পরিদৃশ্যমান সত্তা
ভাবান্তর : গেওর্গে আব্বাস
প্রাককথা:
এ কার কণ্ঠে গীত হচ্ছে অজগর! এই উচ্ছাসটুকু সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশের আগে ভাবান্তরিত রচনা সম্পর্কে কোনও কথা নির্মাণের প্রসঙ্গ যখন আসে, মনে হয় কবিতাগুলোর সংগ্রাহক রীম খিলানী’র সংগ্রহ প্রক্রিয়াসহ লেখার সঙ্গে ঐতিহাসিক যুগসূত্র স্থাপনের যে চেষ্টা তিনি করেছেন তাও অনুল্লেখযোগ্য নয়। গ্রন্থিত রচনাগুলোর তৃতীয় স্তবকে যে ক’টি চরণ সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো শতবর্ষ আগে গীত হত প্যালেস্টাইন-রমণীদের কণ্ঠে, গীত হত বিশেষতম মুহুর্তে যখন তাঁদের প্রিয় পুরুষরা অটোমান সেনা ছাউনীর উদ্দেশে দীর্ঘ দীর্ঘ দিনের জন্য গৃহত্যাগী হত। তখন প্যালেস্টাইন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত এক সংক্ষিপ্ত ভূ-খন্ড। এ সকল বর্ণনা আমরা জ্ঞাত হই প্যালেস্টাইনের কবি তৌফিক জায়াদ এর তথ্যমতে। তবে আমরা জ্ঞাত হই না ঐসব রমণীরা কি তবে গান গাইতেন সমস্বরে, মরুখন্ড বিদীর্ণ করে, কোনও মালভেরী বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ? এ দৃশ্যটি আপাততঃ পাঠকের জন্য রেখে যেতে চাই, কেননা নিবিড় পাঠকই একমাত্র অনুধ্যায়ী, দৃশ্যান্তরে...।
সাল- ২০০০; দুবাই শহরের এক গীতানুষ্ঠানে প্যালেস্টাইনী এক বৃদ্ধ রীম খিলানীকে তাঁর অফসুসের কথাটি জানালেন- দীর্ঘ ষাট বছর হয়, এ গীতি তাঁর কাছে শ্রুত হয়নি। রীম খিলানির কণ্ঠেই যেন আজ উচ্চারিত হল তাঁর ষাট বছরের গোপন বেদনা। আর রীম খিলানী সুদূর শৈশবে যে কথনগুলো শুনেছেন, জ্ঞাতে অজ্ঞাতে ধারণ করেছেন যা দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পরেও তাঁর কাছে এক অনতিক্রম্য ডায়াস্পরা।
যেহেতু লেখাগুলো ভাবান্তরিত হয়েছে ইংরেজী ভাষা থেকে, মূল আরবী থেকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে অনেক দূর যদিও সরে এসেছে কিন্তু ভাব ও বিষয়ের সূত্র ধরে জিজ্ঞাসা তৈরি অমূলক হবে না- আসলেই কি এগুলো কোনো লোককবিতা, গীতি বা লোককথা? আর যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে লাক্ষণিক বিষয় হল প্রত্যেকটি রচনারই অন্তর্নিহিত ভাব ও বিচ্ছেদের মূলে রয়েছে মাতৃভূমি প্রিয় প্যালেস্টাইন। সরল সমীকরণটি অনেকটা এরকম- প্যালেস্টাইনের বঞ্চনার ইতিহাস এত এত দীর্ঘ, যে সকল কথা পুরনো হতে হতে লোককথা হয়ে গেছে তা আজ পঠিত হলে বা গীত হলে মনে হবে এগুলো যেন প্যালেস্টাইনের বাস্তবতায় রচিত অতি সাম্প্রতিক কোনো রচনা।
সংকলিত লেখাগুলোর পাশে তাই বুঝি Mahmoud Darwish এর উক্তিটিও স্মরণ করা হল সন্মানের সঙ্গে I defend my right to defend my right .
রীম খিলানীর কণ্ঠে কবিতাগুলো যখনই গীত হয়েছে অনুধ্যায়ী হয়েছি উচ্চারিত ধ্বনির দিকে, আমার শ্রবণেন্দ্রীয় যদিও আরবী ভাষার জন্য অপ্রস্তুত। তবে প্রতিটি শব্দই যে যুদ্ধ করে ধুলার কুড়লী নির্মাণ করছে আর সবগুলো কুড়লী একত্র হয়ে তৈরি হবে ঝড়, তা টের পাই। এমন মরুখন্ডের রুহের অনুবাদ কি করে সম্ভব?
