আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কান্তজিউর মন্দিরের নামে দান করা দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে মাদ্রাসা নির্মাণ প্রসঙ্গে



নিচের লেখাটি প্রথম আলোতে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঐতিহ্য/হেরিটেজ বিষয়ক আলাপচারিতায় আমাদের বক্তব্য কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রমী এবং অনুচ্চারিত প্রসঙ্গের উত্থাপন করেছে। আশা করি ব্লগের পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে এই প্রসঙ্গগুলো। লেখাটির শেষে একটি আপডেট রয়েছে। কান্তজিউর মন্দিরের জমিতে মাদ্রাসা নির্মাণে প্রশ্নবিদ্ধ প্রত্নস্থানের সংরণ ব্যবস্থা স্বাধীন সেন, মাসউদ ইমরান, জয়ন্ত সিংহ রায়, সৈয়দ মো. কামরুল আহছান, অনন্যা জুলফিকার শাওলি, আফরোজা খান মিতা, সাইফুর রহমান, আহমেদ শরীফ, সারোয়ার বাশার ও নাজমুস সাকিব প্রথম আলোর (৬ ফেব্র“য়ারি, শুক্রবার) শেষপাতায় প্রকাশিত কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে হঠাৎ মাদ্রাসা! শিরোনামের সংবাদ পড়ার পরিপ্রেেিত এই প্রতিক্রিয়া কেবল উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও নিন্দা জানানোর জন্যে নয়।

কারণ আধিপত্যশীল অনুশীলন ও তৎপরতা সম্পর্কে এবম্বিধ প্রতিক্রিয়া কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ফলপ্রদান করে না। একথা অতীতের বহু ঘটনায়ই প্রকটভাবে স্পষ্ট। বরং আমরা মাদ্রাসা নিমার্ণের ঘটনাটিকে চলমান প্রতœতত্ত্বীয় ও আইনী জটিলতার প্রোপটে এবং বাংলাদেশব্যাপী, বিশেষকরে, উত্তরবঙ্গে প্রতœস্থান ও প্রতœস্থাপনা নিয়ে আমাদের চলমান গবেষণার প্রেেিত ঠাহর করতে চাই। আমাদের ল্য বাংলাদেশের প্রতœতত্ত্বসম্পর্কিত ও ভূমি-ভূমিব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় আইনীব্যবস্থার বহুমাত্রিক স্ববিরোধিতার দিকেও ইঙ্গিত করা। কান্তজিউর মন্দির এবং এই মন্দিরগাত্রের অনবদ্য পোড়ামাটির চিত্রফলক দণি এশিয়ায় অনন্য।

এই পোড়ামাটির চিত্রফলকের শৈলি পূর্ব ভারতের বিশেষায়িত শিল্পঐতিহ্যের প্রকাশক। এই শিল্পঐতিহ্য ঔপনিবেশিক শিল্পঐতিহ্যর প্রভাবে স্থানীয় শিল্পঐতিহ্যের রূপান্তরেরও স্যা। প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে কান্তজিউর মন্দির উপর্যোক্ত কারণেই অনন্যসাধারণ এবং বাংলাদেশের প্রেেিত ব্যতিক্রমী। বর্তমানে ধর্মীয় অনুশীলন অব্যহত থাকায় এবং সংরতি প্রতœকীর্তি হিসাবে গণ্য হওয়ায় কান্তজিউর মন্দিরটি ধবংশ হয়ে যাওয়া থেকে রা পাচ্ছে। পাশাপাশি, মন্দিরটি সম্পর্কে দেশীয়-আন্তজার্তিক মহলের আগ্রহও এটি রা পাওয়ার একটি বড় কারণ।

আমরা একথা বলতে পারছি তার কারণ হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলেই অনেক মন্দির হিন্দুদের অব্যহত দেশত্যাগের কারণে পরিত্যক্ত ও পরবর্তীতে জবরদখল হওয়ার কারণে অন্তর্হিত হয়েছে। আরো যে বিষয়টি এখানে ল্যণীয় সেটি হচ্ছে, দখল হয়েছে মন্দিরের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে দান করে দেয়া জমি। মন্দির, বৌদ্ধবিহার ও স্তুপের রণাবেণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যয়ভার পুরণের জন্য জমি দান করা একটি প্রাচীন রীতি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বেশিরভাগ তাম্রলিপিই ধর্মীয় স্থাপনার জন্য ভূমিদান করার দালিলিক প্রামাণ্য। আধুনিক রাষ্ট্রীয় কানুনী ভাষায় এই ধরনের দানকৃত ভূমিকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে পরিগণিত করা হয়।

