i would like to read and write
প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে চাইনি, এরকমটি হতে পারে। আমার এই বিশ্বাস না করাটাও কম অবিশ্বাস্য নয়। যেখানে খুনতো নয়, লাশেরও শত টুকরা না করলে আজকাল জলাদদরা শান্ত হয় না; তাদের বীরত্বগাথা রচনা যখন সমাজে চলছিল, তখন আমার বাড়ীওয়ালার একমাত্র ছেলেটির মৃত্যুর কথা আমাকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হয়।
নববর্ষের আনন্দ তখনো শেষ হয়নি। বুধবার পহেলা বৈশাখ পড়ায় বৃৃৃহস্পতিবারও শহর ঢাকায় কিছুটা ফাঁকা লাগে।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে, তিনদিনই ছিল ছুটির আমেজ। এরকম ছুটি পেলে সংসারের টুকিটাকি কেনাকাটা ছাড়া খুব একটা বের হই না। যতোটা সম্ভব বিশ্রাম নেয়া যায়। আর এই বিশ্রামের মাঝে হাউমাউ কান্নার রোল আমাকে ওপরতলা থেকে নিচতলার নামিয়ে আনে।
তারপর শুনি, একটি হৃদস্পন্দন অকালে থামিয়ে দিয়েছে কারা যেন। একটি মাত্র গুলিই লেগেছিল, তাতেই ছেলেটি শেষ হয়ে গেছে। ওর মা কাঁদছে। আমি ওঁর দু'চোখে তাকিয়ে দেখলাম যেন নদী বয়ে যাচ্ছে। আর বাবা, নিরেট পাথর হয়ে আছেন।
শান্ত্বনা দিতে গিয়েও পারলাম না। বরং মহাদায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে গিয়ে লাশ আনার ব্যবস্থা করলাম ঢাকা মেডিকেল থেকে। দ্রুত আত্মীয় স্বজনকে খবর দেয়া এবং নামাজে জানাজা শেষে দাফনের প্র¯তুতি নিতে কাজে লাগিয়ে দিলাম পাড়ার কয়েকটি ছেলেকে। ঐ ছেলেগুলোকে চোখের পানি সংবরণ করতে দেখলাম। তারাই মাসকয়েক ধরে ওর জন্য পাত্রী খুঁজছিল।
ছেলেটি দোকানদারি করতো। গত কয়েকদিন ধরে কয়েকটি নতুন বন্ধু হয়েছিল ওর। তাদের সঙ্গেই কোথাও বেড়াতে গিয়ে খুন হয় সে। পত্রিকায় ধানমন্ডি এলাকা থেকে লাশ উদ্ধারের খবর বেরিয়েছে। আপাতত আর কিছু জানা যায়নি।
ওর পরিবারের কেউও এর বেশি কিছু জানে না।
সাদা কাপড়ে মোড়া লাশটি দেখে মৃত্যুর কথা মনে পড়াটাই স্বাভাবিক। পাড়ার ছেলে বুড়ো, মহিলা সবাই এসে একনজর লাশ দেখে গেলে আমরা শাহজাহানপুর গোরস্থানের দিকে রওয়ানা দেই। ওর বাবা এবং চার বন্ধুই লাশ কাঁধে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা পিছু পিছু হাঁটছি।
আমাদের সঙ্গে অনেক অচেনা লোক জড়ো হচ্ছে। শব যাত্রা ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। একজনের জানাজায় শরীক হয়ে দোয়া করলে নাকি নিজের জানাজাতেও লোকসমাগম বেশি হয়। দোয়া পাওয়া যায়। লোকসমাগমে শবযাত্রাটিকে শোক মিছিলই মনে হয় আমার কাছে।
কিছুটা অবাক হয়েই আমি পেছনে তাকাই। ঠিক আন্দাজ করতে পারি না কতো লোক হতে পারে। মিছিলের শেষ অংশ চোখে পড়ছে না তাই। রাস্তাটি সোজা ছিল না। বামে মোড় নিয়েছে মিছিলের শুরুটা।
আমিও এখানটায়। হঠাৎ কৌতুহল বেড়ে গেলে যেমনটি হয়, আমিও তাই পায়ের গতি কমিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে পাশ কেটে ফুটপাতে নিজেকে আবিস্কার করলাম। অনেকটা অবচেতন মনেই বলা যেতে পারে। কেন যে ইদানীং মানুষ নিয়ে বিশেষ কৌতুহলী হয়ে উঠছি আজকাল, বুঝতে পারি না।
মাঝে মাঝে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, সুস্থ্য আছি তো? রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন এই শহরটার অসহায়ত্ব দেখি-মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। এত লোক সমাগম-এই শহরের রাস্তাঘাটগুলো যেন আর ভার সইতে পারছে না। আমারই মাথা ভিরমি খেয়ে যায়। তখন মনে হয়-মড়ক লেগে মানুষগুলো মরছে না কেন? কিংবা হাজার হাজার মানুষের সমাগমে ঐশীবানে সবগুলো মানুষ হারিয়ে গেলে ভালই হয়। -সত্যি সত্যিই মানুষের ভিড় দেখলে মেজাজটা আমার চটে যায়।
ভাবি-কোন সমস্যা হয়নি তো? কোন সুস্থ মানুষ কি এধরণের চিন্তা করতে পারে?
