গান দেখা যায় না। দেখানোও যায় না। গান কান দিয়ে ঢুকে পড়ে। গান মনে গিয়ে কড়া নাড়ে। মন গানের পেছনে ছোটে।
গান মনের ভেতরে ঢোকে। মন গানের ভেতরে ঢোকে। তাই গান নিয়ে আসলে লেখা যায় না। গেলে, আমার পে না। গানের গায়কী ধরে গায়ককে নিয়ে কি লেখা যায়? যদি গায়ক হন অর্ণব, তবে ওর গান নিয়ে লেখাটা কেমন? সেই তো কবেই জানি, কানু বিনে গীত নেই / গীত বিনে পিরিত নেই।
পিরিতি না থাকলে তো মজাও নেই। মজা নেই তো জান নেই। জান নেই তো গান নেই, দান-স¤প্রদান নেই, মান-অভিমান নেই, আনন্দ-বিষাদ নেই, খাঁদ ও নিখাঁদ নেইÑ কিন্তু এগুলো আছেই। আছে বলেই অর্ণবের গান নিয়ে যখনই একটা লেখা তৈরি করতে মনস্থির করেছি, লেখার আগে আরেকবার গানগুলো শুনে নেয়া ভালোÑ ভেবে, যেই পিসি প্লে করি, হায়রে, কী যে হয়, একটা মোহময় টিন টিন আবেশ চক্রান্ত করে ঢুকে পড়ে কানের মধ্যে। অর্ণবের গান শুনতে শুনতে একটা প্রবলেমই হয় আমার জন্য, গান থেকে ছুটে লেখাটা আর ধরতে পারি না।
কিছুতেই তাই লেখা হয়ে ওঠে না, গান নিয়ে, যে-গানে অর্ণব, যে-গান বাংলা, যে-গানে নবসুরবাদ্যে উতলা অমল ধবল যৌবনবিদ্ধ আমাদের সমকালÑ
তুই গান গা / বাতাসকে খুশি করে বাঁচ... রোমাঞ্চ-উচ্ছ্বাসের পাড়ে-পাড়ে, সুরবেলার সাগরতীরের বালিতে পদচিহ্ন এঁকে সেই যে অর্ণবের ত্র“বাদুরীয় অনুপ্রবেশ, উদারা-মুদারা-তারায় এখন তার মন্দ্রবিস্তার চলছে। চিৎকারে চিৎকৃত সপ্তমের এই মহানগরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে... রাতগভীরের কোনো জানালায় দেখা আলোছায়ার বারান্দায় রচিত নৈ:শব্দ ভেঙে আমরা অর্ণবের গান শুনছি। সমকালীন আর সব গানের মধ্যেই শুনছি তবে আলাদা একটা প্রত্যাশা, আলাদা একটা প্রাপ্তির ভেতর দিয়ে আমরা শুনছি অর্ণবের গান। এ সময়, বাংলা গানে অর্ণব এক তরুণ নৃপতি, আপন মনে বাজিয়ে চলেছেন। গেয়ে যাচ্ছেন, গাইয়েদেরও জড়ো করছেন, জমে উঠছে।
ওহ্! কী উচ্চারণÑ ভালোবাসা তাই অন্য কোথাও, চায়ের কাপে / নিজেই নিজের সাম্রাজ্য গড়–ক / আমি দিই চাঁদকে পাহারা ততণ / তারা নিংড়োনো আলোয়...। সত্যি, অর্ণবের গানের প্রতি সবিশেষ কর্ণযোগ দিতেই হয়। তবে একুশ শতকের সূচনালগ্নের হেনকালে বাংলা গানে অর্ণবের গান যদি কারো ভালো লাগে, আমার ধারণা, অন্য কারও গান তার ভালো লাগা থেকে কেমন যেন বঞ্চিত হতে পারে। এই বাক্যে কিছু বাড়াবাড়ি মনে হলে, সে তো আমি আগেই বলেছি যে আমার ধারণা, হ্যা, আমার ধারণা এখনো পর্যন্ত এরকম। কারণ, অর্ণব শুধু অর্ণবের মতো করেই গান করেন, বাদ্য বাজান।
রিয়েলি, হি ইজ অ্যা ভীষণ জিনিয়াস আওয়ার টোটাল আর্ট। অর্ণব যে মিউজিক ভিডিও করেন, সেতো খুবই মজার নির্মাণ, দেখে কে না বলবে, ‘বাহ্’ ? গানের মধ্যে ছবি, ছবিও যে গান গায়, সুর ছড়ায়।
