ক্রান্তিকালের নির্বাচন ও গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্ররক্ষকেরা
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------------------------------------------------------
একটি রাষ্ট্রের রক্ষক কিংবা ত্রাতা কখনই কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী হতে পারে না। একটি দেশে তার নিজস্ব প্রকল্পের পরিভ্রমণ থাকে। প্রজন্ম বেড়ে ওঠে। যোগ্য নেতৃত্ব সামনে এগিয়ে আসে। এক সময় তারা রাষ্ট্রের নেতৃত্বভার গ্রহণ করে।
এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। এই নিয়ম থেকে ব্যত্যয় যে ঘটে না তা বলছি না। কিন্তু মানুষের অগ্রসরমাণ চেতনাকে দমিয়ে রাখা যায় না। উচিতও নয়।
একটি দেশে দু’ চার শ’ দুর্নীতিবাজ নেতা নির্বাচন করতে না পারলে সে দেশের রাজনীতি থমকে থাকার কথা নয়।
কারণ প্রতিটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বলয় থাকে। সামনের সারিটি ব্যর্থতার জন্য কুপোকাত হলে পেছনের সারি সামনে চলে আসে এবং দায়িত্ব নেয়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তেমনি নানা মেরুকরণ হচ্ছে। দেড় দু’ শ’ নেতা এমপি পদে প্রতিদ্বëিদ্বতা করতে পারবেন না বলে সংবাদ বেরুচ্ছে পত্রপত্রিকায়।
কেন তারা নির্বাচনের মাঠে খেলোয়াড় হতে পারবেন না তা কারও অজানা নয়। এরা হয়তো দণ্ডিত। না হয় মামলার সম্মুখীন। দেশের নির্বাচনী আচরণবিধিকে সম্মান করলে তাদের উচিত নিজে থেকেই সরে দাঁড়ানো; কিন্তু তারা তা হয়তো করবেন না। তাই বাধ্য হয়েই তাদের অকার্যকর করে দেয়ার কথাটি আসছে।
কথা হচ্ছে যারা দুর্নীতিবাজ বলে প্রমাণিত তারা আবার জনপ্রতিনিধি হতে যাবেন কেন? তারা তা হতে চান নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। এ জন্য তারা মরিয়া। মারমুখো হয়ে নানা ধরনের জঘন্য আচরণ করছেন প্রকাশ্যে। টিভিতে একটি সচিত্র প্রতিবেদন দেখলাম। বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দিন পিন্টু একজন জেল পরিদর্শকের ওপর চড়াও হয়েছেন।
নাছির আহমেদ নামক এই পুলিশ অফিসার প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পিন্টু তাকে ঘুষি মেরেছেন। কি বর্বর আচরণ। কি জঘন্য হীনম্মন্যতা। জেলে থেকে যে রাজনীতিক এমন আচরণ করতে পারছে বেরিয়ে এলে তার আচরণ কেমন হবে? এ রকম নেতাই আজ বিএনপি থেকে ভোটে দাঁড়াতে চায়। এরাই হতে চায় এই দেশ এই জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষক? এমন নানা কঠিন এবং জটিল প্রশ্নগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
দেশের একটি প্রধান দল বিএনপি খাবি খাচ্ছে তাদের নিজেদের তৈরি জলাশয়ে। কারণ তারা এমন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে দানবতন্ত্র বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেসব দানব এখন দলছুট। কেউ বিদেশে, কেউ পলাতক, কেউ জেলে, কেউ গণবিচ্ছিন্ন। এসব রাষ্ট্ররক্ষক নামের দানবরা জেলে থেকেই যে কতটা ভয়ঙ্কর সেটাই প্রমাণ করেছে পিন্টু নামের সাবেক সাংসদ।
বিএনপি আসলে কি চাইছে? তারা কি চাইছে তাদের সেই পরিকল্পিত নির্বাচন? যদি তা না হতো তবে তারা একের পর এক দাবি দিয়ে মাঠ ঘোলা করার চেষ্টা করছে কেন? তাদের দাবি মেনে মনোনয়নের মেয়াদ বাড়ানোর পরও খন্দকার দেলোয়ার ‘সাজানো’ পাতানো নির্বাচনের গ খুঁজে বেড়াচ্ছে কেন?