কিন্তু আজ এই মানুষগুলোকে দেখে আমার বিরক্তিবোধ হচ্ছে না। বরং ফুটপাতে দাঁড়িয়ে শব মিছিলটির যত ব্যাপ্তি দেখছি, ততই বেশি করে অবাক হচ্ছি। আশপাশের মহলারতো বটেই, বাইরের লোকেরাও এসেছে। সামাজিক আচার পালন করছে লোকগুলো।
অবাক হয়ে ভাবি-এই সমাজেও মানুষ খুন হতে পারে! ছিনতাই হতে পারে? গতকালই পত্রিকায় পড়েছিলামঃ ছিনতাইকারীরা গুলিস্তানের এক ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করে টাকা নিয়ে গেছে।
তখন দুপুর বারোটা। গুলিস্তানে দুপুর বারোটা মানে অন্য রকম কোলাহল। কই কেউতো প্রতিবাদ করলো না। আবারো ভাবি-এই মানুষগুলোতো সেই মানুষ। বিশ্বাস করতে কস্ট হচ্ছিল,তখনই বউয়ের কথা মনে পড়েঃ আজকাল তুমি নিজেকেও বিশ্বাস করছো কি?
বউয়ের এই খেদোক্তি নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই।
কারণ গত দশ বছরের সংসার জীবনে জাতীয় জীবনের অনেক কিছুই তার সঙ্গে শেয়ার করেছি। দেশের হাল যাদের হাতে, তাদের নানা কান্ডকীর্তির খবর এখন সে জানে। কিন্তু আজকাল বেশি শুনতে চায় না। আমাকে থামিয়ে দিতে চায়। সম্ভবত: বিশ্বাস উবে গেলে বাঁচবো কি করে-তা ভেবে।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে জিগ্যেস করতে হয়-সুস্থ্য আছি তো? উত্তর খুঁজতে চাই না আর। বরং দ্রুত পা ফেলি-শব মিছিলের সামনে যেতে চাই।
লাশ দাফন শেষ, সবাই ফিরে যাচ্ছে। আমি মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকলাম, নতুন কবরটির পাশে। পুরনো কবরবাসী কি বলছে? নতুন লাশটিকে কিভাবে তারা দেখছে।
তাদের আত্মার সঙ্গে কি এই লাশের কথা হবে? আমাকে আবার ভাবনায় পেয়ে বসে-জবরদস্তি করে দুনিয়ায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় কি লাভ? যদি মাটি বুকে চাপা পড়ে এখানেই এভাবে শুয়ে থাকতে হবে?-শেষবারের মত আমি কবরবাসীর নাজাত কামনা করে ফিরে যাবো, এমন সময় চোখে পড়ে দশ-বারো হাত দুরে একটি কবরের ওপর কয়েক গোছা রজনীগন্ধা আর লালগোলাপের তোড়া। পাপড়িগুলো এখনো নেতিয়ে পড়েনি। মৃদু বাতাসে একটু নড়ছে, নাকি আমাকে ডাকছে? ওদিকে টেনে নিয়েছে কৌতুহল। দেখি, একটি ফুলস্কেপ কাগজে মেয়েলি হাতের লেখা চাপা পড়ে আছে তাতে। আমি সেটি হাতে তুলে নিই।
Ñবছর ঘুরে নববর্ষ আসে, আসবেই। জীবন থাকলে মৃত্যু হবে-এই তো স্বাভাবিক। স্রোতের রেখা মুছে যাবে, নদীও শুকিয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখ কি ভুলে যাবে-চোখের জল হয়তো মুছে যাবে। জানি-কার জন্যে কে বসে থাকবে-সবাই নিজ পথে এগুবে।
তাহলে কেন মিছেমিছি বলেছিলে-সব শেষ হয়ে যাবে, শুধু থাকবো দু’জনা। তোমাকে দুষছিনে, এ আমার ভাগ্য-কিভাবে অস্বীকার করি বলো। সেইতো ভাল ছিল যদি ভাবতে শিখতাম-তুমি চলে যাবে, সারারাত নির্ঘুম বাতিহীন অন্ধকার থাকবে শুধু, থাকবে না কেবল তুমি। মুত্যু হতে পারে পবিত্র পরিত্রান, কিন্তু জানোয়ারের হাতে স্বপ্ন-সৌন্দর্য বিনাশ-এ কিভাবে মানি।
জানো, বছর পেরিয়ে গেছে।
নববর্ষের উচ্ছলতা চারদিকে। এইতো-তুমি হাতে গোলাপ ধরিয়ে দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দিয়েছিলে। মনে পড়ে কি তোমার? পনেরদিনের টুম্পামনি আজ একটু একটু হাঁটতে শিখেছে। আট বছরের সৌরভ এখন নয় বছরে পা দিয়েছে। এখনো বলে বাবা কবে আসবে।
তোমার টুম্পামনিকে কি উত্তর দেব? ওতো জানতে চাইবে ওর বাবাকে। উত্তর অবশ্য পেয়ে যাব। এ মুত্যু উপত্যকায় আরো কারো বলি হওয়াইতো এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ওদের উদাহরণ টেনেই না হয় বলবো। তোমার তাতে আপত্তির কিছু নেই।
মেয়েটা অন্তত মিছে আশায় বড় হবে না। আমি যেমন আশাহত হয়েছি-ওদের আগে থেকেই কঠিনেরে ভালবাসতে শেখানো উচিত।
এই-তুমি জানো, এবারেও বারোটা খুন হয়েছে। আমি না এতে খুশী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।
শুধু তোমার জন্যে। তুমিতো আমার অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা করে দিয়েছ। রঙিন শাড়ি থেকে সাদা শাড়িতে হাসি বড্ড বেমানান। ছেলেটি প্রায়ই বলে-আম্মু তোমার কি হাসতে মন চায় না? ঐ যে দেখ আমার বন্ধু সজলের মা কেমন করে হাসে। ওর বাবা ওকে স্কুলে দিয়ে যায়।
মা এসে নিয়ে যায়। তোমারতো অনেক কস্ট। দু’বারেই আমাকে আনা নেয়া করতে হয়। আচ্ছা তুমি বাবাকে একা ঘর থেকে বেরুতে দিলে কেন?