আমি অর্ণবের গানের ভক্ত। কিন্তু গান নিয়ে লেখা তৈরির পূর্বতন কোনো অভিজ্ঞতাই আমার নেই। গান চোখে দেখা যায় না।
অর্ণবদের গানের দল বাংলা থেকে বেরুনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি শুনেছি। অর্ণবের সলো অ্যালবাম চাই না ভাবিস ও হোক কলরব শুনলাম। বাংলা মিউজিকে নয়াÑনয়া নিরীা করছেন অর্ণব। প্রেয়ার হল এর বুঝছো? এবং কৃষ্ণকলির গানে অর্ণবের মিউজিক ল করেছি। কৃষ্ণকলির গানগুলো কিংবা বুঝছোতে পুনমের গাওয়া আজকে আমার মেঘে মেঘে রঙএ অর্ণবের মিউজিক কম্পোজিশন নিশ্চয় শ্রোতার কর্ণকুহরে অর্ণব সম্পর্কে একটা নিশ্চিতি দেবে, নিশ্চিতিটা এরকম যে, অর্ণব এ প্রজন্মের সত্যি সত্যি স্বতন্ত্র্য এক শিল্পী।
লালন ঠাকুরের গান, রবীন্দ্র ফকিরের গান কিংবা লোকগানেও অর্ণবের নিজস্ব লাবণ্য-নিরীার পর এক নতুন টেস্ট আমরা পেয়েছি। পাই, পাচ্ছি। এই পাওয়া গানের কাছ থেকে পাওয়া, হাওয়া থেকে পাওয়া...
কদিন আগেই এক রাতে, গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা দেখছিলাম এডিটিং প্যানেলে। মনপুরার গানও শুনলাম। অর্ণব মিউজিক ডিরেক্টর।
মিউজিক নিয়েই আত্মমগ্ন থাকেন, হয়তো সে কারণেই ওর মিউজিক থেকে বিচ্ছুরণের যাদু বের হয়। শুনতে ভালো লাগে, আর এই ভালো লাগাটাই ব্যাপার। ব্যাপারটা কিছু না’র মধ্যেও অনেক কিছু। কিছু মানে অনেক, অনেক মানে কিছু। এভাবেই, অর্ণবের গানে অনেক কিছু পাই সা¤প্রতিক অডিও বিপ্লবের (!) পর চারপাশের পচা পচা গান-ঝংকারের কান ঝালাপালা প্রতিবেশের মধ্যেও।
একথা সত্যি, আজকের তারুণ্যের ম্যাচিউরড অংশই অর্ণবের গানকে নিয়েছে বেশি, কারণ, সে যে বসে আছে...
মাঝেমধ্যে মনে হয়, অর্ণবের গানের মধ্যে চিরকালের এক হারানো কিশোর অভিমান করে লুকিয়ে আছে। যে-কিশোর সর্বদা প্রেমিক, যে-প্রেমিক সবসময় উপকথার আপেলবনে ঘুরে বেড়ায়। আসলে প্রেমিকের ছদ্মবেশে এক ভবঘুরে চরিত্রই আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়ে আপেলবনে। অর্ণবের গানের মধ্যে ছদ্মবেশী সেই ভবঘুরে, সেই আপেলবন, সেই হারিয়ে যাওয়া জঙ্গল-রহস্যের মায়া জড়িয়ে আছে। একজন কবি... নির্জন পৌষের হিমে শহর ছাড়িয়ে দূরে, উপশহরেরও প্রান্তে কোথাও আত্মগোপনকারী জোনাকি বংশের এক কবি...সেও কি অপাপবিদ্ধ জোসনায় অর্ণবের গানের মধ্যদিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে না এই কুয়াশা-আপ্লুত রাতে? আর অর্ণব নিজেই যেহেতু ছবি আঁকা কাসের ছাত্র, তাই ওর গানের মধ্যেও মাঝেমধ্যে দেখি আঁকানো-বাঁকানো মরুভূমির দিকে তাকানো ওয়াটার কালারের মেঘ, পালাই পালাই মেঘÑ স্বয়ং এই শিল্পী যাকে বলছেনÑ তার হারিয়ে যাওয়া তুমুল কালো মেঘ।
