জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব
সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ স্বলিখিত "শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ" বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছেন। এ বইতে তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় তুলে ধরেছেন। আমাদের কাছে প্রচন্ড কৌতুহলের বিষয় হল "ওয়ান ইলেভেন"। আর সেনাপ্রধানও তাঁর বইতে "ওয়ান ইলেভেন" নামে একটি অধ্যায় লিখেছেন যা প্রথম আলো-তে প্রকাশিত হয়েছে।
পুরো অধ্যায়টি আমি পড়লাম।
লেখাটি পড়ে আমার অনেক কৌতুহলই নিবৃত হয়েছে। মনে হয়েছে, তিনি সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক যিনি তাঁর দেশকে ভালবাসেন এবং সেনাবাহিনীকে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে চান। এখানে বেশ কিছু কথা আছে যা অতি সরলীকরণ বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। তবে, হ্যাঁ, তিনি যেভাবে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেছেন, তাও ফেলে দেয়ার মত নয়।
যাই হোক, এবার আমার কিছু ব্যক্তিগত মূল্যায়ণ আপনাদের কাছে উপস্থাপন করতে চাই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস জন্মলগ্ন থেকেই নেতিবাচক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, মেজর জিয়াকে হত্যা, অসাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল, নিজেদের ইচ্ছেমত সংবিধান পরিবর্তন, বারংবার ক্যু-পাল্টা ক্যু, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি- এসব ছাড়া সেনাবাহিনীকে নিয়ে গর্ব করার মত কিছু ছিল না। কিন্তু নব্বইয়ের পর থেকে সেনাবাহিনী তার নেতিবাচক ভূমিকা থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে শুরু করে। বিশেষ করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান অসাধারণ। কিছুদিন আগেও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের সবচেয়ে বেশি সৈন্য কর্মরত ছিল।
এখন অবশ্য পাকিস্তান শীর্ষে রয়েছে, বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
তারপরও শুনতে পাই, সেনাবাহিনী '৯৬ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছে যদিও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে সে অপচেষ্টা ভেস্তে গেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত।
কিন্তু ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর বাহ্যিক ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসাযোগ্য এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিকসুলভ। দেশ যেভাবে ক্রমান্বয়ে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, সেনাবাহিনী সেখানে অনেকটা ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশকে রক্ষা করেছে।
সেনাপ্রধানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পূর্ণ সুযোগ থাকলেও তিনি সে পথ অনুসরণ করেন নি। তবে অনেকে যুক্তি দিতে পারেন যে জাতিসংঘ তথা আন্তর্জাতিক চাপের মুখেই সেনাপ্রধান প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন নি। অবশ্যই একথার যু্ক্তি রয়েছে। তবে, এটাও সত্য যে, তারপরও সেনাপ্রধান ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিচক্ষণ বলেই, ক্ষমতা গ্রহণের ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, তা আচঁ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন নি।
সেনাবাহিনী একটি চমৎকার ভোটার তালিকা জাতিকে উপহার দিয়েছে। এবারে তাদের নির্বাচনকালীন কর্মকান্ডও ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সবচেয়ে বড় কথা হল, তারা কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই নির্দ্বিধায় নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে।
সার্বিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, এবার সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল বেশ ইতিবাচক যা তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আমি মনে করি, এজন্য সেনাবাহিনী আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ পেতে পারে।
এবং অতি অবশ্যই সেনাপ্রধান খুবই প্রশংসার দাবিদার এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে সে প্রশংসা করতে এবং ধন্যবাদ দিতে কার্পণ্য বোধ করি না।
কিন্ত তারপরও কিছু কথা থেকে যায়, থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। এখনো আমাদের কাছে বেশ কিছু বিষয় খুবই অস্বচ্ছ। সরকারের ভিতরে কারা দল ভাঙার জন্য নীল নকশা তৈরী করেছিল, মাইনাস টু থিওরী কাদের মাথার উর্বর মষ্তিস্কের ফসল, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হয়রানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নতুন দল করার পিছনে কাদের প্রধান ভূমিকা ছিল, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চিন্তা কাদের মধ্যে ছিল, দুর্নীতি দমনের নামে ঢালাওভাবে রাজনীতিকদের হেয় করার প্রচেষ্টা কারা করেছিল- এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে অস্বচ্ছ। এসব ভূমিকার জন্য কিন্তু সমালোচনার তীর সেনাবাহিনীর প্রতিই তাক করা থাকবে।
কারণ সবাই খুব ভাল করেই জানে যে সদ্যবিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পিছনে সেনাবাহিনী আরেকটি ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। সেনাবাহিনী বিশেষ করে সেনাপ্রধান উল্লিখিত সব প্রশ্নের স্বচ্ছ, যৌক্তিক এবং বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিবেন কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।