আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

page- ২২,২৩,২৪

সিএসই ডিপার্টমেন্টের একটি প্রকাশনা হিসেবে প্রকাশিত।

খন্ড খন্ড স্মৃতি এস এম শাহরিয়ার নির্জন ব্যাচ ’০০ খুব অল্প সময় হলেও আমাদের এই ‘দেশসেরা’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বিশ্বসেরা’ ইঞ্জিনিয়ার গড়ার দায়িত্ব পেয়েছি। এইটুকু সময়ে বুয়েটকে কতটুকু দিয়েছি বলতে পারব না, কিন্তু পেয়েছি অনেক কিছু। ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনা লিখলাম। আশাকরি কারো মন্দ লাগবে না।

১. লেট: ছয়বছর ধরে তিলে তিলে নিখুঁতভাবে গড়ে ওঠা বদভ্যাসগুলি টিচার হবার পর রাতারাতি পাল্টে যাবে- এমনটি হবার কথা নয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই। স্টুডেন্ট লাইফে সকাল আটটার ক্লাস কোনদিন ধরতে পারতাম না। টিচার হয়েও সে রেকর্ড মোটামুটি অক্ষুণ্ন। সকালের ক্লাসে পাঁচ-দশ মিনিট লেট হবেই।

এমনকি কোন কোন দিন সময় মত বুয়েটে পৌঁছেও রুমে বসে আছি মিনিট পাঁচেক লেট হবার পর ক্লাসে ঢুকব বলে এমনটিও ঘটেছে। সে যাই হোক, মিডটার্মের পর সিলেবাস প্রায় শেষের দিকে থাকায় ক্লাসে লেট করে আসাটাকে আর গা করছিলাম না। একদিন আটটা বিশ বেজে গেছে অথচ আমি একতলায় বামহাতে মিলম্যানের ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক্স বই নিয়ে আর ডানহাতে চোখ ডলতে ডলতে লিফটের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী সুপুরুষ ভদ্রলোক আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন লিফটের জন্য। ঘুম জড়ানো চোখে তার দিকে একবার তাকাতেই সব ঘুম নিমিষে গায়েব হয়ে গেল।

ব্যক্তিটি আর কেউ নন, স্বয়ং হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট, সাইদুর রহমান স্যার। কঠিন এই পরিস্থিতিতে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একবার ভাবলাম একদৌড় দিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে যাই স্যার আমাকে চেনার আগেই। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “কি সাবজেক্ট?” আমি বললাম, ‘ডিজিটাল ইলেক্টনিক্স’।

পরের প্রশ্ন নিশ্চয় হবে লেট কেন? এই প্রসঙ্গে কি উত্তর দেব চিন্তা করছি, কিন্তু মাথায় কিছু আসছেনা। তাই ব্যস্ত হয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকলাম। লিফটে উঠেও খুব মন দিয়ে বই পড়তে লাগলাম। আমাকে ক্লাসের প্রিপারেশনে ব্যস্ত দেখেই বোধহয় স্যার আর কিছু বললেন না। তারপর টানা দুটি থিওরি, একটা সেসনাল ক্লাস এবং লাঞ্চের পর আবার ডিপার্টমেন্ট এ আসলাম বিকেলের আরেকটা সেসনাল ক্লাসের জন্যে।

প্রথমেই নিজের পিজিওন বক্স চেক করে দেখলাম। নাহ, কোন শো-কজ লেটার নেই। খুশি মনে টিচার্সল্যাবে ঢুকতেই স্যারের সাথে দেখা। মনে হল স্যার খুব মুডে আছেন। বিগত জীবনের নানান স্মৃতি বর্ণনা করছেন আর প্রয়োজনের দ্বিগুণের চেয়ে বেশী মুগ্ধ হয়ে সামী, খুরশীদ ভাইসহ আরো অনেকে তা শুনছে।