১.
যেদিন সে মনস্থির করে, চলে যাবে
আমার হৃদয় বিদীর্ণ করেছিল উটওয়ালা
-আমায় সঙ্গে নিয়ে চল, ওহে উষ্ট্রচালক
- আমার ভ্রমণ যে বহুদূর, দীর্ঘ দীর্ঘ...
- বোঝা তো হব না আমি
শুধু হেঁটে যাব তোমার উটের পা-য়ে পা-য়ে
- প্রশান্তি তোমার নন্দন
তুমি শান্ত হও সরুবালা!
- যেদিন সে মনস্থির করে, চলে যাবে
আমার হৃদয় বিদীর্ণ করেছিল উটওয়ালা
-এমন মরুপন্থে কতদিন শুধু ঝড়ের প্রবাহে, মরুঝড়ে...
-পঞ্চাশটি বছর, পঞ্চাশ-বসন্ত হত্যা করে করে...
-তোমার উটের কেরাভানে আর কারা সঙ্গী আছে বল!
-উদ্বাস্তু বৃদ্ধা, শিশু ও বৃদ্ধ
গহীনে, গন্তব্যে প্যালেস্টাইন প্রিয় মাতৃভূম আমার
-ভ্রাতা হে
শয্যা প্রসারিত কর না আর
আমরা যে রজনী যাপন করছি না আজ
প্রিয় পশুটি জবাই কর না তুমি
আমরা ক্ষুধার্ত নই।
যে-দিন সে মনস্থির করে, চলে যাবে
আমার হৃদয় বিদীর্ণ করেছিল উটওয়ালা
যাত্রাপথে কী তোমার প্রথম ও দ্বিতীয় বোঝা
কফি ও কাপ, মশলাপাতি
আর সর্বশেষ বোঝা হল
অনিন্দ্য রূপসী, সেই সব কুমারীরা...
২.
আমাদের প্রিয়জন নির্জনে একদিন গৃহহীন হল
বিদায় না বলেই বিদায় নিল চিরতরে
সুপ্রভাতে
তাহাদের মালভেরী বৃক্ষের কাছে যাই
কোথাও কেউ নেই, ক্রন্দনরত এক
পেলেস্টাইনী কবুতর ব্যাতিরেকে
থেমে যাই
পা-জোড়া আটকে থাকে কঠিন ভূমিতে
আমার অশ্রুমালায়
তাহাদের বাড়ির বেড়া কিঞ্চিত ভিজে যায়
ওহে উটওয়ালা
ঐ বা পন্থে পুনর্বার যদি দেখা হয় তাহাদের সাথে
তুমি কি বলবে না
আমি ঘুমিয়েছি, তো ঘুমিয়েই আছি
শুধু জেগে আছে একজোড়া চোখের পাতা
৩.
নাজারিনির নারী অতিক্রম করে আবন-আমানের তৃণভূম
যাত্রাপথে কেউ কেউ বিলাপ করে, কেউ বা ক্রন্দন
জরায়ূতে সন্তান বহন করে কেউ
কেউ বা কোলে নিয়ে দুগ্ধপান করায়
যারা কুমারী, তারা বিলিয়ে দেবে না অমূল্য আপেল
তারা ক্রন্দনরত
আমাদের পিঠের বোঝা আনেক তো ভারী
মেরুদন্ড বেঁকে যাচ্ছে ধীরে, পেছনের দিকে
৪.
'আউইহা' শপথ করি তাহারই নামে, যিনি স্রষ্টা
আউইহার মাথার উপরে শুভ্র তারকারাজির
আমি অপেক্ষারত...
এ বক্ষে রোপন করেছি ঝাঁঝাল লঙ্কা
শত্রুরা বলে
কোনোদিন তা আর বর্ণীল হবে না ভুল করে
প্রার্থনা পড়ো
আমাদের গোলাপী পুষ্পের ঝাড় একবার যেন বেড়ে ওঠে
আমাদের লঙ্কাগুলো একদিন যেন লাল হয়...
৫.
ওহে গাজ্জালীর গাজ্জালী তুমি
চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও নিভৃতে
প্রার্থনা পড়ো পয়গম্বর সমীপে
দু’চোখ অশ্রুসিক্ত আজ
ক্রন্দন করি ভয়াল বিচ্ছেদে
পোষাকের রঙ কালো করি
আমাদের ডবের মুদ্রায় নিষিদ্ধ নিজ হতে
বিবিধ বিলাপে কেবল ঘুরেফিরে যাই
ঘুরেফিরে যাই...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।