আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প ||| নৈঃশব্দে খসে পড়ে স্বপ্ন সিঁড়ি

আহসান জামান

ড্রইং রুমে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যেতে যেতে মঈন দেখল, সাত্ত্বিকা দৌঁড়ে শাড়ী পরতে যাচ্ছে রুমে। ঃ দেখো, তোমার চা খেতে খেতে শাড়ী পরা হয়ে যাবে। মঈন কোনো উত্তর দেয় না। সে জানে সাত্ত্বিকার সময় জ্ঞান আছে, বরং মঈনেরই বেশী সময় লাগে; রুটিন ধরে এটা ওটা করা, বাথরুমে যাওয়া, পানি খাওয়া আরো কত কী। তাতে সাত্ত্বিকাও মেকাপের একটু বেশী সময় পায়।

ওদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় বছর দুই। সুখী সংসার, মঈন ভীষণ ভালবাসে সাত্ত্বিকাকে, সাত্ত্বিকাও। কবে কখন ওদের ঝগড়া হয়েছে মঈন ঠিক মনে করতে পারে না। সে একটু অসস্তি বোধ করলেই সাত্ত্বিকা যেন টের পায়। ভাবতে ভাবতে মঈন সোফায় বসে, চায়ে চুমুক দেয়।

ছুটির দিনে দুপুরে খাওয়ার পর চা নিয়ে বসে মঈনের খুব ভালো লাগে; সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে পড়ে। আবারও চুমুক দেয় চায়ে। আজ সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসায় যাবে। প্রায় এক ঘন্টার ড্রাইভ। ওরা দু’জনেই লং ড্রাইভ পছন্দ করে।

সাত্ত্বিকা আজ হালকা নীল শাড়ী পড়বে, মঈন জানে; আগে থেকেই ঠিক করেছে সাত্ত্বিকা। মঈন পরেছে সাত্ত্বিকার পছন্দের জামা। ভাবতে ভাবতে মঈনের মন পিছনে হাঁটে; সেবার দেশে গিয়ে বাবা-মার অনুরোধে সে বিয়ে করল। অবশ্য মঈনের তেমন কোনো পছন্দ ছিলো না - দেশে বা বিদেশে। যাইহোক, পারিবারিক ভাবে বিয়ে; কিন্তু ভীষণ মিলমিশ তাদের।

মঈন চায়ে চুমুক দেয়। তার চোখে মুখে এক প্রশান্তির হাওয়া ওড়ে - হারায় আনমনে; যেনো নীল ধান খেতে অহেতুক বাতাসের দোল - অদম্য ঝির ঝির সুর। মঈনের মনে পড়ে সেই ফেলে আসা দিনগুলো কথা। যদিও সে মনে করতে চায় না, তবুও মনে পড়ে। কে চায় ফিরে ফিরে দুঃখ পেতে! অতীতের সামান্য বোবা কান্নার সাথে সে মিশাতে চায় না এইসব হাসি-আনন্দের প্রহর।

মঈন আবারও চায়ে চুমুক দেয়, নড়ে বসে সোফায়। শাড়ীটা মঈনই একদিন হঠাৎ কিনে এনেছিল। সাত্ত্বিকাও খুব পছন্দ করেছে হালকা নীল রংটা। এইতো সেদিন হাঁটতে হাঁটতে এক বাংলাদেশী দোকানে দেখেই; ওর জন্য কিনেছে সে। সাত্ত্বিকার খুব পছন্দ, তারপরও এক ধরনের অপরাধ বোধে ভোগে সে।

ভীষণ অবাক করে মঈনের মনে পড়ে চৈতীর কথা। ওরও কী প্রিয় রং - হালকা নীল ছিলো; মঈন মনে করতে পারে না। তবে সেও নীল পড়ত অহরহ। সাত্ত্বিকার সাথে চৈতীর এমনিতেই অনেক অমিল। ফলে মঈনের এ নিয়ে এমন মাথা ব্যথাও নেই।