আমার ঘটনা একেবারে ভুলে গেছেন বলে আমি যখন প্রায় নিশ্চিত ঠিক তখনি স্যার বলে উঠলেন- “আজকে নির্জনকে দেখলাম লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়ছে” । মনে মনে ভাবলাম- ‘এবার রক্ষা নেই’। স্যার বলতে লাগলেন, “ব্যাপারটা দেখে একটা জিনিস মনে পড়ে গেল। ” আমি চিন্তা করে পাচ্ছিলাম না স্যার আমাকে ঝাড়ি দেয়ার জন্যে ঠিক কোন লাইনে এগোচ্ছেন। স্যার বলতে লাগলেন, “আমি দেখেছি যে, জাপানে কেউ এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করে না।

তারা ট্রেনে/বাসে চলাচলের সময়ও কোন না কোন বই পড়ে। বইগুলিকে তারা জাপানী ভাষায় ‘মাঙ্গা’ বলে। নির্জনকে দেখে আমার তাদের কথা মনে পড়ে গেল। ” আমার এখন মুখবিস্তৃত হাসি। স্যার যে মুহূর্তে তার ডিপার্টমেন্টের একজন সাধারণ লেকচারের অসাধারণ গুণে মুগ্ধ হয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছেন, আমি তখন সম্পূর্ণ বিপরীত (কিন্তু সংগত) কারণে স্যারের সামনেই দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম।

২. ছাত্রাভাব: টিচার হবার পর তখনো ছাত্র ছাত্র ভাব কাটেনি। সেশনাল ক্লাসে যখন পেছনে বসে বসে সিনিয়র টিচারদের লেকচার শুনি তখন মনে হয় এখনও ছাত্রই আছি। অনেক কষ্টে দুষ্টুমিগুলো চেক দিয়ে রাখতে হয়। একবার ক্লাশে রোলকল হচ্ছে। রোল টুয়েন্টি শুনে আর চুপ থাকতে পারলাম না।

‘ইয়েস স্যার’ বলতে যাব, ঠিক তখনই সামনে থেকে একজন ‘ইয়েস স্যার’ বলে উঠল। আমি একটুক্ষণের জন্য রেগে গেলাম- আমার উপস্থিতিতেই আমার প্রক্সি কে দিচ্ছে? পরে বুঝতে পেরে নিজে নিজে বেশ একচোট হাসলাম। এসেম্বলি ল্যাংগুয়েজের সেই সব ক্লাসে মূল লেকচার দিতেন খুরশীদ ভাই। একদিন এসেম্বলি পড়াতে পড়াতে জোসে এসে যখন তিনি মাইক্রোপ্রসেসর, কম্পাইলার, রিয়েলমোড, প্রটেক্টেডমোড সবকিছুর একেবারে গভীরে চলে গেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এ্যাড্রেস ক্যালকুলেশনের খুব সহজ একটা প্রশ্ন করলেন ক্লাসে। পুরো ক্লাসে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স।

খুব সহজ উত্তর- সেগমেন্টকে একটু শিফট করে অফসেটটা যোগ করলেই হয়ে যায়, অথচ কেউ পারছেনা। আমার ভেতরে ভেতরে কষ্ট হওয়া শুরু করল। অনুভূতিটা লিখে বোঝানো মুশকিল। আমি হাত তুলতে গিয়ে পারছিনা, পেটের ভেতর উত্তরটা লাফালাফি করছে অথচ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারছিনা। পুরো ক্লাসের উপর রাগ ওঠা শুরু করল।

এমন সময় কোন এক ছাত্র ভয়ে ভয়ে একটা উত্তর দিলো- যেটা সঠিক। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসলাম। ৩. বকা: বয়েজ স্কুল, বয়েজ কলেজে পড়েছি। বুয়েটকেও একরকম বয়েজ ইউনিভার্সিটিই বলা যায়।

অন্ততঃ আমার জন্যে তাই। নারীজাতিকে কোন এক অজ্ঞাত কারণে বরাবরই খুব ভয় পাই। গোটা স্টুডেন্ট লাইফে তাদের সাথে সব মিলিয়ে কয়টা বাক্য আদান-প্রদান করেছি তা আমি একদম সঠিকভাবে গুণে দিতে পারব। টিচার হবার পর শুরুতে মহা সমস্যার সৃষ্টি হলো। সেসনাল ক্লাসগুলো সবচেয়ে ভয়ংকর।