বিএনপির সন্দেহকে পাকাপোক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনার ১৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনের জোর দাবির মাধ্যমে। শেখ হাসিনা কিছুটা বেশি আগে বেড়ে এমন দাবির সীলমোহরটি না মারলেও পারতেন। কেউ না এলেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে কিংবা ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হতেই হবে এমন দৃঢ় দাবির মাধ্যমে শেখ হাসিনা অদরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই আমি মনে করি। কারণ এটা ধ্রুব সত্য, কেয়ারটেকার সরকার তাদের হিসেব না মিললে সহজে নির্বাচন দেবে না। আর বিএনপিবিহীন নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ হবে ক্ষণস্খায়ী।
তাই বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন করতে আগ্রহী সরকার। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার উচিত ছিল, পরিস্খিতি গভীর পর্যবেক্ষণ করে বরং নিজের দলও জোটকে আরও সংগঠিত করা। তা না করে শেখ হাসিনা তদারকি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কেন অগ্রণী হতে চাইলেন তা বোধগম্য নয় কোন মতেই।
দুই.
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন নতুন যোগ-বিয়োগ লক্ষ্য করছি আমরা। জামিন না দিয়ে নিজামী, মুজাহিদ সাইফুর রহমানকে জেলে পাঠানো হয়েছে।
লক্ষ্য হচ্ছে এদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। তারা আবার জামিনে বেরিয়ে আসবেন কিংবা সহজেই জামিন পাবেন ঘটনাবলীর চলমানতা আপাতত সে সাক্ষীই দিচ্ছে। এদিকে ড. কামাল, বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকীরা নতুন ফ্রন্ট গঠনের ডাক দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের প্রস্তাবিত ফ্রন্টের সব দল মিলিয়ে দেশে তাদের জনপ্রিয়তা কত শতাংশ? প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এমন জেলা আছে যেসব জেলার মানুষ বিকল্প ধারা, গণফোরাম কিংবা কল্যাণ পার্টির নামও জানে না। তা হলে তো সংস্কারের নামে এসব ফন্সন্টবাদীরা বরং ডানপন্থী মোর্চার পারপাসটাই সার্ভ করছেন।
যোগ্য প্রার্থী দেয়ার নামে কিছু ভোট কেটে নিয়ে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন। তারা সমমনা বড় দলের মোর্চায় যোগ দিয়েই বরং এই ক্রান্তিকালের নির্বাচনটি পার হতে পারতেন। তারা তা করছেন না। যা জাতির জন্য মোটেই কল্যাণকর নয় এ মুহর্তে।
দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরী বলেছেন, জামিন পাওয়া আর মামলা থেকে অব্যাহতি এক কথা নয়।
দুদক চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করে বলেছেন, তারা আসামিদের প্রমাণপত্র সাপেক্ষে সুবিচারের মুখোমুখি করতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখছি প্রধান দুই নেত্রীকে প্রায় সবক’টি মামলা থেকেই ক্রমশ অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। তাহলে বাকিদের ব্যাপারে কি হবে? তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত নিউইয়র্কে বলেছেন, ওয়ান ইলেভেন মূলত ছিল আমাদের কোমর ভেঙে দেয়ার একটি প্রচেষ্টা। হঠাৎ করে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে রাজনীতি স্খবির করে দেয়া মাত্র।
কার্যত সেটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এবং এর রেশ ধরে নির্বাচন হবে কি না তা নিয়েও সংশয়ে ভুগছে দেশবাসী। মানুষ এটাও লক্ষ্য করছে, ব্যারাকঘেঁষা এক শ্রেণীর মুখপাত্র সাংবাদিক ইতোমধ্যে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ‘খোলা সুপারিশ নামা’ও পেশ করতে শুরু করেছেন। তা হলে কি এই ক্রান্তিকাল দীর্ঘ করার কোন গোপন ইচ্ছে কোথাও লালিত হচ্ছে?
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন। দেশের প্রজন্মকে বাড়িয়ে তোলার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন।
জরুরি আইন কখনই কোন রাষ্ট্রে স্খায়ী সমাধান দেয় না, দিতে পারে না। জরুরি আইন গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্ররক্ষকদের মানুষের কাছে চিহ্নিত করে যায়। আর মানুষ তা থেকে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে শেখে।
নিউইয়র্ক ১১, নভেম্বর ২০০৮
---------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ১৪ সেপ্টম্বর ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।