আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অশ্লীল সাহিত্য থেকে নীলছবি; পর্নোগ্রাফির বিবর্তন, শেষ পর্ব

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

আগের পর্ব: Click This Link স্বাধীন নারী? লিন্ডা মারচিয়ানো অভিনীত ডিপ থ্রোট (১৯৭২) ছবি নিয়ে কয়েক দশক আগে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। ছবিটির প্রচার এভাবে হয়েছিল যে এখানে একজন নারীকে তার যৌনতার ক্ষেত্রে স্বাধীন ভূমিকায় দেখা গেছে। যে লিন্ডা লাভলেস (ছবিতে এই নাম ছিল) একজন স্বাধীন নারী, যার ভগাঙ্কুর যোনীতে নয়, জিহ্বার গভীরে অবস্থিত -- সে মৌখিক সঙ্গম বা ওরাল সেক্সে যৌনসুখ পায়। যৌনসুখ বিষয়ে তার এই নিজস্ব পছন্দ তাকে একজন স্বাধীন নারী হিসেবে প্রতিপন্ন করে। পুরুষরা তাদের বান্ধবী বা স্ত্রীদের নিয়ে দলে দলে এই ছবি দেখতে যায় এই মনে করে যে লিন্ডার 'যৌনস্বাধীনতা' তাদের সঙ্গিনীরা পছন্দ করবে।

কিন্তু বাস্তবের লিন্ডা ও পর্দার লিন্ডার (দুজনেরই একই নাম) এই স্বাধীনতা কীভাবে এসেছে? ম্যাককিনন (১৯৮৭) বলছেন, এক্ষেত্রে লিন্ডার 'যৌনস্বাধীনতা' এসেছিল তার ওপরে করা নির্যাতন, মৃত্যুহুমকি ও ধর্ষণের বরাতে। তার তৎকালীন স্বামী ও পর্নোগ্রাফার-প্রযোজক চাক ট্রেইনরই ছিলেন এসবের হোতা। প্রায়ই তাকে পিস্তলের মুখে এসব করতে হয়েছে, কিন্তু পর্দায় দেখা গেছে সতেজ ও যৌনস্বাধীন একজন লিন্ডাকে। যৌনস্বাধীনতার বিষয়টি তার ব্যক্তিজীবনের নিজপছন্দের বিষয় ছিলনা। এটি ছিল গতানুগতিক অভিনয়মাত্র।

কিন্তু মিথ্যাপ্রচারের জোরে ছবিটি দেদার ব্যবসা করে। পর্নোগ্রাফি নারীকে একটি ভূমিকা দেয়: তোমার পুরুষটির সঙ্গে যৌনকর্ম কর, তোমার ব্যথা লাগুক বা শারীরিক ক্ষতি হোক, যেভাবে সে চায় তাকে সেভাবেই দাও; আঘাত পেলে হাসো এবং বলো যে তোমার ব্যথা লাগছে না, আর সবচেয়ে ভালো এসব কিছুই বলো না। পরিবর্তে সে যা বলে তাই কর, দায়িত্বশীল বান্ধবী বা প্রেমময় স্ত্রীর মতো। লিন্ডার কেসটির সূত্রে মেরেডিথ এ ম্যাডেন বলেন, খেলাটা হলো ভানের। ভাবো, তুমি একটা পুতুল।

সুতোটা দিয়ে কেউ একজন তোমাকে নিয়ে খেলছে, তুমি বন্দি, তুমি ব্যথাতুর, এবং তোমার কিছুই করার নেই। কেবল হাসো এবং অভিনয় করো, যে তুমি তৃপ্তি পাচ্ছো (ম্যাডেন, ২০০১)। ডিপ থ্রোট-এর মতো ছবি বা হাসলার-এর মতো ম্যাগাজিনের মাধ্যমে নারীর জন্য কিছু ভুয়া প্রত্যাশা স্থাপন করা হচ্ছে। কিছু নারী এসব প্রত্যাশা সহজেই গ্রহণ করে, বাকিরা করেনা। কোনো কোনো নারী এই ব্যথাদীর্ণ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই যৌনতুষ্টি পেয়ে থাকেন; আর বাকিরা সঙ্গমশেষে, 'অবেশেষে মুক্তি পেলাম' বলে হাঁফ ছাড়ে।

ইতোপূর্বে আলোচিত 'ইরোটিক থ্রিলার' ধারার ছবিগুলোতে নারীর ভূমিকা ও ক্ষমতা পর্নোগ্রাফির অক্রিয় নারীদের চাইতে অনেক বেশি থাকে। হলিউড-উদ্ভাবিত এই ছবিগুলোতে নারীর, সুজান হেওয়ার্ডের (২০০৬) মতে, যেন একধরনের এজেন্সি থাকে। সে ক্ষমতাধর, তার ব্যক্তিত্ব ও যৌনক্ষমতার সুবাদে। ফাইনাল এনালাইসিস (১৯৯২), বডি অব এভিডেন্স (১৯৯৩), বেসিক ইন্সটিঙ্কট (১৯৯৩) এধরনের কয়েকটি ছবি। নারীকে ক্ষমতাপ্রদান করা হয় যাতে সে বদলা নিতে পারে, এমনকি খুন করতে পারে -- কিন্তু এটাও শেষপর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক ফ্যান্টাসি।