যে কোন মেয়ে স্টুডেন্টের প্রোগ্রাম দেখতে গিয়ে নিজেই নার্ভাস হয়ে পড়তাম। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সময় নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই এত অচেনা শোনাত যে নিজেই চমকে উঠতাম। উত্তরটা কান পর্যন্ত পৌঁছালেও ব্রেন পর্যন্ত পৌঁছাতো না। তড়িঘড়ি করে বেনিফিট অব ডাউটের ওপর ভিত্তি করে একটা মার্কস বসিয়ে দিয়ে কোনমতে পালাতে পারলে বাঁচি এই অবস্থা। আস্তে আস্তে এই অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করলো।

ভয় একটু একটু কমতে লাগলো, উত্তর শুনে বোঝা শুরু করলাম, এমনকি খুব প্রয়োজনে মৃদু বকাঝকাও শুরু হলো। এলগরিদমের সেসনালে একদম শেষের দিকের ক্লাসের একটা ঘটনা। আমার সাথে ক্লাস নেন- মাহমুদা নাজনীন ম্যাডাম আর মোয়াজ্জেম ভাই। সেদিন প্রোগ্রামিং-এর বদলে কাগজে কলমে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। পাশের খাতা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলে সেটা একটা গুরুতর অপরাধ এবং তার সর্বোচ্চ শাস্তিস্বরূপ ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হবে, এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন মোয়াজ্জেম ভাই।

ম্যাডামও সচকিতভাবে সবাইকে পাহারা দিচ্ছেন। আমি সেই সুযোগে কিছুক্ষণের জন্যে একটু টি লাউঞ্জ থেকে ঘুরে আসলাম। এসেই অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলাম। ম্যাডাম গায়েব; মোয়াজ্জেম ভাই পেছনে কোন এক ছাত্রকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আর সেই সুযোগে একেবারে প্রথম সারির তিনটি মেয়ে মহা আনন্দে দেখাদেখি করছে।

মাঝেরজন চেয়ার সরিয়ে বামপাশের জনের একেবারে কাছে গিয়ে বসেছে আর দুজনে মিলে আনসার স্ক্রীপ্টের লেখা নিয়ে মহা গবেষণা করছে। উপায়ান্ত না দেখে, নারী-পুরুষ বৈষম্য ভুলে, একজন দায়িত্ববান শিক্ষকের ন্যায় (জীবনের প্রথম) কোন ছাত্রীকে চিৎকার করে সাবধান করে দিলাম পরীক্ষার সময় পাশের খাতা দেখার অপরাধে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়- ছাত্রীটি আমার দিকে ভ্র“ক্ষেপও করলো না। আমি কনফিউজড হয়ে কাছে গিয়ে দ্বিতীয় দফা আরো কড়াভাবে ঝাড়ি দিলাম। তখন যেন ছাত্রীটি একটুর জন্যে আমার দিকে তাকালো।

এতক্ষণে পেছনের ছাত্ররা হো-হো করে হাসা শুরু করে দিয়েছে। কারণটা আর কিছুই না- মাঝের ছাত্রীটি হচ্ছেন মাহমুদা নাজনীন ম্যাডাম। তিনি পাশের স্টুডেন্টের অ্যাসাইনমেন্ট দেখছিলেন। যার সিটে বসে দেখছিলেন, সে বোধ হয় আগেই খাতা দিয়ে চলে গিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা বোঝার পর আমিও ছাত্রদের সাথে হাসিতে যোগ দিলাম।

৪. ‘ভা’- ‘মো’ - ‘গা’: একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো দ্বারা একেবারে পারফেক্ট জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তারপরও টিচার যখন হয়েছি গ্রেডিং তো করতেই হয়। সবসময় চেষ্টা করি সবার প্রতি যেন সুবিচার হয়। তারপরও ভাল একটা ছাত্র হয়তো আমার সামান্য ভুলে গ্রেড কম পাচ্ছে- এই ভয় থাকেই। সমস্যাটি নিয়ে খুব ভেবেচিন্তে অবশেষে একটি ইউনিভার্সাল সমাধান বের করে ফেললাম।