মজার বিষয় এই যে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে এই সম্পত্তিকে ইজারা দেওয়া যায় (সংশ্লিষ্ট মন্দির কর্তৃপরে মতামত বিবেচনা না করেও)। কিন্তু এই ধরনের সম্পত্তি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দেয়া কিংবা বিক্রি করা যায় না। অথচ, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে আমাদের পরিচালিত জরিপে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি যে, সংখ্যালঘু ধর্ম ও জাতির ধর্মীয় অনুশীলনের সঙ্গে বর্তমান পর্যন্ত সম্পর্কিত স্থাপনাগুলোর েেত্রও এমন ক্রয়-বিক্রয় ও বন্দোবস্তের নামে দখল কার্যক্রম জারি আছে দীর্ঘদিন যাবত। উদাহরণ হিসাবে আমরা দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানার মির্জাপুরের জম্বুলেশ্বর মন্ডবের নাম উল্লেখ করতে চাই। এখানে একটি পুরানো স্থাপনা (সম্ভবত ১৩শ শতক পূর্ববর্তী সময়ের) বিশিষ্ট ঢিবির উপরে একটি শিবলিঙ্গ বিশিষ্ট মন্দির অবস্থিত।

এই ঢিবি ও মণ্ডবকে কেন্ত্র করে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বিরাট মেলার ও পূজার আয়োজন করা হয়। এই ঢিবি থেকে সংগৃহিত উমা-মহেশ্বরের একটি মূর্তি দিনাজপুর জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। মন্দিরটির শিবলিঙ্গটি বহুবার লুটেরারা ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ মন্দিরটির পাশেই মন্দিরটির নামে দানকরা দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে পরিগণিত জমি দখল করে মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়েছে। তুলনীয় সমান্তরাল উদাহরণ ওই অঞ্চলে অসংখ্য।

বিরামপুরেই চণ্ডীপুরে একটি ঢিবিতে আমরা অনুসন্ধানমূলক খনন পরিচালনা করেছি। এই ঢিবিটিও দেবোত্তর সম্পত্তি এবং আমরা খনন করার প্রক্রিয়া চলাকালীন আবিষ্কার করি যে ঢিবিটি জাল দলিল করে একজন কিনে নিয়েছেন। ঢিবিটির আশেপাশে পরচায় দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে উল্লিখিত বিভিন্ন দাগের জমি ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের দোমাইলে যে-জমিটিতে আমরা একটি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংশাবশেষ শনাক্ত করেছি সেই জমিটি খাস হলেও, সেটির মালিকানা নিয়ে পাশ্ববর্তী দুই ইটভাটার মতাবান ব্যক্তির মধ্যে মামলা চলছে। আমরা আমাদের পরিচালিত জরিপে যে সব প্রতœঢিবি ও মন্দির শনাক্ত ও নথিভুক্ত করেছি সেগুলোর বেশিরভাগই আসলে দেবোত্তর সম্পত্তি, বা অর্পিত সম্পত্তি (শত্র“ সম্পত্তি) অথবা সরকারী খাস জমি।

অথচ, ইজারা বা বন্দোবস্ত নেয়ার মাধ্যমে এবং দলিল তৈরি করার মাধ্যমে এমন অগণন প্রতœস্থান দখল করা হয়েছে এবং পুরোপুরি ধ্বংশ করে দেয়া হয়েছে ও হচ্ছে। ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে নিছক উদ্বেগ বা নিন্দা জানানো কার্যকর হতে পারে না বলেই আমরা মনে করি। কারণ, জালদলিলকরণ, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা ও বন্দোবস্তের মত কানুনী প্রক্রিয়াগুলো বাংলাদেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনের ইতিহাস এবং আইন-কানুনের সমাজতত্ত্ব অনুসরণ করেই ঘটে চলেছে বলে আমরা ঠাহর করি। আমাদের বিশ্লেষণে স্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কিত আইনসমূহ ও তার ব্যাখ্যা একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক লিগ্যাসিকে বহন করে চলেছে, তেমনই সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক ধর্মাবলম্বি সম্প্রদায় ও জাতির মানুষজনার প্রতি শত্র“তামূলক হয়ে থাকছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী আইনি তরিকা বলবত ও বৈধ থাকায় এবং অর্পিত সম্পত্তি আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক বিধানব্যবস্থা কার্যকর থাকায় প্রবল, বলবান ও সংখ্যাগুরু ধর্ম ও জাতির লোকজন এই বিধিব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারছে।

