আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবশেষে আমজাদ আলীর খবর এলো



বিডিআর বিদ্রোহে নিহত বেসামরিক নাগরিকদের খবর অবশেষে মিডিয়াতে আসলো। এতদিন সেনাবাহিনীরে নিয়া সবাই এত ব্যস্ত ছিলো যে সাধারণ মানুষের খবরই নেয়া হয়ে উঠে নাই কারোর। যাই হোক বিডি নিউজ থেইকা তুইলা দিলাম। আবু নোমান সজীব বিডিনিউজ ২৪ ডটকম প্রতিবেদক ঢাকা, মার্চ ০৪ (বিডিনিউজ ২৪ ডটকম)- "এমনিতেই গরীব মানুষ। পেডে ভাতই জোটে না, এরপর দাফন-কাফনের খরচ আর লাশডা বাড়িত লইয়া যাইতে ১০ হাজার টাকার বেশি ঋণ হইয়া গেছে।

এখন ঋণের টাকা জোগাড় করুম, না সংসার চালামু?" এ প্রশ্ন বিডিআর বিদ্রোহের প্রথম দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত নির্মাণ শ্রমিক আমজাদ আলীর (৫২) স্ত্রী রাশীদা বেগমের। বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে নিজের ঔষুধ কিনতে গিয়ে বিডিআর পাঁচ নাম্বার গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। রাজধানীর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার বৌ-বাজার রানা বেকারীর গলিতে উজ্জ্বলের বস্তির একটি ছাপড়া ঘর মাসিক ১২শ' টাকা ভাড়া নিয়ে স্বপরিবারে থাকতেন আমজাদ আলী। মাত্র ১০ ফুট লম্বা আর ৮ ফুট চওড়া ছোট্ট এই ঘরেই স্ত্রী, চার ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে গাদাগাদি করে থাকতেন তিনি। স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে রাশীদা বলেন, "ওইদিন সকালবেলা বাসা থেকে বাইর হওনের সময় উনারে ঘুমে রাইখা গেলাম।

দুপুর বেলা ফিইরা শুনি ওনার গুলি লাগছে। পরে ছোট্ট ছেলেডারে লইয়া এক হাসপাতাল থাইকা আরেক হাসপাতালে ঘুইরাও উনার কোন খবর পাই না। পরদিন বহুত খোঁজাখুজি কইরা বিকেলে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে যাইয়া দেখি স্বামী ঘুমাইয়া আছে। " রাশীদা জানান, ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার চুয়ান্নিমদ গ্রামে তাদের বাড়ি। স্বামীকে নিয়ে প্রায় বিশ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকা আসেন।

স্বামী দীর্ঘদিন থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। বেশ কয়েক বছর হলো কাজ বাদ দিয়েছেন। ছয় সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মোস্তফা বিয়ে করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে থাকে ময়মনসিংহে। মেজো ছেলে মুসলিম (১৬) টালি অফিসের একটি মুদী দোকানে মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে কাজ করে। আর নিজে কয়েক বাসায় ছোটা কাজ করে যে হাজার দেড়েক টাকা পান তা দিয়েই টেনেটুনে কোনোরকমে চলে যায় সংসার।

মেজো ছেলে মুসলিম বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেও তার ছোট তিন ভাইবোন রবিন (৫), বাবু (১০) এবং পুতুল (৬) এর ধারণা বাবা আবার ফিরে আসবে। আবারও আদর করে কোলে তুলে নেবে তাদের। ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে কোন সহায়তা পেয়েছেন কিনা, জানতে চাইলে রাশীদা বলেন, "বাবারে অমরা গরীব মানুষ, কাদা পানির মধ্যে বস্তিতে থাকি, আমাগো খবর লইতে কিডা আসবি। আর সরকারও তো ব্যস্ত খালি অফিসারগো নিয়া। আমাগো কথা ভাবার সময় কি তাগো আছে?।

" রাশীদা জানান, ঘটনার পর লাশের খোঁজে দৌঁড়াদৌঁড়ি, কাফনের সরঞ্জাম কেনা, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ ফুলপুর নিয়ে দাফন, পরে আবার সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে এখন পর্যন্ত ধারের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাবার শোকে ছেলেও কাজে যোগ দিতে পারেনি। এখন একদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ আর অন্যদিকে সংসার খরচ চালানোর চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছেন রাশীদা। লাল গেঞ্জির কারণে সনাক্ত হয় হৃদয়ের লাশ বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে পিলখানা গেটের বিপরীতে লেকপাড়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সবজী বিক্রেতা হৃদয় ব্যাপরী (১৪)। গোলাগুলির শব্দ শুনে নিজের সবজির ভ্যান ধানমণ্ডি ১৫ নাম্বার স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে রেখে পিলখানা গেটের সামনের ঘটনা দেখতে গিয়েছিলো হৃদয়।

