যেহেতু আমি ত্রিশ বৎসর বয়সে আকস্মাৎ আর্বিভূত হই নাই এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে আরো দশজনের ন্যায় জন্মগ্রহন করিয়াছি ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছি সেহেতু আমার একখানা বর্ণময় ছেলেবেলা ছিলো। তবে তাহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা নির্মলেন্দুগুণের ছেলেবেলার মত প্রকাশযোগ্য কিনা তাহা লইয়া আমিও দ্বিধান্বিত। সেই বর্নময় ছেলেবেলার অনেক কিছূই আজ মনে পড়ে। স্মৃতি দ্বারা তাড়িত হই।
আমাদের ছেলেবেলায় ভোরে আর সাঁঝ বেলায় কাকেরা কা-কা রবেই ডাকিত।
এই অবহেলিত পক্ষীগোষ্ঠীর ভাষার বিবর্তন ঘটে নাই। আকাশ সংস্কৃতির অগ্রাসন আর আধা হিন্দি সিকি বাংলা ও সিকি ইংরেজীর মিশ্রিত ভাষার এই সময়েও তাহারা কা-কা রবেই ডাকে। কাকের কা-কা রবে পুরান ঢাকায় সকাল আসিত। দন্তু পরিচ্ছন্ন বুরুশ এবং দন্ত মলম (টুথপেষ্ট ও টুথব্রাশ) তখনও পুরাতন ঢাকাকে জয় করিতে পারে নাই। স্বাস্থ্য সচেতন অভিভাবকের পরম নির্ভরতা ছিলো কাঠ কয়লা এবং সাথে নিমক।
তাহা দিয়া দাঁত পরিস্কার করিয়া এবং মুখ ধৌত করিয়া আমরা কায়দা পড়িতে বসিতাম। দেহের সকল জোড় গলায় আনিয়া সুর করিয়া পড়িতাম আলিফ-বে-তে-সে...। আধুনিক হুজুরদের কল্যাণে তখনই এই সকল বর্নসমষ্টি আলিফ -বা-তা-সা হইয়া উঠিতে পারে নাই। গলায় সুর তুলিয়া কায়দা পাঠ করিতাম আর হাওয়ায় ভাসিত পরোটা ভাজিবার ঘ্রাণ। অতঃপর পড়া শেষ করিয়া (নাস্তা তৈরী হইবার পড়ে সংক্রিয়ভাবেই দৈনিক কায়দা পড়া শেষ হইয়া যাইত) নাস্তা খাইতে বসিতাম।
নাস্তা শেষ করিয়া আবার পড়া।
আমাদের ছেলেবেলায় একখানা চমৎকার বই ছিলো। তাহার নাম আদর্শলিপি। হলূদ রঙের প্রচ্ছদ। তাহাতে লাল রঙ্গে বড় করিয়া লিখা থাকিত ”আদর্শলিপি”।
আর বই-এর লেখক/সম্পাদক সীতানাথ বসাকের নাম লিখা থাকিত সবুজ রঙ্গে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এই বইখানাকে দেশ ছাড়া করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়। তবে ত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত বেশীরভাগ বাঙ্গালীর হাতে খড়ি এই বইখানার মাধ্যমেই হইয়াছে। এই বইখানাতেই প্রথমে পড়িতে শিখি ” সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। ” অথবা “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।
” প্রতিদিন এই সকল কবিতা পরিতাম। কৃষ্ণকায় ছাগের ব্য-ব্যা ছড়া (ব্যা ব্যা ব্লাকশিপ) পুরাতন ঢাকার বাতাসে তখনও পায়চারি শূরু করে নাই। এই পুস্তকের মাধ্যমেই নীতিবাক্য আমাদের মনের মধ্যে গাথিয়া দেওয়া হইয়াছিলো। যেমন, “ সদা সত্য কথা বলিবে” অথবা ”ঋষিবাক্য শিরোধার্য” অথবা “আলস্য করিওনা” প্রভৃতি। ছেলেবেলার সহিত এই পুস্তকখানি মিশিয়া আছে পরিপূর্ণভাবে।
পুনশ্চঃ
আমাদেন নেতা-নেত্রী, আমলাবৃন্দ এবং নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ, উপদেষ্টা মন্ডলীর কথা শুনিয়া এবং আচার-আচরণ দেখিয়া মনে হয়না তাহারা এই শস্তা দামের অমূল্য পুস্তকখানা পড়িয়াছেন। কারণ এই পুস্তকের সাধারন বাক্যগুলো মানিয়া চলিলেই অনেক সমস্যার সামাধান হইয়া যাইতে পারে। আগামী সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনের সকল প্রার্থীর জন্য আদর্শলিপি বইখানা অবশ্য পাঠ্য করা উচিত। তাহাতে যদি তাহারা কিছু শিক্ষা গ্রহন করিতে পারেন।
(নির্বাচনের পুর্বে অন্য একটি জনপ্রিয় ব্লগে এই লিখাটি লিখিয়াছিলাম।
ডিজিটাল যুগে এনালগ আদর্শলিপি খানা এনালগ মোমবাতির এনালগ আলো দ্বারা পড়িয়া যদি আমাদের এনালগ মানসিকতা ঋদ্ধ হয় সেই আশায় এই লিখাটি পোস্ট করিলাম। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।