আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেহেতুক অহেতুক- ২

বৃথা হয়রানি

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে দীর্ঘ তিন বছর ধরে দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ‘যেহেতুক অহেতুক’ শিরোনামে এ নিবন্ধগুলো লেখি। একেবারে সাধারণ মানুষ, এসব সমস্যা ও সংকটকে কিভাবে দেখছেন, কি ভাবছে- তা এ লেখাগুলোর উপজীব্য। কিছুটা গল্পের ছলে, কিছুটা বিদ্রƒপে, কিছুটা আবেগে পরিম্লান হয়েছে সেসব প্রান্তজনের কথা। লেখাগুলোকে যতটা সম্ভব তথ্য ও যুক্তি নির্ভর করে তোলার চেষ্টা করেছি। আশা করি লেখাগুলো পড়ে পাঠক আবার ফিরে যাবেন অতীতের দিনগুলোতে।

এবং মূল্যায়ন করবেন আমাদের সাফল্য ও বিফলতা। হয়ত এর মাধ্যমে একটা আত্মোপলব্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। একসময় জনরোষের মুখে ইরাজ উদ্দিন সরকারের পতন হয়। নতুন সরকার। নতুন হইচই।

বড়ো স্বপ্নাতুড় চোখে আমরা তাকিয়েছিলাম। অনেক আশা ছিল। অনেক নির্ভরতা। সময় বলে দেবে আমাদের স্বপ্নের ভারকেন্দ্রটা ঠিক ছিল কিনা। অনিল কাপুর কাঁদে, ঘুমের ঘোরে মনে পড়ে আমার সেই পুলিশ বন্ধুর কথা, বাগেরহাটের এক ফাঁড়ির ইনচার্জ, বাঘ-ভাল্লুক আর চরমপন্থীর সঙ্গে যার সহবাস; ত্রিশ টাকা কেজির পাবদা আর দশ টাকার শিম খেয়ে যার চেহারা অনেকটা অনিল কাপুরের মতো হয়ে গেছে, আজ আবার তার কথাই লিখছি।

কিছুদিন আগে তার একটা সমস্যা ধরা পড়ে। একটা রোগ। সে প্রতিদিন মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে কাঁদে, ডুকরে ডুকরে কাঁদে, কিন্তু কেন? পুলিশ কেন কাঁদে! স্কুল থাকতে আমরা কখনো কল্পনাই করিনি অনিল পুলিশ হবে। পুলিশকে ঘিরে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো খুবই করুণ ও বীভৎস। আগে একটা রেওয়াজ ছিল, কখনো শহরে রাষ্ট্রপতি এলে জল সেচে কই ধরার মতো শহরের সব স্কুল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাচ্চা ধরে এনে রাস্তার দুপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হত।

এভাবে আমাদেরও নিয়ে যাওয়া হত স্কুল থেকে। আমরা রেলের লকঝকে মুড়ির টিনটায় চড়ার লোভে সানন্দে লাইন দিতাম। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হত কাটফাটা রোদের মধ্যে। বলা হত সকাল দশটায় প্রেসিডেন্ট আসবেন, তাই ঘন্টাখানেক আগে গিয়েই আমরা দাঁড়িয়ে যেতাম। হাতে স্যারদের দেয়া রং-বেরঙের পতাকা আর ফেস্টুন।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট সাহেব কখনোই সকাল ১০টায় আসতেন না, আসতেন দুপুর দুটো তিনটে বাজিয়ে। এতোক্ষণে আমাদের প্রাণ ওষ্টাগত। কেউ মাথা ঘুরিয়ে পড়ে লাইন থেকে। কানফাটা হর্ন বাজিয়ে প্রেসিডেন্টের কনভয় আসত দেওয়ানহাট ব্রিজের ও-মাথা থেকে। আমাদের স্কাউট টিচার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে উঠতেন।

আমরা বেদনাক্লিস্ট মুখে পতাকা নাড়িয়ে একটা লম্পট লোককে অভিনন্দিত করতাম। আমাদের কেউ কেউ আবার অত্যুৎসাহে প্রেসিডেন্টের গাড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে দিত। কখনো সখনো কি বুঝে গাড়িটা থেমে যেত, কালো উইন্ডশিল্ড নামিয়ে কটা কটা চেহারার এক লোক হাত বাড়াতেন। সেই করযুগল মর্দনের জন্য রীতিমতো হুড়োহুড়ি লেগে যেত আমাদের মধ্যে। ক্লাস ফাইভে থাকতে এরকম একটা হুড়িহুড়িতে পুলিশের রাইফেলের কুঁদোয় বাড়ি খায় অনিল।

ফেরার পথে ব্যথায় ঝরঝরিয়ে কেঁদেছিল বেচারা। আরেকবার ক্লাস এইটে পড়তে, প্রশ্নব্যাংক নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে একটা রাম-প্যাঁদানি খেয়েছিলাম আমরা। নাছরুল আম-ছিলার ছুরিসহ এ্যারেস্ট হয় পুলিশের হাতে। নাছরুলকে ছাড়িয়ে আনতে তার বাবার নাকি পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল! তখন তো পাঁচশ টাকাই অনেক। আরো পরে শুনলাম বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ।

তাই আমরা কখনো ভাবিনি আমাদের কোন সহপাঠী পুলিশ-দারোগা হবে। অনিলের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। পার্টি করার সুবাদে একটু আগে আগেই ও পেকে গিয়েছিল। অনিল কথায় কথায় বলত, বিপ্লব হবে বিপ্লব, লাল বিপ্লব- আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, বিপ্লবের সঙ্গে আবার ডাক্তারির কি সম্পর্ক? বিপ্লবই যদি করতে চাও, অস্ত্র চালানো শেখো, আর্মি হও। অনিল হাসে।

