আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রণবের যাতা দেবার অস্ত্র বাউচার



ভারতের পররাষ্ট্রনীতিমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে আসছেন। রিচার্ড বাউচারও ঢাকায় আসছেন। উভয়ের সফর ঠিক একদিন ঢাকায় ওভারল্যাপ করছে । সাধারণত একই সময়ে দুটো হেভিওয়েট কুটনৈতিক ভিজিট ঘটানো হয় না ব্যবহারিক কারণে যদি না কোন বিশেষ কারণ থাকে। সাধারণভাবে ব্যবহারিক কারণটা হয়, একটা বিদেশী মন্ত্রী পর্যায়ের সফর মানে ওখানে সরকারের পজিশন কি হবে তা ঠিক করা থেকে শুরু করে ইস্যু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সাথে বসে পেপার তৈরি করা, প্রটোকল ইত্যাদি মিলিয়ে প্রচুর পূর্বপ্রস্তুতি সময় ও কাজের দরকার হয়।

বিশেষত ওখানে কোন চুক্তি সইয়ের বিষয় থাকলে তা কাজ আরও বাড়িয়ে তুলে কারণ ওধরণের কাজের মান, গুরুত্ত্ব ও মনোযোগী সময় নিবিড়তা দাবি করে। তাই বিশেষ কারণ না থাকলে একই সময়ে বা দিনে একের অধিক ভিজিটরের সফরের মুখোমুখি করানো হয় না। কাজেই আমরা মনে করতে পারি, কোন বিশেষ কারণ এক্ষেত্রে আছে বা ঘটেছে। প্রণব মুখার্জি কি আলোচনার সময় Assistant Secretary of State for South and Central Asian Affairs রিচার্ড বাউচারকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লিভারেজ হিসাবে যাতা দেবার কাজে নগদানগদ ব্যবহার করতে চায়? কারণ আমরা ইতোপূর্বে আমেরিকান Under Secretary of State for Political Affairs নিকোলাস বার্নসের মুখে শুনেছি, বাংলাদেশে আমেরিকার স্বার্থ তারা ভারতের চোখ দিয়ে মিলিয়ে দেখবে। ভারতের সাথে আমেরিকান সম্পর্কের নতুন পর্যায় শুরু করতে নিকোলাস বার্নস খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

আমেরিকান স্বার্থ বুঝে নেয়া, কী কী আন্ডারস্টান্ডিং বা বুঝাবুঝির ভিত্তিতে এই সম্পর্ক হচ্ছে তা আমেরিকার দিক থেকে নির্মাণের কারিগর বার্নস। আমেরিকান রাষ্ট্রনীতির দিক থেকে তাঁর পদসহ তাঁকে তিন নম্বর গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করা হত (হত বলছি কারণ গত বছর তিনি অবসরে গেছেন)। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি অফ স্টেট (আমাদের হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এর পরেই আন্ডার সেক্রেটারি অফ ষ্টেট (আমাদের হিসাবে পররাষ্ট্র সচিব) এর স্হান। আমেরিকা রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে ঝামেলা ও বিপদে আছে এর চরিত্র গ্লোবাল। ভারতের যেসব স্হানীয় "সন্ত্রাসবাদী" ঝামেলা ও বিপদে আছে তার মূল চরিত্র স্হানীয়, কাশ্মীর বা পাকিস্তান বিষয়ক।

তবে ভারতের নিরাপত্তা নীতির কারণে সে আমেরিকার কোলে বসে নিজের সমস্যা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবং ক্রমশ নিজেকে হামলার শিকার ও লক্ষ্যবস্তু বানানোর বিপদের ঝুকি নিচ্ছে। অথচ তাঁরা কথা বলতে বসেছিল এশীয় আঞ্চলিক কৌশলগত পরস্পরের সব স্বার্থ নিয়ে। ডঃ ওয়াল্টার এন্ডারসন, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এসোসিয়েট ডিরেক্টর। আমেরিকান সিনেটের হাউস কমিটিতে আমেরিকা ও ভারতের নতুন সম্পর্ক নিয়ে ২০০৮ জুনে সাক্ষ্য দিয়ে (testimony) লিখিতভাবে যা বলেছিলেন সেখান থেকে কিছু অংশ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লিভারেজ হিসাবে আমেরিকাকে ভারতের ব্যবহারের বিষয়টা এখানে পাঠকের সাথে শেয়ার করব।