তবে কেনো জানি আজ, এই নিরিবিলিতে তার কথা মঈনকে ভীষণ পীড়া দেয়। চৈতী; বিশ্ববিদ্যালয়ে মঈনের সহপাঠী; ফেরেন্ডলী, স্মার্ট আর বেশ স্পষ্টবাদী ছিলো। মঈন আগাগড়াই সাধাসিধে বলেই জনপ্রিয় বন্ধুদের আড্ডায়; সবার সাথে খুব দ্রুত জমাতে পারতো সে। ক্লাশ শেষে জুটতো তাদের আড্ডা; মঈন, তিমির, মহিদ, স্বপন আর মাঝে মাঝে দলে যোগ হত হাসি-খুশী নুরুল আলম, সদা হাস্যোজ্জ্বল। ডিপ্টামেন্টের সামনে চায়ের দোকান, সবুজ ঘাসের মাঠ, ডিপ্টামেন্ট ব্লিডিং এর সিঁড়ি - বিভিন্ন জায়গায় বসে বসে জুড়তো তাদের গল্প আর দুষ্টুমীর প্রহর।

আড্ডা প্রিয় ছিল এই বন্ধুরা। কিন্তু আড়ালে চৈতীকে-ভালো-লাগা অসুখটা মঈনের মাঝে প্রবল ভাবে দিন দিন বাড়ে কিন্তু তা আবার প্রতিদিন ক্ষয়ে গেছে বহু প্রশ্নের আড়ালে ... ছিঃ ছিঃ অন্যরা জানলে কী ভাববে ... বন্ধুরা তো টিপ্পনী কাটতে কাটতে ... মধ্যবিত্ত ছেলে সে কীভাবে এসবভাবে ... অনিদিষ্ট ভবিষ্যত ..... ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে সে ছিলো নিম্নমুখী মানুষ; দ্বিধায় থেমে গেছে বার বার। এমন কী সে কখনও চৈতীর সাথে কথা বলেছে কিনা আজ আর মনে করতে পারে না। মঈন আবারও চায়ে চুমুক দেয়; চায়ের কাপ প্রায় শেষ।

যাগগে, সে আর ভাবতে চায় না। সেবার ফাইনাল পরীক্ষার পর, চৈতী চাকরী নিয়ে চলে গেলো ঢাকার বাইরে। মঈন তখনও বেকার, ঢাকায়। চাকরীর দরখস্ত, বিদেশে দরখস্ত; শ্রমে-বিশ্রমে বেশ কিছুদিন গেলো তার। তারপর সত্যিই মঈনও একদিন দেশ ছেড়ে গেলো।

দেশে আর যোগাযোগ রাখা হয়নি; নতুন জীবন-যাপনে। তারপর আর কী! হারাতে হারাতে একদিন মঈন দেখলো; তার আর কেহ নেই। সে সব-কথা মঈনের কাছে থেকে গেলো। ভাবতে ভাবতে মঈনের চায়ের কাপ শুষ্ক। সাত্ত্বিকা এসে দাঁড়াতেই মঈন থতমত; বিস্মত সময় থেকে সে দৌঁড়ে এলো; মুখে হাসির দ্রুত রেখা টেনে বলল, তোমাকে ভীষণ ভালো লাগছে আজ।

ঃ ইস; আগে যেনো দেখনি, ওঠো যাই। মঈন স্পষ্ট টের পেলো, সাত্ত্বিকার প্রশ্নবোধক চোখ; প্রানময় হওয়ার আগেই সে চোখ রেখে বলল, হুম; তুমিতো প্রতিদিনই নতুন ... আমি নিয়ত আবিষ্কার করি তোমাকে ... দু’জনে হাসতে হাসতে গাড়ীতে ওঠে। মঈন গাড়ী স্ট্যাড দিয়ে সিডি অন করলো। সাত্ত্বিকার একটা প্রিয় গান বাজচ্ছে এখন। সাত্ত্বিকাও গুনগুন সুর ধরেছে তার সাথে।

মঈনের আর কথা বলতে ভালো লাগে না; বড় রাস্তায় উঠেই গাড়ীর গতি বাড়ায়; ভিতরে এক রুদ্ধ বোধ ক্রমাগত আহত করে তার - নিরাপদে; সে কী সাত্ত্বিকাকে ঠকাচ্ছে অহরহ!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.