পাশাপাশি, মাথাভারি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় (প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর যেটির অধিভুক্ত), ভূমি মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে জারি করা প্রতœস্থান সংরণ ও অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে কোনো বিধিব্যবস্থার অভাব প্রতœস্থানগুলো ধ্বংশেই কেবল ভূমিকা রাখছে না। এই বিধিব্যবস্থা বা বিধিব্যবস্থার অভাব এমন এক সংখ্যাগুরুর আধিপত্য ভিত্তিক বিবিধ (ধর্মীয়, সামাজিক, আইনী, ইত্যাদি) অনুশীলন ও চর্চা জারি রাখছে ও উৎপাদন করছে যা ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়নকে ক্রমাগত প্রবল ও বৈধ করে তুলছে। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে অতীত কোনো সম্প্রদায় ও সমষ্টির পরিচয় নির্মাণের সঙ্গে সতত সংলগ্ন হয়ে থাকে। প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষজনা অতীতের যে-সব নিদর্শন, স্থাপনা ও আখ্যানকে তাদের পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে বিজড়িত বলে মনে করে, সেগুলোর দখল ও ধবংশ নিপীড়নের সহিংসতাকে বিপজ্জনতভাবে ঘনীভূত করে তুলতে পারে। প্রকাশিত সংবাদে উল্লিখিত প্রশাসনের আপাতদৃষ্টিতে ‘নিরপে’ ভূমিকাও শেষাবধি প্রবল ও সংখ্যাগুরুর আধিপত্যকেই বৈধতা দিয়েছে।

একারণেই বাংলাদেশে প্রচলিত অ্যানটিকুইটি অ্যাক্টের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রতœতত্ত্ব চর্চাকে নিয়ন্ত্রণকারী ১৯৬৮ সালে প্রণীত (১৯৭২ সালে ঈষৎ সংশোধিত) এই বিধিব্যবস্থা পরিবর্তনের েেত্র আইনের সমাজতাত্ত্বিক প্রসঙ্গগুলোকে আমলে নেয়া জরুরি। একইসঙ্গে, মাথায় রাখা জরুরি যে, অধুনা উচ্চকিত হয়ে ওঠা নাগরিক উচ্চবর্গের ঐতিহ্য প্রীতিতে অনুচ্চারিত থাকলেও, ভূমি ও সম্পত্তি কেন্দ্রীক বিভিন্ন নিপীড়নমূলক আইন-কানুন ও সেগুলোর প্রয়োগকে জারি রেখে প্রতœস্থান ও ঐতিহ্য সংরণ করা বাংলাদেশে অসম্ভব। উপর্যোক্ত প্রপঞ্চগুলোর কথা বিবেচনায় রেখেই আমরা অ্যানটিকুইটি অ্যাক্টের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করারও দাবি জানাচ্ছি। --------------------------- লেখকগণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের শিক ও এমফিল গবেষণা শিার্থী আপডেট আমাদের একজনার সরেজমিন পরিদর্শন, প্রথম আলোতে প্রকাশিত ফলোআপ প্রতিবেদন এবং ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, বেদখলকৃত জমি এখনো মন্দির কতৃপক্ষ ফেরত পান নাই।

প্রশাসন আইনী জটিলতার কথা বলে সাফাই দিচ্ছেন। অন্যদিকে, মাদ্রাসা কমিটিও দিনাজপুরে সংবাদ সম্মেলনে জমিটির উপর তাদের বৈধ সত্ত্বের দাবি করেছেন। এমতাবস্থায়, ১৯৭৭-৭৮ সালে ইজারা দেয়া (যা প্রসাশনিক ভাষ্যমতে অবৈধ) জমি প্রথমে (জাল) দলিল ও নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হাত বদল হয়ে বর্তমান মালিক (হিসাবে দাবিদারের) -এর হাতে পৌছেছে। প্রসঙ্গগুলো আমাদের উপর্যুক্ত লেখার মূলবক্তব্যের আর্গুমেন্টের পাটাতন আরো মজবুত করে। মহাস্থানেও প্রত্নস্থান ও প্রত্নঢিবি বিশষ্ট অসংখ্য জমি একই প্রক্রিয়ায় দখল হয়েছে।

সরকারী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আদালতে মামলা করেও আইনী প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে এবং কানুনী স্ববিরোধিতার কারণে অনেকগুলো মামলায় হেরেছেন। পাশাপাশি, প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ করা দরকার যে, ঢাকা কেন্দ্রীক ইদানিং যে ঐতিহ্য প্রেমে মাতোয়ারা নাগরিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেখানে কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি আইনের সঙ্গে প্রত্নস্থান সংরক্ষণের গুরুতর বিরোধের বিষয়টি অনুচ্চারিত থাকছে। এই নিরবতাও পাঠের দাবি রাখে বলে আমি মনে করি। সেই পাঠ কেমন হতে পারে তা নিয়ে পরবর্তী পোস্টে আলাপ করার ইরাদা রাখি।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।