আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তার কষ্টের কথা: তার কষ্টের কারণ।

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

কান্না। মানুষের একান্ত সময়ের একান্ত অনুভূতি। একে এড়িয়ে বাঁচা যায় না।

আমাদের কাঁদতেই হয়। এটাই সত্য। তবু অন্যের কান্না দেখে খারাপ লাগে। যদিও জানি-কান্নাও এক ধরনের ঔষধি। কান্নার সময়ে শান্তি লাভ হয়, কান্নার পরে প্রশান্তি আসে।

একেক জন একেক কারণে কাঁদে। তবে সেই সময়ের অসহায় অনুভূতিটা মনে হয় একই। মাশুক। ২০০৩ সাল থেকে ওকে চিনি। ঝকঝকে তরুণ।

প্রায়ই আমার ঘরে আসে; এসে গিটার বাজায়, সিগারেট টানে; পকেট থেকে পেন ড্রাইভ বের করে ল্যাপটপে জরুরি সব সফটওয়্যার ইন্সলটল করে। মাস ছয়েক আগে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরিতে ঢুকেছে মাশুক। আই টি। এবার বিয়ে করবে ... মিলি: মাশুকের দীর্ঘদিনের প্রেমিকা। দু-একবার দেখেছি মেয়েটাকে।

শ্যামলা মতন চশমা পরা হাসিখুশি মুখ। মিলিও পাস করে একটা প্রাইভেট ফার্মে ঢুকেছে। এবার মাশুকের সঙ্গে বিয়ে হবে ... তখন বলছিলাম যে- মাশুক আমার ঘরে প্রায়ই আসে; এসে সফটওয়্যার ইন্সলটল করে, গিটার বাজায়, সিগারেট খায়। তা ছাড়া বয়েসে আমি ওর অনেকই বড় বলে ওর ব্যাক্তিগত নানা সমস্যায় আমার পরামর্শ নেয় ও। সে দিন সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ঢুকল মাশুক।

ওকে দেখেই আমি ভীষন চমকে উঠলাম। মুখটা কালো। চোখ দুটো স্বাভাবিক নয়। চুল এলোমেলো। কী ব্যাপার? কী হইছে? তোমার মুখ কালো কেন? আমার কন্ঠস্বরটা কেমন ফ্যাকাশে শোনাল।

ও ধপাস করে বসল। একটা সিগারেট ধরাল। হাতটা কাঁপছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ সিগারেট খেল। তারপর ধীরে ধীরে সব খুলে বলল।

মিলি ওর অফিসের এক কলিগের সঙ্গে রিলেশনে জড়ায় ..। আমি ক্ষণিক বিস্মিত। মানে? মাশুক মাথা নাড়ে। ডিপ? হ্যাঁ। আর ইউ সিওর? আমার চোখে মিলির মুখটা ভাসছে।

ও কখনও আমার সামনে থেকে ওড়না সরায় নাই। একবার উঠে মাশুক বাথরুমে গেছিল। আমরা সায়নের গান নিয়ে কথা বলছিলাম-তখনও না। আমি তখন ভাবছিলাম মিলির কি রক্ষণশীল gene? হ্যাঁ। মিলি স্বীকার করছে।

বলে চুপ করে থাকে মাশুক। স্বীকার করছে! হ্যাঁ। মাশুকের কন্ঠস্বরটা ভাঙ্গা। খসখসে। আমি বললাম, তুমি কোনও কারণে মিলির সঙ্গে মিসবিহেভ করছিলা মাশুক? মানে কোনও কারণে মিলি তোমার উপর খেইপা - না! মাশুকের কন্ঠস্বরটা কেমন তীক্ষ্ম শোনাল।

মুখটা ফরসা। এখন টিউব লাইটের আলোয় কেমন কালো দেখাচ্ছে। কালো। কালিঝুলি মাখা। চুল এলোমেলো।

আমার বুকের ভিতরটা টনটন করে ওঠে। সেদিন ওকে বলছিলাম, আমি কি তোমার আব্বার সঙ্গে কথা বলব মিলির সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যাপারে? বলেন। বলে মাশুক হেসেছিল। এক মুখ ধোঁওয়া ছেড়ে মাশুক বলল, মিলি চাকরিটা ছেড়ে ছিসে। আবার আমার কাছে ফিরতে চায়।