কিন্তু সেখান থেকে আর তার ফেরা হয়নি। জিগাতলা ৭১/৪ হাজী আফসারউদ্দিন রোডের মহসিনের আধাপাকা বাড়ির আনুমানিক ১২ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকে হৃদয়ের পরিবার। বড় ছেলে জসিম (২৫) এবং হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে ভ্যানে সবজি বিক্রি করতেন বাবা রাজা মিয়া (৫০)। মঙ্গলবার রাতে হৃদয়ের বাসায় গিয়ে দেখা যায় ছোট ওই কক্ষে বিলাপ করছেন হৃদয়ের মা হামিদা বেগম ও নানী সাবিয়া খাতুন। আর তাদের ঘিরে রয়েছে হৃদয়ের ছোট চার বোন।

ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই মা হামিদা খাতুন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, "বাবারে বড় ছাউলডা আমার আধপাগলা। হৃদয়ই আছিলো চালাক-চতুর। ওরে নিয়া অনেক স্বপ্ন আছিলো। কি থেইকা যে কি হইয়া গেলো কিছুই বুঝবার পারতাছি না। " নানী সাবিয়া খাতুনও একইসঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "মেয়েডা আমার ইট ভাইঙ্গা, মানুষের বাসায় কাজ কইরা ছেলেডারে বড় করছে।

সেই পুলায় চোখের সামনে চইলা গেলো। " বাবা রাজা মিয়া বলেন, "ভোরে উইঠা ছেলেডা কাওরান বাজার থেইকা মাল আইনা গাড়ি সাজাইলো। হেই গাড়ি লইয়া ঘণ্টা তিনেক বেচাবিক্রি কইরা ওরে গাড়িডা দিয়া আমি বাসায় চইলা আসি। পরে দুপুরে কেডা যেন ফোন কইরা জানায় ওর গুলি লাগছে। খবর পাইয়া এই হাসপাতাল, সেই হাসপাতাল ঘুইরা পরের দিন বিকালে ঢাকা মেডিকেলের ৩২ নাম্বার ওয়ার্ডের গলিতে ওর লাশ খুঁইজা পাই।

" তিনি বলেন, "বাবা আমার লাল গেঞ্জি পইরা ছিলো বলে ওরে খুঁইজা পাইছি। লাল গেঞ্জিডা রক্তে আরো লাল হইয়া ছিলো। " রাজা মিয়া জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে লাশ পাওয়ার পর ওইদিনই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার লাঙ্গলবন্দ নিয়ে দাফন করেন। লাশ বহন এবং দাফনের কাজে ইতোমধ্যে অনেক টাকা ঋণ করেছেন জানিয়ে রাজা মিয়া বলেন, "কাফনের কাপড় থেইকা শুরু করে আগরবাতি সবই কিনছি নিজের টাকায়। আর টাকা ধার লইয়া অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিছি।

" তিনি আরো বলেন, "সরকার থেইকা সাহায্য তো দূরে থাক, এলাকার কমিশনার পর্যন্ত এখনো আমাগো খবর লই নাই। তয় এলাকার স্বপন নামে এক নেতা কাগজপত্র লইয়া তার বাড়িত যাইয়া দেখা করতে কইছিলো। " একইদিন দুপুর তিনটার দিকে পিলখানার চার নাম্বার গেটের উল্টোদিকে লেকের পাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পিপলস ইউনিভার্সিটির বিবিএ চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র খন্দোকার তারিক আজিজ সজীব। ঘটনার সময় তারিকের পাশেই থাকা আরিফুর রহমান জানান, গুলিবিদ্ধ এক পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজে গুলিবিদ্ধ হন তারেক। ওই পুলিশ সদস্য প্রাণে রক্ষা পেলেও বাঁচা হয়নি তারিকের।

দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তারিক ছিলো দ্বিতীয়। বড় বোন পায়েলের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই শুভ তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বাবা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব আনম শামসুদ্দোহা। রাজধানীর টোলারবাগ পানির ট্যাঙ্কি এলাকায় থাকে তারিকের পরিবার।

মঙ্গলবার রাতে সেখানে গিয়ে ওই বাসা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা জানায়, লাশ নিয়ে নোয়াখালী যাওয়ার পর তারিকের পরিবার এখনো ফেরেনি। তারিকের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আরাফাত রহমান অ্যালেক্স বিডিনিউজ ২৪ ডটকমকে বলেন, "মিরপুরের এফএম ইন্টারন্যাশনাল কলেজ থেকে আমরা একসঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করি। জীবনে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতো ও। আমাদের থেকে ও যেন ছিলো একটু অন্যরকম।

যেভাবেই হোক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্য ছিলো তারিকের। বাবা-মার উপর চাপ কমাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম জবেরও চেষ্টা করছিলো ও। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেলো। "

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।