একটু পিছন থেকে শুরু করব। ভারত আমেরিকার স্বার্থ কেন জরুরী হয়ে উঠল তা বর্ণনা করতে গিয়ে এন্ডারসন বলছেন, এর কারণ "ভারতের সাম্প্রতিককালের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও তাতে আমেরিকার সংশ্লিষ্টতা"। এরপর আরও বলছেন, "তবে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ার তোলার তাগিদটার ভিত্তি হবে - যেসব ইস্যুতে উভয়েরই স্বার্থ মিল খাবে, ধর্ম-অনুপ্রাণিত র‌্যাডিক্যাল কাজকারবারকে মোকাবিলা করা, চীনের উত্থানকে একসাথে সামলানো (মোকাবিলা বা বন্ধ করা নয়), আফগানিস্তানে তালেবানদের পরাজিত করা, দক্ষিণ এশীয়ার নিজেদের পক্ষে স্হিতিশীলতার লক্ষ্যে কাজ করা" ইত্যাদি। ঠান্ডা যুদ্ধের কাল শেষে চার দশক পর পারস্পরিক সন্দেহের উর্ধে উঠে ভারত-আমেরিকা একটা সম্পর্ক গড়তে যাচ্ছে। বলছেন, "ভারতের দৃষ্টিতে তার পরাশক্তি হয়ে উঠার খায়েসের দিক থেকে আমেরিকা একটা এ্যাসেট, দামি জিনিষ।

আমেরিকাও তার দিক থেকে ভারতকে একটা ধেয়ে আসা বাড়ন্ত শক্তি হিসাবে যা বিশ্ব জনসংখ্যার দিক থেকে ও দ্রুত প্রবৃদ্ধির দিক থেকেও দ্বিতীয়"। বুশ এসম্পর্ককে দেখেছেন, "স্বভাবগত সঙ্গী' (Natural Partner) হিসাবে, প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি দেখেছিলেন, কৌশলগত বন্ধু "স্ট্রাটেজিক এ্যালি" (strategic ally) হিসাবে আর মনমোহন দেখেছেন, এ এমন এক সম্পর্ক যার "কোন সীমা নাই" (no limit)। কিন্তু এরপরেও এন্ডারসন বলছেন, ভারত ও আমেরিকা প্রচলিত অর্থে ally নয় ও অদূর ভবিষ্যতে হবে এমন সম্ভাবনা নাই। কারণ হিসাবে প্রথমত তিনি উল্লেখ করছেন, "এদের মাঝে যুদ্ধ ও অস্ত্র সরবরাহ সংক্রান্ত কোন mutual assistance agreement & basing right নাই"। যেকোন দেশের যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ পাওয়া বিষয়টা কোন জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রে একটা অন্যতম উপাদান।

যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ দেশের সরবরাহের ক্ষেত্রে বহুবিধ শর্ত দিয়ে থাকে। যেমন এই অস্ত্র তৃতীয় কাউকে দেয়া যাবে না, তৃতীয় (যেমন রাশিয়ান) কোথাও কোন অস্ত্রের সাথে ব্যবহার করা যাবে না, অস্ত্রের সাথে যন্ত্রাংশ কীভাবে সরবরাহ হবে, না কী নিজের দেশেও কিছু বানানো যাবে অথবা যৌথ উদ্যোগে বানানো হবে, সরাসরি গিয়ে সরবরাহকারী দেশ মজুদ বা সমস্যা দেখতে পারবে কী না, সাধারণত একদেশের অস্ত্র অন্যদেশ থেকে পাওয়া অস্ত্রের সাথে ব্যবহার (interoperability) করা যায় না, ইত্যাদি নানাবিধ কারণে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের আগে সরবরাহকারীর সাথে নানান চুক্তিতে উপনীত না হলে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করা হয় না। ভারত ও আমেরিকার মাঝে এধরণের চুক্তির ঘাটতি আছে। এবং অদূর ভবিষ্যতে তা মিটে যাবে এমন সম্ভাবনাও নাই। কিন্তু তাতে কী! ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের ধরণটা এমনই যে, ভারত সম্পর্কটাকে strategic autonomy হিসাবে রাখতে চায়, হাত-পা বাধা পড়তে চায় না।