পদ্ধতিটি খুবই কাজের। যে কোন শিক্ষক এটিকে ব্যাবহার করে দেখতে পারেন। গোটা সেমিস্টারের ক্লাশ নেবার পর শেষ ক্লাসটি হাতে রাখি সকলের সাথে একটু মজা করে বিদায় নেবার জন্যে। এইদিন আমি রোলকলে পরিবর্তে প্রতিটি ছাত্রকে তার নাম ধরে ডাকি। ছাত্রটির সাথে এক-দুই বাক্যে কিছু একটা হাসি ঠাট্টা করি- ‘সেমিস্টার চলাকালে তুমি সবসময় এই কাজটা করতে’, ‘তোমার এই দুষ্টুমিটা খুব ভালো ছিলো’, ‘তুমি ক্লাসটেস্টে এই চালাকি করলেও আমি সেটা ধরে ফেলেছি’, ‘তোমার নামের সাথে আমার অমুক বন্ধুর মিল আছে- যে ক্লাসে এটা করত’, ‘তুমি যে সিটে বসে ক্লাস করছো সেটাতে আমি বসতাম’ ইত্যাদি।

পুরো ব্যাপারটায় সবাই খুব মজা পায়। ব্যাপারটা আমিও উপভোগ করলেও সবার অজান্তে এর সাথে সাথে আরেকটা কাজ গোপনে গোপনে করে ফেলি। আমার তিন রকমের মার্কার আছে- ‘ভা’, ‘মো’, ‘গা’। যাদের ভালো ছাত্র হিসেবে চিনি, তাদের নামের পাশে লিখে রাখি ‘ভা’, এদের A+ পাওয়া উচিত। যারা একটু চেষ্টা করলে ভালো করবে, তাদের নামের পাশে ‘মো’, কারণ তারা মোটামুটি ভালো ছাত্র।

আর যাদের নামের পাশে ‘গা’ লেখা, তারা হলো- গাধা ছাত্র। এদের দিয়ে কোনদিন কিছু হবে না। এই অভূতপূর্ব আইডিয়াটা আমাকে প্রথম দিয়েছিলেন আমাদের সবার প্রিয় তানভীর ইরফান ভাই। এই আইডিয়াকেই একটু মডিফাই করে এখন বেশ সুফল পাচ্ছি। বলাবাহুল্য, আমাদের ডিপার্টমেন্টে কোন স্টুডেন্টের নামের নামের পাশে কখনোই ‘গা’ লেখার প্রয়োজন পড়েনি।

৫. ০.৭- ০.৩: কায়কোবাদ স্যার প্রায়ই একটা কথা বলতেন, ‘০.৭- ০.৩ তে হবেনা’। তার অর্থ- শতকরা ৭০ ভাগ পড়ালেখা আর ৩০ ভাগ এসিএম প্রোগ্রামিং করলে ভালো করা যাবে না, একেবারে ১০০ ভাগ চাই। কথা নিখাদ সত্য। কোনটাই ভালোমতো হয়নি, এখনও হচ্ছে না। একই সাথে বুয়েটের টিচিং, নিজের মাস্টার্স, বিদেশ যাবার আগে শেষ মহূর্তের প্রস্তুতি, রান্না শিক্ষা, হালকা লেখালেখি-সবকিছু মিলিয়ে কোনটাই ঠিক মতো হচ্ছে না।

আসছে আগস্টে পিএইচডি করতে আমেরিকা চলে যাচ্ছি। স্যারকে এবার কথা দিতে চাই- বিদেশ গিয়ে শুধু পিএইচডি-টাই ১০০ ভাগ দিয়ে করার চেষ্টা করবো। পাঁচ বছরের অন্তত প্রথম দু-বছর। নিশ্চিতভাবেই, বাকিটা জানিনা। ইদানীং বাসায় নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে।

খুব বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ২৫ জুলাই, ২০০৮ বুয়েট

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।