আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রান্তিকালের রাষ্ট্রপতি ও রাজনীতিকদের দেশপ্রেম

ক্রান্তিকালের রাষ্ট্রপতি ও রাজনীতিকদের দেশপ্রেম ফকির ইলিয়াস =========================================== সম্মানিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন জনাব আব্দুল হামিদ এডভোকেট। দেশের কৃতী স্পিকার ছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে। তিনি যে রাষ্ট্রপতি হবেন, তা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। আরো কয়েকটি নাম উচ্চারিত হলেও তিনিই যে বেশি গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।

আব্দুল হামিদ গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। তৃণমূল রাজনীতিক বলতে যা বোঝায়, তিনি তার প্রতিকৃতি। তার এলাকার মানুষের কাছে তিনি কিংবদন্তিতুল্য। বারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। মাননীয় স্পিকার হয়েছেন।

এটা তার দেশপ্রেমের প্রতিদান। আমি খুব সুদৃঢ়ভাবে বলতে পারি, তিনি এদেশের একজন পরিশীলিত, পরীক্ষিত রাজনীতিক। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সরকার চলতি বছর আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। এ উপলক্ষেই জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার শুরুতে আবেগাপ্লুত আব্দুল হামিদ রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘এই সংসদে আমি ৪২ বছর কাটিয়েছি।

আজকের দিনটা আমার জন্য বিষাদের। যেখানেই থাকি মন এখানেই থাকবে। ’ তিনি বলেন, ‘আমি হয়তো বঙ্গভবনেই থাকবো। তবে অন্য রাষ্ট্রপতির চেয়ে আমি বেশি সংসদে আসবো। ’ আব্দুল হামিদ বলেছেন- ‘এমন এক সময়ে আমি দায়িত্ব পাচ্ছি, যখন রাষ্ট্রের জন্য ক্রান্তিকাল।

আল্লাহ জানে কী করে ইজ্জতের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবো। ’ হ্যাঁ, দেশ এখন চরম ক্রান্তিকালের মুখোমুখি। যারা খোলস পরে ছিল- তাদের মুখোশ খসে পড়তে শুরু করেছে। খবর বেরিয়েছে, আমার দেশের পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অনশন ভাঙার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী। চিঠিতে মাহমুদুর রহমানকে উদ্দেশ করে আল্লামা শফী বলেন, ‘সরকার আপনাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছে।

আপনার পত্রিকা অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি পত্রিকা চালু, গ্রেপ্তারকৃত ১৯ জনকে মুক্তি ও আপনার মায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে যে অনশন শুরু করেছেন এটা অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ’ তিনি বলেন, ‘আপনি নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এখন আপনি জেলে থেকে এই সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। এর জন্য আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।

’ আল্লামা শফী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই আপনাকে গ্রেপ্তারে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। আবারো এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আপনি এই অনশনের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আপনার এই প্রতিবাদ ইতিহাস হয়ে থাকবে। ’ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বুঝা যাচ্ছে, হেফাজতে ইসলামের মূল চাল কোথা থেকে এসেছে।

এ বিষয়ে এটিএন নিউজে কিছু চমৎকার কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবী ড. সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেছেন, এসব ঘটনার মূল নেপথ্য নায়ক ফরহাদ মজহার ও মাহমুদুর রহমান। যারা ‘ইসলামি যোশের’ কথা মিথ্যা ভরপুর করে কাগজে ছাপিয়ে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করেছে। এরাই হেফাজতের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দিচ্ছে। আর ম্যাডাম জিয়া এটাকে ‘গণহত্যা’ বলতেও কসুর করছেন না।

হেফাজতে ইসলাম যে জামাতের পারপাস সার্ভ করছে, তা এখন আর লুকানো বিষয় নয়। আর সরকার চাইছে ডিভাইড এন্ড রুল। তারা চাইছে ‘কিছু ভোটও যদি হেফাজতের কাছ থেকে পাওয়া যায়!’ খবর বেরিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দলটি আগের অবস্থানেই রয়েছে। পাশাপশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপি ছাড়াই নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করা হবে বলে আওয়ামী লীগ। যদি তাই হয়, তাহলে এদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত কী? সে প্রশ্নও আসছে।

এটা নিশ্চিত, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন বিশ্বমহলে গৃহীত হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যদি নাও আসে, সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতেই হতে পারে নির্বাচন। এটা করার জন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। আমরা অতীতে দেখেছি, বিএনপিও সংবিধান রক্ষার নামে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করতে চেয়েছে। যা এদেশের মানুষ মেনে নেয়নি।

মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগও। তাহলে আজ বিএনপি একতরফা আওয়ামী লীগের ‘সংবিধানের দোহাই’ মেনে নেবে কেন? দেশের মানুষের স্বার্থ দেখার নামই রাজনীতি। খুবই দুঃখের কথা এদেশে সেই পলিটিক্যাল কালচার চালু হয়নি। আর হয়নি বলেই এই চরম দুর্গতি অতিক্রম করছে গোটা জাতি। সেই সুযোগে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তি ঢুকে পড়ছে ‘প্রগতিবাদী’ দাবিদার রাজনীতিকদের পকেটে।