পারস্পরিক স্বার্থ অবশ্যই কৌশলগত, কিন্তু বন্ধুত্ত্ব বা ally এর নামে হাত-পা বাধা বা নির্ভরশীল হয়ে পড়া নয়। বরং একটা autonomy বা স্বাধীন সত্ত্বার সম্পর্ক করতে চায় ভারত। এজন্য এন্ডারন বলছেন, এটা বন্ধুত্ত্ব বা ally সম্পর্ক নয়। বলছেন এটা, বৃটেন বা জাপানের মত সম্পর্কের ছাঁচে পড়ে না, বা ফ্রান্সের মতও নয় যার মধ্যে, আনুষ্ঠানিক কৌশলগত বন্ধুত্ত্বের সম্পর্কের সীমার মধ্যেও ব্যবহারিক প্রয়োজনগত স্বাধীনতা খোঁজা হয়েছে (seeking tactical independence within the framework of a formal alliance)। তাই তিনি বলছেন ভারতের দাবি, এটা তখনই কাজ করবে যদি মেনে নেয়া হয় - ভারত আমেরিকার সমান অংশীদার (treated as an equal partner) ও ভারতের নিজের সরাসরি স্বার্থ যেখানে সংশ্লিষ্ট কেবল সেখানেই সে আমেরিকার সাথে সহযোগী হয়ে কাজ করবে।

এই কথাগুলো এত পরিস্কার করে ভারতের বলার দরকার পড়ছে চীনের কথা মাথায় রেখে বিবেচনা করে; যাতে আমেরিকার চীন-বিরোধী কোন খায়েস থাকলে ভারতকে তাতে বন্ধু হিসাবে পাবার কথা না ভাবে, ভারত তার সাতে-পাঁচে নাই, থাকতে চায় না। চীনের কথা প্রসঙ্গে এন্ডারসন বলছেন, ভারত ও আমেরিকা একমত হয়েছে যে, এশিয়ায় কোন একক শক্তির খবরদারি করা উচিত হবে না। তবে ভারত চীন-বিরোধী কোন জোটও সমর্থন করবে না বরং এশিয়ার কোন একক শক্তির খবরদারিবিহীন পরিস্হিতির ভিতরে চীনকেও জায়গা করে দেয়া যায় কী না, তাই ভেবে দেখতে চায়। সোজা কথায় চীনের সাথে কোন যুদ্ধ বিরোধে জড়িয়ে ভারত নিজের কপাল পোড়াতে চায় না, পাশপাশি আবার নিজেকে একটা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরাশক্তি হবার খায়েসে আমেরিকার সাহায্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরকম অবস্হা চাইবার পক্ষে আর এক কারণ হলো, সে জানে জ্বালানি আমদানি খুঁজে বেড়াতে চীনের সাথে তার যে প্রতিযোগিতা আছে তা সহসা শেষ হচ্ছে না।

ফলে সে আমেরিকার জন্য অস্বষ্তিকর হলেও ইরান ও মায়ানমারের সাথে জ্বালানি তেল গ্যাসের জন্য সম্পর্ক রাখবে - এটাই আমেরিকার কাছে পরিস্কার করে রাখতে চায়। অনেকে ধারণা করেন, নিউক্লিয়ার অস্ত্রবিস্তার চুক্তিতে সই না করা ভারতের সাথে নিউক্লিয়ার জ্বালানি সহযোগিতাই বোধহয় ভারত আমেরিকার সম্পর্কের মূল দহরম-মহরমের জায়গা। এটা একেবারেই সত্যি নয়। উপরের আলোচনায় আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতের এতকিছু চিন্তা ও শর্ত সত্ত্বেও আমেরিকার কাছে এই সম্পর্ক গুরুত্ত্বপূর্ণ।

সে এই সম্পর্ক করতে চাই এবং মরিয়া। এন্ডারসনের বরাতে আমার সারসংক্ষেপ - এর কারণ হলো, ১. অর্থনৈতিকভাবে চীন ও ভারতের উত্থান হওয়ার মানে এশিয়া বুড়ো আমেরিকার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া। ২. এরচেয়ে ভারতের সাথে অর্থনৈতিক পার্টনারের সম্পর্কে হলেও একটা ভাগের অংশ পাবার সম্ভাবনা আছে। এটা ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে কী চেহারা নিয়ে দাঁড়ায় সেটার আশা সে ছেড়ে দেয়নি। যদিও ভারত আগেই বলে কয়ে নিচ্ছে, চীনের বিরুদ্ধে লড়বার তার খায়েস নাই।