এসব ছবিতে শেষপর্যন্ত পুরুষই জয়লাভ করে। সুজান হেওয়ার্ড বলছেন, এজেন্সিপ্রদান মানেই এজেন্সি থাকা নয় (হেওয়ার্ড, ২০০৬: ২৯১)। পর্নোগ্রাফিতে অভিনয়ের মাধ্যমে অনেক নারী পর্নোস্টারের মর্যাদা পেয়ে যান। পশ্চিমা অভিজ্ঞতায় অনেক নারী স্বেচ্ছায় এধরনের পেশা বেছে নেন। নারীঅধিকারের দৃষ্টিতে এও নারীর একধরনের অগ্রগতি, কারণ এই পেশা তাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দেয়।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জেসমিন বর্তমানে আমেরিকায় একজন পর্নোস্টারের মর্যাদা উপভোগ করেছন। তবে এই স্বাধীনতা হয়তো এতটা সরলরৈখিক হিসেবের বিষয় নয়। হয়তো ডিপ থ্রোট-এর লিন্ডার মতোই বাধ্য হয়ে এপথে এসেছে একজন পর্নো-অভিনেত্রী। পারিবারিক দৈন্য বা দায়িত্ব, শিক্ষাগত অযোগ্যতা তাকে আরও ভালো কোনো পেশার পরিবর্তে এধরনের পেশায় আসতে বাধ্য করে। আর এক্ষেত্রে তার একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে তার উন্মোচিত যৌনাঙ্গসমূহ, যা তার নিজস্ব অর্জন নয়, প্রকৃতির গড়ে দেয়া সম্পদমাত্র।

আর এই নারীদেহকে পুঁজি করে বিরাট ব্যবসা ফেঁদেছেন পুরুষ-ব্যবসায়ীরা। ম্যাককিননের (১৯৮৯) মতো তাত্ত্বিকেরা পর্নোগ্রাফির অর্থনৈতিক দিকটিকেও সামনে এনেছেন এবং বলছেন যে এখানে 'নারীপাচার'-এর মাধ্যমে পুরুষরা ব্যবসায়িক মুনাফা করছে। আমেরিকা এবং পশ্চিমা অন্যান্য দেশে বিলিয়ন ডলারের যে পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি, তার কাঁচামাল হলো নারীদেহ। ম্যাককিনন বলছেন: সাম্প্রতিক শিল্পসমাজে পর্নোগ্রাফি হলো একটি শিল্প, যেখানে নারী ব্যবহৃত হচ্ছে যৌনক্ষেত্র হিসেবে এবং পুরুষকর্তৃক, পুরুষের মুনাফার জন্য। এখানে যৌন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে মুনাফার জন্য।

পর্নোগ্রাফি নারীকে পুরুষের প্রয়োজনীয় যৌনবস্তু হিসেবে বিক্রি করছে। এ হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীপাচার (ম্যাককিনন, ১৯৮৯: ১৯৫)। পুরুষ ওপরে: যৌনতাসম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা বৈষম্যের যৌনকরণের এই প্রকল্পের মাধ্যমে নারী সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেয়া হয়, তাদের যৌনতা ও যৌনানন্দের মাত্রা সম্পর্কেও ভুল তথ্য প্রদান করা হয়ে থাকে। দোরকিন এপ্রসেঙ্গ বলেন, পর্নোগ্রাফি বলে নারী বিক্ষত, ধর্ষিত, মর্দিত হতে চায়; ... সে পীড়িত হতে চায়, সে ব্যাথা পেতে চায় (দোরকিন, ১৯৯৩: ২০৩)। পর্নোগ্রাফি পুরুষকে তার গায়ের জোরের বরাতে এভাবে একটি বিপজ্জনক ভূমিকায় অবর্তীণ করে এবং যৌনতার একটি ভুল মান নির্ধারণ করে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো নারী সবসময়, সঙ্গমকালে এভাবে উৎপীড়িত বা বিক্ষত হতে চায়না। পুরুষ ওপরে, নারী নিচে; পুরুষ উৎপীড়ক, নারী (সোৎসাহে) উৎপীড়িত -- পর্নোগ্রাফি এরকম কিছু ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয়। অথচ যৌনপুলকের জন্য অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমান সক্রিয়তা (ওপর-নিচ সমান অংশগ্রহণ) দরকারি। পুরুষ নারীর চাইতে সবদিক থেকে অগ্রগামী, তাই নারীর ওপরে তার প্রাধান্য জৈবিক ও স্বাভাবিক -- সমাজের এই ধারণাকে যৌনতার মাধ্যমে পুনঃদৃঢ় করে পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্রের একটি সাধারণ সমাপ্তি হয় এভাবে যে, দণ্ডায়ামান পুরুষ বীর্যের স্খলন, বসা বা শায়িত নারীর মুখমণ্ডলে বা শরীরের অন্য কোনো স্থলে ঘটাচ্ছে।