কত কী যে গানের মধ্যে, প্রাণের মধ্যে! গানের মধ্যে কাশবন, গানের মধ্যে পাতা ঝরার শব্দ, গানের মধ্যে রক্তরণের মূর্চ্ছনা, গানের মধ্যে আহত মলিন মুখ, গানের মধ্যে ক্যাকটাস-দুপুরের রোদেলা গিটার, গানের মধ্যে নারীর শরীর সেই পুরোনো পিয়ানো... গানের মধ্যে মুহূর্তের ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর-প্রাসাদ-চিলেকোঠা... আর সেই চিলেকোঠার রেলিঙ ধরে দাঁড়ানো স্বপ্ন, সিল্যুট-সিল্যুট স্বপ্ন; কারণ, স্বপ্নের পেছনে সূর্যাস্ত, লাল-কালো মেঘের ফালিÑ সত্যি, অর্ণবের গানে ইন্দ্রিয়ঘন ইমেজ তৈরি করে। ওছিয়ত করে বললে, কান পবিত্র করে ওর গান শুনতে হয়, কারণ, গানের মধ্যে অর্ণব কত কি যে মিশিয়ে দিচ্ছেন, শুনে আমরাও আনন্দ পাচ্ছি। ভাবছি, এই শিল্পী দেখি আমাদের কোথায় নিয়ে যান? স্পেনের সমুদ্রকূলে? ছেউড়িয়ায়? শান্তিনিকেতনে? নাকি এই নদীকূলে গড়ে ওঠা শহরের অলি-গলি পেরিয়ে প্রতিদিন এই ঘরে ফেরা বাইরে যাওয়া আচ্ছন্ন-দৈনন্দিনতার ঘানি টপকে ওর গান আমাদের নিয়ে যেতে চায় এমন এক সুরশ্রী সুড়ঙ্গের মধ্যে, যে-সুড়ঙ্গ থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। এটাই হয়তো গায়েনের গর্বিত ব্লু প্রিন্ট, ষড়যন্ত্র। নন-ভিজ্যুয়াল গান-বাদ্য-বাজনা শোনাতে শোনাতে ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট অর্ণব কি আমাদের এ সময়ের বাংলা গান শোনার রুচিও অনেকাংশ অটোমেটিক নিয়ন্ত্রণ করছেন না? এরপর কিংবা এখন পর্যন্ত অন্য কোনো শিল্পী সেই টেস্ট ছুঁতে পারছে পুরোপুরি? পারছে না কেন?
ব্যাসিক্যালি, লাভ এন্ড লোনলিনেসÑ ইংরেজি এই দুটো শব্দের মানেটাই অর্ণবের গানে বা শব্দে-সুরে বাসা বুনেছে।
একটা গানের মধ্যে মনে হলো অর্ণব দাঁড়ের আওয়াজ ঢুকিয়ে দেন, একটা গানে স্বয়ং একটা ঘোড়া এসে হ্রেষা ছড়িয়ে যায়। চিঁ হিঁ হিঁ চিঁ হিঁ হিঁ চিঁ হিঁ হিঁ শুনতে শুনতে রাত নামে চরাচরে। যথা রোমান্টিক তথা এক বিষণœ ঈগল উড়ে যায় ডানায় চাঁদকে ঢেকে। ছায়া পড়ে চন্দ্রকরোজ্জ্বল আমাদের মনোজগতে। হারিয়ে ফেলার মতো সোনালি বেদনাসমগ্র হুহু-নাদে আছড়ে পড়ে চিকচিকে বালুর ওপরে।
অর্ণবের গানের ভেতর দিয়ে ছোট্ট উপত্যকা বেয়ে নেমে আসে মেটাফরের ঘোড়া। জোসনায় যুদ্ধাহত! রক্তাক্ত জিন। শেষপর্যন্ত কণ্ঠমাধুর্যে এই শিল্পীর আউলি-বাউলি কিন্তু পর্যাপ্ত সিরিয়াস অবস্থানই তার প্রতি আমাদের প্রণত করে তোলে, শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয় এবং একটি চরম অপো জাগিয়ে তোলে এই আকাক্সায়Ñ এরপর অর্ণব কি গান প্রস্তুত করছেন? যদি একটা ফানতাসা করে বলিÑ অর্ণব কি এই রাতে আততায়ী দিগন্তের দিকে হাঁটাহাঁটি করছেন? গান-বাজনা বাদ? উ: হুঁ। সাহানা তা হতে দেবে? চখাচখি না?
টোকন ঠাকুর... জানুয়ারি ২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।