামাও প্রস্ততি নিতে থাকে ভিন দেশে যাওয়ার। প্রকৃতি এত সুন্দর! মাঝে মাঝে দু একজন ডাকতে থাকে আপা কিছু কিনবেন? ছোট্ট একটি মেয়ে আমার কাছাকাছি এসে বলে দেখেন আপা খুব সুন্দর এই দুল, আপনাকে খুব মানাবে, কিনেন আপা (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিল, কিন্তু আমি ঠিকই বুঝে নিয়েছি)। আমি নেড়ে চেড়ে দেখি।
বলি বাহঃ খুব সুন্দর তো। ও খুশিতে বলে আপা, কিনেন আপা, দাম খুব সন্তা। আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। আমি জিজ্ঞাসা করি, তোমার নাম কি? ও বলে, সাথী। পরিবারে কে কে আছে, বলে আমার নিজের মা নেই।
বাবা অন্য একটা বিয়ে করেছে। আমার এক বোন ছিল, আমার বোনও এই কাজ করতো, একদিন আর সে ফিরে এল না, কোথায় যে গেল কে জানে! এই কথা বলে সাথী কেঁদে দিল। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। বললাম তুমি পড়? মাথা নেড়ে বললো হ্যা ২য় শ্রেণীতে পড়ি, একটা এনজিও স্কুলে। সাথীর প্রতি শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় আমার মনটা ভরে গেল।
ওর বেশির ভাগ জিনিস আমি কিনে নিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বললো আপা এই মালাটা আপনাকে দিলাম ---- আমার দিক থেকে আপনাকে উপহার। আমি বললাম তোমাকে আমি কী দেই বলতো? ও বলল আমাকে কেউ আদর করে না, এই জিনিসগুলি বিক্রি না করলে আমার ২য় মা আমাকে খুব বকা দেয়, মাঝে মাঝে খুব মারে। কত সময় যে না খেয়ে থাকি। আমি সাথীকে বুকে টেনে নিলাম।
ওর হাতে ১০০ টাকার একটা নোট গুজে দিলাম। বললাম তুমি এটা দিয়ে কিছু কিনে খেও। ও ধীরে চলে গেল। সাথীর পথ চলার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কত শিশুযে আছে যারা অনাদরে, অবহেলায়, অনাহারে, অপুষ্টিতে, রোগে শোকে পৃথিবী হতে ঝড়ে যাচ্ছে তার হিসার আমার মতো হতভাগ্যরা রাখি না অথাবা একটু ভাবার চেষ্টাও করি না। ঔ দিন খুব কষ্ট হয়েছিল।
বার বার সাথীর কথা মনে হয়েছে।
১৯ তারিখে সকাল ৮:৩০ মিঃ থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত টানা সাগরকে উপভোগ করার পালা। ঐদিন আমার অনেক কলিগ টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, মহেষখালী, হিমছড়ি গেল। কিন্তু আমার কেন যেন যেতে মন সায় দিল না। আমার সাথে কিছু কলিগও যাওয়া হতে বিরত থাকলো।
বিকেলে আবার সূর্যাস্ত দেখতে সাগর তীরে। আমি ছবি তুলছি সূয্যি মামার, বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে। এমন সময় একজন ভদ্র মহিলা এসে বললো আপা আমিসহ আমার বাচ্ছাটার ছবি তুলে নেন। আপনি তো সাংবাদিক, দেখবেন পেপারে ছবিটা যেন খুব ভালভাবে আসে। আমি হেসে বললাম, আপা আমি তো সাংবাদিক নই।
আমি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। ভদ্র মহিলা আমার দিকে খুবই বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন, চেহারা দেখে তো তা মনে হচ্ছে না, ছবি তুলবেন না তাই বলেন। ভদ্রমহিলা তার সন্তানকে টেনে নিয়ে দ্রুত আমা হতে দূরে চলে গেলেন। ভদ্রমহিলা চলে যেতেই আমি তাকিয়ে দেখলাম ততণে সূষ্যি মামা টুপ ডুব দিয়ে ভিন দেশে চলে গিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকারের আয়োজন।
খুব আশা ছিল শেষ দিনে সূর্যাস্তটা একটু রশিয়ে রশিয়ে উপভোগ করবো। কিন্তু কি আর করার। ভাবলাম উদার সাগরের মতো সূয্যি মামারও কোন রকম কৃপণতা নেই। সূয্যি মামা একদেশে আলো বিলিয়ে অন্য দেশে আলো দিতে চলে গিয়েছে। আমার কয়েকজন কলিগ দূর হতে এগিয়ে এলেন এবং হেসে বললেন, কবি কবি ভাব, কবিতার অভাব' আর প্রকৃতি দেখতে হবে না, চলেন এখন যেতে হবে।
অনিচ্ছা স্বত্বেও পা বাড়াতে হলো। হাটি আর পিছন ফিরি, ............ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে সাগরের জলরাশি, শুধু শুনতে পাই সাগরের তর্জন - গর্জন, তাও এক সময় ক্ষীন হয়ে আসে। বেদনায় ভরা মনে ভাবতে থাকি ---- কবে আর হবে দেখা..............
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।