বাংলাদেশ একটি চরম সংকটকালের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। অনেক দুঃসংবাদ এখন বাংলাদেশের ভাগ্যে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে পোশাক শিল্পের বিদেশী ক্রেতারা। নতুন ক্রেতা তো আসছেই না, পুরোনোরাও খুঁজছেন নতুন বাজার। হরতালসহ রাজনৈতিক নানা অস্থিরতায় পোশাক শিল্পের বিদেশী ক্রেতারা নতুন বাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যেই যোগাযোগ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।

বছর খানেক আগে বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ব্যবসায়ী মহল থেকে। বিজিএমইএ এর সহ-সভাপতি মোঃ শহীদুল্লাহ আজীম বলেছেন, ‘পোশাক শিল্পের ক্রেতা তৈরি করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে মালিক ও শ্রমিকদের। অথচ এতো কষ্টের পর যখন অর্ডার পাওয়ার সময়, তখনই পিছিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের ক্রেতারা। চলতি মৌসুমই ছিল ওসব দেশের সিজন। কিন্তু তারা আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।

সুতরাং অর্ডারও সেভাবে পাওয়া যাবে না। ’ দেশের পোশাক শিল্পের কর্ণধাররা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা উচিত, দেশের অর্থনীতির ওপর আঘাত আসা মানে পরোক্ষভাবে দেশের জনগণের ওপরই আঘাত আসা। আর তাদের এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া উচিত না যাতে করে দেশের অর্থনীতি ও মানুষ বিপদে পড়ে। কারণ পোশাক শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ৪০ লাখ কর্মী ও তাদের পরিবারের জীবন জড়িত। এভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশের কোটি কোটি মানুষই বিপদে পড়বে।

দেশ যে এভাবে বিপন্ন হচ্ছে, তা কী অনুধাবন করছেন রাজনীতিকরা ? না করছেন না। কারণ তাদের বিশেষ কোনো গরজ নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশগামী। আর দেশের গরিব মানুষরা প্রতিদিন যুদ্ধ করছে অনেকগুলো অনিশ্চয়তার মাঝে। দেশের আজ প্রধান সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগের লালসা।

ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের ভারসাম্যতা রক্ষা প্রসঙ্গে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, প্রয়াত শিবনারায়ণ রায়ের একটি কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। শ্রী রায় নিউইয়র্কে এলে তার সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রখর মানবতাবাদী শিরনারায়ণ রায় খুব তীক্ষè কথাবার্তা বলতেন। বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ে তার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘বুর্জোয়া শ্রেণীর কাজই হচ্ছে চোরাগোপ্তা রক্ত ঝরিয়ে তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য তারা যে কোনো মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং উসকানিকে নিজের দরকার মতো প্রশ্রয় দেয়। ’ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য উদার কিছু মানুষের দরকার। জিল্লুর রহমান কিংবা আব্দুল হামিদ এই আওয়ামী লীগ থেকেই উঠে আসা মানুষ। জাতির জনকের চেতনায় বলীয়ান শক্তি এরা। এদেশে এমন রাজনীতিকের জন্ম যতো বেশি হবে ততোই মঙ্গল হবে দেশ ও জাতির।

আমি খুব সুদৃঢ়ভাবেই মনে করি রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবতার সৌন্দর্য নির্মাণ। আর তা নির্মাণ করার প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে ভোগহীন মানসিকতা গড়ে তোলা। মনে পড়ছে, ২০০৫ সালের এক গ্রীষ্মে নিউইয়র্কের পঞ্চম এভিনিউ দিয়ে গ্রিক ডে প্যারেডের মার্শাল হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের প্রভাবশালী সিনেটর চার্লস শুমার। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির সামনে থেকে তার সঙ্গে খোলা প্যারেডে আমিও হেঁটে গিয়েছিলাম প্রায় দুমাইল। এ সময় তিনি নিউইয়র্কের প্রাচীন ল্যান্ডমার্ক ভবনগুলোর সামনে দিয়ে যেতে যেতে নানা স্মৃতিচারণ করছিলেন।

বলেছিলেন, তার কৈশোরে দেখা নিউইয়র্ক মহানগরীর কথা। সিনেটর শুমার বলেছিলেন, স্টেটের আইন অনুযায়ী এসব ল্যান্ডমার্ক ভবন ভাঙা যাবে না বলে আইন রয়েছে। এসব ভবন সংস্কার, পুনর্নির্মাণ করতে হলেও ল্যান্ডমার্ক চিহ্নগুলো রেখে সরকার পক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে। শুমার বলেছিলেন, রাজনীতিকরা শুধু আইন প্রণয়নই করেন না রাষ্ট্র সম্পত্তির চৌকিদারিও তাদের করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন নিসর্গ পাহারাদার কবে পাবো আমরা? শুরুতেই বলেছি, চরম সংকটের মাঝেই দায়িত্ব নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

তার পাঁচ বছর এই পদে থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু যদি তার দল আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিততে না পারে, তাহলে তার পথ খুব কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। তাকে অন্য পক্ষ ইমপিচও করতে পারে। সব মিলিয়ে একটা দ্বিধার সমুদ্র সামনে রেখেই তিনি বঙ্গভবনে যাচ্ছেন। তবুও কামনা- তার চলার পথ আলোকিত হোক।

তিনি এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি। আর সেই মানুষদের আশাই হোক তার মননের প্রতিভূ। অভিনন্দন আপনাকে, প্রিয় রাষ্ট্রপতি। ----------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // : শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।