বড়জোড় চীনের সাথে এশিয়ায় খবরদারি শেয়ার করতে পারলেই সে খুশি। ৩. আসলে উঠতি ভারতীয় অর্থনীতিতে নিজের ভাগের লোভই আমেরিকাকে সবদিক থেকে মরিয়া করে তুলছে। সবকিছুর উপরে এই কারণটাই আমেরিকাকে তাড়িত করছে সবচেয়ে বেশি। পাঠক, ভারত আমেরিকার সম্পর্কের মাত্রা, এর বিস্তারিত কোনাকাঞ্চি বর্ণনা করা আমার উদ্দ্যেশ্য না হলেও এতক্ষণ আপনাদের তাতেই ব্যস্ত রেখেছি। এতে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হবার বা আমাদের রাষ্ট্র স্বার্থ কী - সে প্রসঙ্গটা বুঝার জন্য ভারত আমেরিকার সম্পর্কের মাত্রা, এর বিস্তারিত কোনাকাঞ্চি - এই পটভূমিটা মনে রাখা ও বুঝা জরুরী।

পাঠকের এই পটভূমিটা জানা থাকলে আমার এরপরের কথা বুঝতে সুবিধা হবে। একটা পরিস্হিতিতে ভারত আমেরিকার সম্পর্ক হয়েছে, হানিমুনের যাবার জন্যও তারা পরস্পর রেডি। হানিমুনে যাবার ঠিক আগের মুহুর্তে প্রেয়সী যে কোন আবদার রক্ষা করা প্রেমিক কাছে যেমন কোন ব্যাপার মনে হয় না, প্রেয়সীও যেমন মনে করে কোন কিছু আদায় করে নেবার এটাই বেষ্ট সময় ও সুযোগ - ঠিক সেভাবে ভারত তার নিরাপত্তা নীতির বাস্তবায়নে যা নিজের ক্ষমতায় কুলায় না তাতে আমেরিকান ক্ষমতা যাতা (leverage) দিয়ে তাকে সহযোগিতা করবে - ভারত আমেরিকাকে একথা কবুল করিয়ে নেয়। এটাই আমরা নিকোলাস বার্নসের মুখে শুনেছিলাম, বাংলাদেশে আমেরিকার স্বার্থ তারা ভারতের চোখ দিয়ে মিলিয়ে দেখবে। ২০০৭ এর মে মাসে এই সংক্রান্ত এক গোলটেবিল আলোচনারও উদ্যোক্তা ছিল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন।

এন্ডারসন লিখছেন, An indian security policy of hedging which requires a US element to be effective and thus gives the US some leverage power with India. ভারতের সাথে বুঝাবুঝির আলোচনাগুলো চলার সময় ভারত বার্নসকে একথাই রাজি করাতে সক্ষম হয়। ফলে বার্নস এবার আরও আগ বাড়িয়ে বলছেন যে, দক্ষিণ এশিয়া ষ্টাটেজিতে, Bangladesh is a pivotal country in South Asia, its future is important to the entire region. আবার একথায় আমাদের এটা ভাবার কারণ নেই যে এর মানে তাদের ভাষায় বাংলাদেশে "সন্ত্রাসবাদে" ভরে গেছে বলে বুঝে তাঁরা একথা বলছেন। এটা বলছে, নিজ নিজ যুদ্ধকৌশলগত ষ্ট্রটেজিক স্বার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশকে তারা উভয়ে কীভাবে ব্যবহার করতে পারে - তাদের সেই সুযোগ ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা থেকে এটা তাদের ভাবনা। কাজেই এবারের ঢাকা সফরে দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্সের আওয়াজ তুলে বাউচারকে লিভারেজ হিসাবে ব্যবহারের একটা ঘটনা কী প্রণব ঘটাতে যাচ্ছেন? আমরা অনুমান করতে পারি। এখন এতে তাদের যুদ্ধ ও শত্রু আমরা কেন দাওয়াত দিয়ে আনব আর, তাদের যুদ্ধ ও শত্রুকে আমাদের যুদ্ধ ও শত্রু বানাব কেন? খাল কেটে কুমির আনব কেন? তাদের যুদ্ধ আমরা কেন কাঁন্ধে নিয়ে হাঁটব, এতে আমরা মরব না বাঁচব, এতে আমাদের স্বার্থ কী সেটা কী আমদের স্বার্থ দিয়ে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারব? তাদের যুদ্ধের pivotal country বা ভারকেন্দ্রের দেশ বানানোর পায়তাঁরা থেকেই দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্সের আওয়াজ তোলা হয়েছে।