বিয়ের কথা বলে। আমি ওকে বিয়ে করতে পারব না জুবায়ের ভাই। আরেক ... আরেক জনকে নিয়েও সুখি হব না। আমার কী যে খারাপ লাগছে। মনে হয় কলাপস করব।

মিলি অমন করল কেন? আমাকে কষ্ট দিল। অনেক ... অনেক কষ্টে ড্রাগস ছাড়ছি। এখন যদি আবার ধরতে হয়। ... তো? বলে হু হু করে কেঁদে ওঠে মাশুক। কান্না।

মানুষের একান্ত সময়ের একান্ত অনুভূতি। একে এড়িয়ে বাঁচা যায় না। আমাদের কাঁদতেই হয়। এটাই সত্য। তবু অন্যের কান্না দেখে খারাপ লাগে।

যদিও জানি-কান্নাও এক ধরনের ঔষধি। কান্নার সময়ে শান্তি লাভ হয়, কান্নার পরে প্রশান্তি আসে। একেক জন একেক কারণে কাঁদে। তবে সেই সময়ের অসহায় অনুভূতিটা মনে হয় একই। আমি স্তব্দ হয়ে বসে থাকি।

আমি ব্যচেলর মানুষ। এদের নিয়েই বেঁচে আছি। এদের কান্না দেখলে কী যে খারাপ লাগে। জানালার ওপাশে অন্ধকার। শীত।

নিচের গলিতে “নৌকা”, “নৌকা” বলে চিৎকার। আমার অর্থহীন মনে হয়। মনে হয়-বছর পাঁচেক আগে মাশুক নেশা করত। মিলি ওর জীবনে এসে ছাড়াল। আমারও কিছু ভূমিকা ছিল।

গিটারের অলীক শব্দময় জগৎটা ওর সামনে মেলে ধরেছিলাম আমি। এখন যদি আবার ... পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছল মাশুক। সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজল। তারপর উঠে দাঁড়াল। ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে ওকে।

পরে আসব -বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। সম্ভবত শীতের সন্ধ্যার রাস্তায় অনেকক্ষণ ধরে হাঁটবে। কিংবা জোনাকি সিনেমা হলের সামনে যেতে পারে। ওখানে চরস পাওয়া যায়। আমার ভীষন ক্লান্ত লাগছিল।

আমি ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলাম। তারপর ভাবতে বসলাম। (১) মিলি ঐ রিলেশনে জড়ালো কেন? (২) জড়ালো তো স্বীকার করল কেন?(৩) মাশুকের এত কষ্ট হচ্ছে কেন? (৪) ব্যাপারটা ও মেনে নিতে পারছে না কেন? মিলি ঐ রিলেশনে জড়ালো কারণ-মানুষ এক গভীর তৃষ্ণার্ত প্রাণির নাম। মিলিও গভীর তৃষ্ণার্ত প্রাণি-তাই? মানুষের অনিবার্য গভীর যৌনবোধের তাড়নায় কলিগের সামনে ক্ষণিকের জন্য হলেও মাশুকের মুখটি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল মিলির?তা হলে মিলিকে কতটুকু দোষারোপ করা যায়? কিন্তু, ঘটনাটা মিলি মাশুকের কাছে স্বীকার করল কেন? এটাই সবচে রহস্যময় পার্ট। মিলি পুরোপুরি প্রাণি নয় বলেই সম্পর্কটা স্বীকার করল কি? বিবেকের তাড়না? মানুষ এই দুটি প্রান্তে সর্বদা দুলতে থাকে যেহেতু।

মানুষ পুরোপুরি প্রাণি হলে তার অনেক যন্ত্রণাই থাকত না। আমরা উঁিক দিয়ে কিছু দেখে ফেলে মনে কষ্ট পেতাম না। কিন্তু, মাশুকের এত কষ্ট হচ্ছে কেন? ব্যাপারটা ও মেনে নিতে পারছে না কেন? এ দুটো প্রশ্ন এক সূত্রে গাথা। ও কষ্ট পাচ্ছে-যেহেতু মিলি বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। যে বিশ্বাস পবিত্র।

কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গের প্রকৃত মানে কি? একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখবে বাড়ি খাঁ খাঁ। মিলি নেই। সেটা তো মিলির দিক থেকেও হতে পারে। তা হলে কি মাশুকের এই কষ্ট মিলির প্রতি ঘৃনা পুরুষের ওপর নারীর চিরকালীন অধিপত্যবাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া? তা হলে তো মিলিরও একইরকম অনুভূতি হত যদি মাশুক ওর অফিসের কোনও কলিগের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়াত। মাশুকের অনুভূতি কি পুরুষতান্ত্রিকতার ফল? যা কিছু ধারণার সমষ্টি।

