আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দরগার ওরশ কিংবা আমার বালক বেলা (আমার শততম পোস্ট)

জীবনের গল্প বলে যাই গল্পের মতো করে...

খুব ছোটবেলা যখন আব্বার হাত ধরে দরগার ওরশ দেখতে যেতাম তখন পৃথিবীর তাবৎ বিস্ময় এসে ভিড় জমাতো আমার মনের জানালায়। কাস থ্রী-কিংবা ফার পড়ুয়া বালকের কাছে তখন দরগা ওরশের বসা দু’পাশের বাহারী খেলনার দোকানগুলো রীতিমতো লন্ডন-আমেরিকা দেখার মতো বিস্ময়ের। আর সেই বিস্ময় দেখার জন্যই সারা বছর ওরশের অপো থাকতাম। যখন শুরু হতো তিনদিনের ওরশ। তখন প্রথম দিন থেকেই সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আব্বার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিতাম।

তারপর আব্বা তার ব্যস্ততায় ফাঁক পেলে আমাদের নিয়ে যেতেন দরগার ওরসে বসা মেলায়। সেটা বেশি ক্ষেত্রেই বিকেল বেলা হতো। ওরশ শুরু হলেই আমরা অধির অপোয় থাকতাম কখন আব্বা বলবেন চলো। বলতেই যা সময় ভালো জামা পড়ে তৈরি হতে আমাদের ভাই-বোনের দেরি হতো না। তারপর দু’জনে আব্বার দুই আঙ্গুল আকঁড়ে ধরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তাম।

শাহ্জালালের দরগাহ্ শহরের প্রায় কেন্দ্র স্থলে। ওরশের সময় তাই শহরে হাঁটা-চলা কষ্টকর হয়ে যায়। রিক্সা-গাড়ি আর জনজট (মানুষের জটলা) ঠেলে আমদের এগুতে হতো বিস্ময় জাগানো খেলনার দোকানের দিকে। চোখ রাস্তার দু’পাশ জোড়া খেলনার দোকানের স্তরে স্তরে সাজানো বাহারী সংগ্রহের দিকে থাকলেও হাতটা চেপে থাকতো আব্বার আঙ্গুল। কারণ এই জনঅরণ্যে দুই বালক-বালিকার ভরসার তরী তো বাবার আঙ্গুল দুটিই।

নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমরা একে অন্যকে দেখে নিতাম। পছন্দের খেলনাগুলো দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে আব্বার কাছে কিনে দেয়ার আবদার করতাম। আব্বার মেজাজ ভালো থাকলে যেটা বলতাম সেটাই কিনে দিতেন আর যেদিন মেজাজ উল্টো থাকতো সেদিন ঝাড়ি খাওয়াও বিচিত্র ছিল না। সেই থেকে কখন জানি ভয়ের একটা বিষয় মনের মাঝে জায়গা করে নিয়েছিল। বছর ঘুরে আবারও ওরস এসেছে।

মেলা বসেছে দরগার দু’ধারের রাস্তা জুড়ে। কিন্তু ছোট্ট বেলার সেই আকর্ষণ জাগানো ওরসের এখন আর আমাকে টানে না। আমার পৃথিবীতে তো এরই মাঝে অনেক উলট পালট হয়ে গেছে। সেই ছোট্ট বালক আমি এখন অনেকখানি বড় হয়ে গেছি। এখন আর আব্বার আঙ্গুলে ধরে হাটতে হয় না।

দিন কিবা রাত আমাকে একলাই হাঁটতে হয়। আমি হাঁটি...। গতকাল অফিস থেকে যখন বেরুলাম ততণে ঘড়ির কাঁটায় রাত দুটো। বাসায় ফিরতে হলে আমাকে শাহ্জালালের দরগার পাশ দিয়ে যেতে হয়। গতকাল যখন বাড়ি ফিরছি তখন দরগা এলাকা জুড়ে অন্যরকম একটা রাত নেমেছে।

ওরশে অংশ নিতে আসা দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনের পদভারে রাত তার বিশেষত্ব হারিয়েছে। যেন সবে সন্ধ্যা নেমেছে এখানে। আমি দেখি। এই দৃশ্য দেখে যে কারই মন ভাল হওয়ার কথা। কিন্তু আমার হয় না।

বরং কোথা থেকে মনখারাপের বিষয়টা এসে আমার সঙ্গি হয়। আমি নিজের অজান্তেই কখন জানি ফিরে যাই আমার বালক বেলায়। যখন বাবা ছিলেন, একটা আঙ্গুল ছিল আকড়ে ধরার কিংবা চেনা জানা ঘরদোর, আঙ্গিনা আর স্কুলের রাস্তা আর স্কুল ঘর কেন্দ্রিক ছোট্ট পৃথিবীর বাইরে হঠাৎ আসা দরগার বৈচিত্রের আকর্ষণ। তখন তো চিন্তা বলতে ছিল পড়া আর পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা। কিন্তু এখন আর এসবের কিছুই নেই।

তার বদলে আছে রাজ্যের চিন্তা, বাস্তবতার কঠিন চেহারা, আর জীবন মন্ত্রের কুটিলতার প্রতি নিয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। ইস্! আবার যদি সেই ছোট বালক হতে পারতাম। আবার যদি আব্বার হাতের আঙ্গুল চেপে পরম স্বস্তি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারতাম। কিন্তু চাইলেই তো আর অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না। বাবাও নেই।

সেই বালক বেলাও নেই। তাই ওরশে যাওয়ার আকর্ষণও নেই। কত দূর থেকেই না লোকজন আসে ওরশে অংশ নিতে। আর আমি পাশে থেকেও বোবা অভিমান নিয়ে ওরশের পাশ কাটিয়ে বাড়ির পথ ধরি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।