আমাদের সরকারও ক্ষমতার লোভে একথা কবুল করে ইলেকশন মেনিফেষ্টোতে লিখে ফেলেছে। দাবি করা হচ্ছে, আমাদের দেশে ভীষণ "সন্ত্রাসবাদী" কাজকারবার আছে, চলছে। আমাদের রাষ্ট্র স্বার্থের কথাও বাদ থাক। আমেরিকার নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ার যেসব থিঙ্কট্যাঙ্ক জড়িত তারাই এখন বলছে, বাংলাদেশে চরমপন্থা প্রবণতা খুবই কম। অর্থাৎ যারা আমাদের দেশে ভীষণ "সন্ত্রাসবাদী" কাজকারবার আছে, চলছে বলে প্রচার চালাচ্ছে, দাবি করছে, দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্সের আওয়াজ তুলছে একথা কিন্তু থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে করে না।

ওয়াসিংটনভিত্তিক খ্য্যতনামা থিঙ্কট্যাঙ্ক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সিনিয়ার রিসার্চ ফেলো লিসা কার্টিস বলছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রথম মুসলিম দেশ সফর হিসাবে বাংলাদেশকে বেছে নিতে। যুক্তি হিসাবে যা তিনি বলছেন এটা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। বলছেন, "বাংলাদেশের সমাজে চরমপন্হী প্রবণতা খুবই কম। নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশে চরমপন্থা বিস্তারে একটি প্রবল বাঁধা হিসাবে কাজ করছে"। এই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত এম হুমায়ুন কবীরও উপস্হিত ছিলেন ও বক্তব্য রাখেন।

হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়, A conservative right wing think tank promoting public policy research। বুশের WMD বা যুদ্ধে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের খোঁজে ইরাক আক্রমণে কেন যাওয়া উচিত এর পক্ষে ২০০৩ সালে নিয়মিত CNN এর 'বিদ্বান' হিসাবে এরাই নানান যুক্তি হাজির করে কথা বলে গিয়েছিল। প্রায় সময়ে CNN এ দেখা গেছে, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের 'বিদ্বান', 'এক্সপার্টরা' প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ইসরায়েলের পক্ষে দাড়িয়ে যুক্তি হাজির করছে। কেন আমেরিকান নীতি এই ইস্যুতে একচোখা তার ন্যায্যতা দিয়েছে। উপরে নিকোলাস বার্নসের "আমেরিকার স্বার্থ তারা ভারতের চোখ দিয়ে মিলিয়ে দেখবে" একথা হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের বিদ্বান এক্সপার্টদের প্ররোচনাতেই তাদেরই আলোচনা সভায় বার্নসের মন্তব্য।

আমেরিকান নীতি, ভাবনা জানাবুঝার ক্ষেত্রে এরকম আরও থিঙ্কট্যাঙ্কের সাথে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের http://www.heritage.org/ সম্পর্কেও পাঠক খোঁজখবর রাখতে পারেন। বাংলাদেশেও ওয়ালিয়র রহমানের নেতৃত্ত্বে হেরিটেজ ফাউন্ডেশন নামে দোকান আছে। জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের দূর্ভাগ্য হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিজ স্বার্থ দেখে এমন কোন থিঙ্কট্যাঙ্ক নাই। যা আছে এগুলো আমেরিকান রাষ্ট্র নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ার যেসব থিঙ্কট্যাঙ্ক আছে এরই বাংলাদেশ শাখা। বাংলাদেশে আমেরিকান রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখা পরামর্শ দেয়া বা আমেরিকান নীতির পক্ষে বাংলাদেশে মতামত খাঁড়া করাই এদের কাজ।

এমনকি শাখা দোকানের নামের দিকে লক্ষ্য করুন, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট ইত্যাদি। অনেকে অবশ্য এরকম নাম না নিয়েই একই কাজ করছে। এধরণের কাজে তাদের কোন বিকারও নাই। মজার কথা হলো, আমাদের দেশে ভীষণ "সন্ত্রাসবাদী" কাজকারবার আছে, চলছে - মুখে একথা বললেও আমাদের বাংলাদেশের 'সুশীল সমাজ" বা তাদের মুখপাত্রও এটা বিশ্বাস করে না। সম্প্রতি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে মুম্বাই বোমা হামলায় বাংলাদেশের অন্তত একজন (হুজি সংশ্লিষ্ট কথিত) জড়িত।