মাশুক কেন মিলির অফিসের কলিগের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক মেনে নিতে পারছে না? মেনে নেওয়া যায় না। কেন? যেহেতু মেনে নেওয়া যায় না। আরে! আমি তো সেটাই জানতে চাইছি-কেন মেনে নেওয়া যায় না ............ মাশুকের gene কি রক্ষণশীল? তাহলে রক্ষণশীল gene কি? কেন বিবর্তনের ধারায় রক্ষণশীল gene-এর দরকার হয়? আর মাশুকের কষ্টের পিছনে কি ধর্মীয় মূল্যবোধ ক্রিয়াশীল নয়? ওদের পরিবার কেবল রিলিজিয়াসই নয়-পীরও পোষে। মাশুকও নামাজ পড়ে- পাঁচ ওয়াক্ত না হলেও তিন ওয়াক্ত। বুঝলাম।

কিন্তু, কেন ওর কষ্ট হচ্ছে? ওর কষ্ট হচ্ছে কেন? সভ্যতা তো মানুষের কষ্ট দূর করার জন্য? তো? সভ্যতা ওকে কি শেখালো যে কারণে কষ্ট পেতে হবে?) বাঙালী সংস্কৃতি ওকে কি শেখাল যে কারণে ওকে কষ্ট পেতে হবে?। যে সভ্যতা সংস্কৃতি নিয়ে আমরা গর্ব করি। একে আগলে রাখতে চাই। রক্ষা করতে চাই-তাই তো মাশুকের কষ্টের কারণ। সভ্যতাসংস্কৃতি তো মাশুকের শান্তির উৎস হতে পারছে না।

আমাদের কি অন্য ধরনের সভ্যতাসংস্কৃতি প্রয়োজন? মানুষের ভাতকাপড়ের অভাব দূর হয়নি বলে যেমন আমরা সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা ভাবছিলাম (আজও ভাবি) সে রকম? আমার ঘরে শীতার্ত অন্ধকার দুলে ওঠে। মাশুকের ভীষন কষ্ট হচ্ছে। ও এখন শীতের সন্ধ্যায় হাঁটছে। একটার পর একটা সিগারেট টানছে। রাস্তায় ধানের শীষ ও নৌকার মিছিল।

ভোট দিবেন কাকে-ও এখন এসব মিছিলকোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন। অথচ মানুষ সামাজিক প্রাণি। ইস! সপ্তাহ দুয়েক আগেও মাশুক আমাকে বলেছিল-প্রার্থী পছন্দ হচ্ছে না। আমি “না” ভোট দিব। এখন? এখন নেশার ধূসর জগতে ফিলে যাওয়ার কথা ভাবছে মাশুক।

আমি দিশেহারা বোধ করি। মাশুকের কান্না ভেজা মুখটা মনে করে অন্ধকারে আমার মনে হল প্রচলিত সব সামাজিক-ধর্মীয় মূল্যবোধ, তথাকথিত সভ্যতা-সংস্কৃতি যদি নদীর জলে ফেলে দিয়ে কেবল শান্তি শান্তি এবং শান্তি পাওয়া যেত! আমি মনে মনে মাশুককে বললাম- একদিন তুমি এই কষ্টকর দিনগুলি ভুলে যাবে মাশুক। তুমি তখন প্রতিশোধ নিও। কী ভাবে? যেসব মূল্যবোধ ধর্মীয় ও সামাজিক তোমার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে-সে সব নষ্টভ্রস্ট মূল্যবোধ তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের ভিতর ছড়িয়ে দিও না। কখনোই না।

তাতে জগৎ ধ্বংস হলে হোক! আমি জগতের যাবতীয় প্রচলিত মূল্যবোধ ধ্বংসের বিনিময়ে হলেও মানুষকে কষ্টহীন মানসিক যন্ত্রণাশূন্য দেখতে চাই। আর, তোমার পুত্রটি যেন তার প্রেমিকার মৌসুমি প্রেমটিকে নির্ভেজাল কৌতূকের সঙ্গেই দেখে। কেননা, জীবনে প্রেম অনিবার্য।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।