তোমার ছেলের এই প্রশ্নের উত্তর কি আছে? থাকলেও আমার জানা নেই। হয়তো ও বড় হয়ে একদিন নিজেই উত্তর খুঁজে নেবে।
যে বাংলা ভাষা, মাটি আর দেশের কথা বলতে তুমি, বাংলা নববর্ষের পরদিনইতো, রেললাইন ক্রস করার সময় ফেন্সি আড়তের বেজন্মা কসাইগুলোর বন্দুক যুদ্ধে তুমি ক্রশফায়ারে পড়ে গেলে। তোমার মৃত্যুর খবরও পেয়েছিলাম ২৪ ঘন্টা পর পত্রিকায়। বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার পথে ক্রশফায়ারে যখন তোমার মাথা ভেদ করে গুলি চলে যায়, তোমার জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। দিনের ঘটনা। বিকাল পাঁচটার দিকে।
দয়া পরবশ হয়ে তোমাকে কেউ একজন নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। রাতে তুমি ফেরোনি। এদিকে শুরু হয় খোঁজাখুজি। তোমার বন্ধুর বাসায় ফোন করি। তোমার বাবা ছুটে যান।
কিন্তু হদিস মেলে না। সকালে পত্রিকায় পথচারী নিহত হওয়ার খবর পেয়ে ডিএমসিতে ছুটে গিয়ে দেখি তোমার নিথর নিস্তেজ দেহ, পড়ে আছে হাসপাতালের ফোরে। তারপর--কয়েকদিনের ঘটনা আমি আর বলতে পারি না। কয়েকদিন পরের ঘটনা-নির্বাক হয়ে তোমার বাবা বিছানায় পড়ে যান। কয়েকমাসের মাথায় মারা যান।
একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় তোমার মা আর তোমার সৌরভ ও টুম্পামনিকে নিয়ে আমি আজো বেঁচে আছি। আর তোমার দেশ, দেশের সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো-যা তুমি বেশি করে বলতে-সে সব যে শুধুই কাগজে কলমে, তা দেখে যাচ্ছি।
ও, তোমাকে আসল কথা বলতেই ভুলে গেছি। গ্রীষ্মটা কালবোশেখীর। আমার হৃদয়ে কেবল ঝড় বয়ে দিচ্ছে।
তোমার দোতলা বাড়ির নিচতলার বামপাশের দোকান আর ডানপাশের ভাড়াটেদের কাছে যা পেতাম, তাই দিয়ে সংসার চলছিল। ওদের লেখাপড়ার খরচও। কিন্তু সেদিন নামমাত্র টাকায় তোমার মায়ের কাছ থেকে সই নিয়ে বাড়িটি কিনে নিয়েছে একজন। তার নাম প্রকাশে ভয় আছে। এখানে নাকি ফ্যাটবাড়ি হবে।
নিরূপায় হয়ে আমরা গ্রামে চলে যাচ্ছি। জানি না, সেখানে কি হবে। হয়তো তোমার কাছে আর আসা হবে না। পারলে মা করে দিও।
-ইতি
তোমারই আমি
চিঠি পড়া শেষ হতেই একটু আগে এখানে দাফনের দৃশ্যটি আরেকবার মনে করি।
একদিন এখানেইতো পত্র প্রাপকের দাফন হয়েছিল। স্বজনরা এসেছিল। আজ আমরাও একটি লাশ রেখে গেলাম।
আমাকে আনমনা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝি বন্ধু মোহন এগিয়ে এসে বলল, আসাদ চল। দুঃখ করে লাভ নেই।
আমি ওর হাতে চিঠিটি ধরিয়ে দিয়ে সামনে পা বাড়ালাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।