ডন দাবি করছে, পাকিস্তান সরকার নিজস্ব যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে যাচ্ছে তাতে নাকি একথা আছে। এই ঘটনাটা আমি পাঠকের কাছে তুলে ধরার কারণটা অন্য খানে। 'সুশীল সমাজ" এর মুখপাত্র প্রথম আলো এই রিপোর্টকে কীভাবে ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে - সেদিকে। শিরোনামে করেছে, "বাংলাদেশের ঘাড়ে মুম্বাই হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তান"। এরপর রিপোর্টে বলছে, "ভারতের কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, বিশেষ উদ্দেশ্যে পাকিস্তান হামলার সঙ্গেবাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা করছে।

৯ ফেব্রুয়ারী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে যাবেন। এ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে সন্ত্রাস দমন ও বাণিজ্য খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে। পাকিস্তান চাইছে, হামলার সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার কথা বললে ভারত ও আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ পাকিস্তানের উপর থেকে অন্যদিকে ঘুরে যাবে"। রিপোর্টের কথা ও অনুমান আমাদের সত্যি বলে গ্রহণ করার কারণ আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই মন্তব্যের ভিতর দিয়ে ও তা প্রথম আলোর ট্রিটমেন্টে প্রকাশিত হয়ে আর এক সত্যি উন্মোচিত হয়ে গেছে।

ভারতের কূটনৈতিক মহল ও আমাদের সুশীলরা কখন মনের কথা বলে বসেছেন খেয়াল করেননি। ভারতের কূটনৈতিক মহল ও আমাদের সুশীলরা তার মানে বলছেন, ১. সমস্যা ভারতের এবং পাকিস্তান তা সৃষ্টি করেছে। ২. তাঁরা প্রকান্তরে নিশ্চিত করছে বাংলাদেশের হুজি একাজ করেনি। হুজি সম্পর্ক এরা পুরা ওয়াকিবহাল। এরা কোথায় কী কাজ করছে, কতটুকু করতে পারে সব তারা জানে।

নইলে পাকিস্তানের করা কথিত হুজি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বাংলাদেশ নয়, ভারতের কূটনৈতিক মহল ও আমাদের সুশীলরা কেন নাকচ করছে? বাস্তবেও তাই, বাংলাদেশ বর্তমান রাষ্ট্র একাই এদেরকে এমনভাবে দমন করতে পেরেছে যে হুজি একাজ করতে পারে না - এটাই এরা মেনে নিচ্ছে। তাহলে ভারতের এবং পাকিস্তানের "সন্ত্রাস" বিষয়ক সমস্যা নিয়ে আমাদের সাথে প্রণব মুখার্জির আলাপের কী আছে? দেকা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া টাক্সফোর্স গঠনের তাগিদটা আমাদের নয়, আমাদের মুখ দিয়ে বলানো ভারতের স্বার্থ-কথা। ভারত চাচ্ছে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে অবস্হান নেই। কিন্তু এতে আমাদের স্বার্থবোধ করারই কিছু নাই। আমাদের হুজি নিয়ে যতটুকু সমস্যা আমাদের আছে তা তো আমাদের রাষ্ট্রই মোকাবিলা করতে পেরেছে ও নিয়ন্ত্রণে আছে - এই ব্যকগ্রাউন্ড পরিস্হিতিটা স্বীকার করার পরই এর উপর দাঁড়িয়ে ভারতের কূটনৈতিক মহল ও আমাদের সুশীলরা মন্তব্য করতে পারছেন "বাংলাদেশের ঘাড়ে মুম্বাই হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তান"।

এবার আমরা জানতে পারছি, আমাদের দেশে ভীষণ "সন্ত্রাসবাদী" কাজকারবার আছে, চলছে - বলে যে প্রচার আছে একথা ভারতের কূটনৈতিক মহল ও আমাদের সুশীলরা নিজেরাই বিশ্বাস করে না। প্রণবের সফরের সময় পাকিস্তান কথা-ভাঙরি দিয়ে রান্ধা ভাত নষ্ট করার কূটকৌশল নিয়ে মিথ্যা বলেছে সন্দেহ নাই। কিন্তু এসুযোগে ভারতের কূটনৈতিক মহল ও আমাদের সুশীলদের মনের কথা আমাদের জানার সুযোগ ঘটে গিয়েছে - তবুও কূটকৌশলী পাকিস্তানকে এজন্য ধন্যবাদ দিতে পারছি না। পাকিস্তান তার "সন্ত্রাসবাদী" সমস্যা ভারতের সাথে মিলে এর সমাধান বের করুক। দক্ষিণ এশিয়া টাক্সফোর্স গড়ে ভাড়া খাটা আমাদের কাজ না।

হতে পারে না।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.