এইখানে এসে নারীর মর্যাদার চরম অবমূল্যায়ন ঘটে, যে সে বা তার শরীর পুরুষের বর্জ্য নিক্ষেপের স্থল। এইখানে 'দণ্ডায়মান' পুরুষ সবিশেষে নিশ্চিতভাবে বোঝাতে সক্ষম হয় যে 'নিচের' নারীটি তার অধীন। আর বর্জ্যনিক্ষেপের মাধ্যমে এটাও নিশ্চিত করা হয় যে নারী এখানে মোটেও নারী নয় -- সে বেশ্যা, নোংরা মেয়েমানুষ। ম্যাককিনন বলছেন, পর্নোগ্রাফি এই বৈষম্যের (পুরুষ ওপরে, নারী নিচে) ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এটা ছাড়া পুরুষের নারীর ওপরে পীড়ন ও দমন ষোলকলা পূর্ণতা পায়না।

বৈষম্য ছাড়া পুরুষের কামভাব জাগ্রত হয়না (ম্যাককিনন, ১৯৮৯: ২১১)। পর্নোগ্রাফি কেবল এই বৈষম্যকে রূপায়িতই করেনা, তা জেন্ডারসম্পর্কের প্রেক্ষাপটে আনন্দদায়করূপে হাজির করে এবং এটাই স্বাভাবিক বলে প্রতিষ্ঠা করে। প্রয়োজন যৌনতাসম্পর্কে নারীর দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্তি পর্নোগ্রাফিতে নারীশরীরের যথেচ্ছ ব্যবহার তার শরীরকে যেমন অপমান করে, তেমনি তার আত্মমর্যাদাকে তলায় নামিয়ে আনে -- যে সে মানুষ নয়, স্তন-যোনীসমেত একতাল মাংসপিণ্ড। এই অবমাননা থেকে রক্ষা পাবার একটা উপায় হতে পারে যে পর্নোগ্রাফির উৎপাদন-বিপণন-প্রদর্শন বন্ধের জন্য আওয়াজ তোলা। কিন্তু সেটা সম্ভবত খুব বাস্তবানুগ কোনো কর্মসূচি হবেনা।

কারণ সমাজে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, পুঁজিতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে এর ব্যবসায়িক বৈধতাও রয়েছে। বরং পর্নোগ্রাফিতে নারী-পুরুষের যৌনতাসম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণার প্রদর্শন কমিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ করা যেতে পারে। আর যৌনতাকে নারী কীভাবে দেখে, পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে নারীর কী দৃষ্টিভঙ্গি বা কী সাড়া, পর্নোগ্রাফিক টেক্সটে তা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তবে বিকৃতকামের বিষয়গুলোকে (শিশু পর্নোগ্রাফি) প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের দৃষ্টিতেই মোকাবেলা করা দরকার। তথ্যসূত্র দোরকিন, আন্দ্রিয়া (২০০৩), Pornography, The Feminism and Visual Culture Reader, Routledge. London. হেওয়ার্ড, সুজান (২০০৬), Pornography, Cinema Studies: The Key Concepts (3rd edn), Routledge, London. স্টার্ন, লেসলি (১৯৯২), 'The Body is Evidence', The Sexual Subject: A Screen Reader in Sexuality, Screen-Routledge; London. হল, স্টুয়ার্ট (১৯৯৭), The Work of Representation, Representation: Cultural Representation and Signifying Practices, Stuart Hall ed., Sage, London. কিপনিস, লরা (১৯৯৮), 'Pornography', The Oxford Guide to Film Studies, John Hill and Pamela Church Gibson eds., Oxford University Press, Oxford. বেক, মারিয়ানা (২০০৩), Click This Link ম্যাককিনন, ক্যাথরিন এ. (১৯৮৭), Feminism Unmodified, Harvard University Press, Cambridge. ম্যাককিনন, ক্যাথরিন এ. (১৯৮৯), Toward a Feminist Theory of State, Harvard University Press, Cambridge. দোরকিন, আন্দ্রিয়া (১৯৮১), Pornography: Men Possessing Women, The Women’s Press, London. দোরকিন, আন্দ্রিয়া (১৯৯৩), Letters From A War Zone, Lawrence Hill Books, Brooklyn. ম্যাডেন, মেরেডিথ এ. (১৯৯২), 'Pornography: The Epitome of Sexuality', http://www.gwu.edu/~medusa/2001/porn.html. [সমাপ্ত] চিত্র: 'ডিপ থ্রোট' (১৯৭২) ছবির পোস্টার।

প্রথম প্রকাশ: রবিউল করিম সম্পাদিত 'ব্যাস'-৮, বইমেলা ২০০৯।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.