হাসলে তার দুগালে টোল পড়ে। একদিন ফাঁকা ক্লাসে তার টোল পড়া গালে টপাস করে একটা চুমু দিয়ে দিয়েছিল পেয়ারুল। এই ‘সাক্ষী গোপাল’ ছাড়া সে দৃশ্য আর কেউ দেখেনি। পরে জানলাম পৃথিবীর অনেক বড়ো বিপ্লবী নাকি একসময় ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু ক্লাস নাইনে ওঠার সময় সে অংকে ৩৫ পাওয়ায় তার স্বপ্ন দেয়াল চাপা পড়ে।

সে যায় কমার্স গ্রুপে। আমাদের স্কুলে পড়াশোনা যাই হোক, স্যাররা ডিসিপ্লেনের ব্যাপারে ছিলেন খুব কানখাড়া। ইউনিফরম বলতে প্লেইন সাদা শার্ট-সাদা প্যান্ট, এর মধ্যে কোন নকশা-টকশা থাকতে পারবে না। শার্টের নিচে থাকবে হেশিয়ারির হাতকাটা সাদা গেঞ্জি, কোন রংটং চলবে না। কোনভাবে সাদার সফেদ পবিত্রতা যাতে ক্ষুন্ন না হয়।

নাইনে উঠে আমাদেরই কেউ কেউ স্টাইল করে লাল-হলুদ গলাবাধা গেঞ্জি পরে আসত শার্টের নিচে। এতে মেয়েলি গড়নের কণ্ঠাহাড়টা ঢেকে গিয়ে একটা পুরুষালি দীপ্তি আসত গ্রীবায়। কিন্তু ওই একবারের জায়গায় দ্বিতীয়বার গেঞ্জি পরে আসেনি কেউ। সেই পাপের স্মারক হিসেবে শহীদ স্যারের জোড়া বেতের দাগ এখনো আমাদের অনেকের দেহে আছে। কিন্তু পোশাক নিয়ে সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাটা ঘটালো অনিল।

একদিন গোঁফ-দাড়িঅলা এক যুবকের ছবি আঁকা গেঞ্জি পরে এলো শার্টের নীচে। পাতলা পলিস্টারের শার্টের নীচ থেকে সেই ছবিটা জলছাপের মতো ভেসে উঠল। এ্যাসেম্বিলিতে দাঁড়িয়ে ওকে কানে কানে বল্লাম, আজ তোর কপালে গর্দিশ আছে, দেখিস- ও শিশ্ দিয়ে উড়িয়ে দেয় আমার উৎকণ্ঠা। প্রথম ক্লাসেই সে ধরা খেলো। জলদগম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন শহীদ স্যার।

ডাকতে ডাকতেই তাঁর জোড়া বেতের জয়েন্টগুলো ঠিক করে নিলেন। না জানি আজ কত মার আছে গোঁয়ারটার কপালে। খোল, শার্ট খোল। সুবোধ বালকের মতো চটাচট সে শার্টটা খুলে ফেলল। অনিলের বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ে চশমটা ঠিকঠাক করে কি যেন দেখলেন স্যার।

এই গেঞ্জি তুই পাইলি কই! বিস্মিত হয়ে বললেন শহীদ স্যার। অনিল দাঁত কেলিয়ে হাসে। আমারে একটা দিতে পারবি? পরের দিন একই গেঞ্জি গায়ে হাজির হলেন শহীদ স্যার। অবশ্য অনিলের মতো শার্টের তলায় নয়। নিজের বুকে আঙুল দিয়ে বললেন, চিনিস উনাকে? আমরা পাঠশালার বাচ্চাদের মতো একসুরে বলে উঠলাম, না! উনি হলেন চে গুয়েভারা।

চিরবিপ্লবী চে’। আমরা সবাই মনে মনে বল্লাম, তাতে আমাদের কি? এই অনিলই একদিন আমাকে বল্ল তড়াতাড়ি ‘গর্ভধারিনী’ পড়ে নে, মিশন আছে। তখন আমরা কলেজে। বুঝতেই পারছেন আমরা কি মিশনের আটঘাট বেঁধেছিলাম! সেই অনিল এখন বিপ্লব আর বন্দুকের কথা বললে জলন্ত উনুনে পড়ার মতো লাফিয়ে ওঠে। চরমপন্থা! চরমপন্থী হবি, কতগুলো ডাকাতের সর্দার হবি, তোর বিপ্লবের থিউরি দিয়ে বখাটেগুলো তাদের খুন-খারাবি হালাল করবে! লাখ লাখ টাকা আসবে! যখন যে মাল দিবে তার হয়ে নির্বাচনের কাজ করে দিবি! ফুললি ডিলিউডেড! মনে রাখবি অস্ত্র অস্ত্রই... সে তার বাঘেরহাটের স্মৃতি বলে আমাদের।

চরমপন্থীদের দিয়ে লোকাল লিডাররা কি না করছেন। চিংড়ির ঘের দখল, চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষের লাশ ফালানো, ডাকাতি, মাঠ থেকে শ্যালো ইঞ্জিন লুট ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষ রীতিমতো জিম্মি। তা তোরা আছিস কেন? আমরা সবাই তাকে চেপে ধরি। তাহলে শুন্।

অনিলের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। গত বছরের ঘটনা। আমি ফাঁড়িতে এসেছি দুসাপ্তাহও হয়নি। এলাকার হাবভাব বুঝে উঠতে পারিনি। আমাদের ফাঁড়ি থেকে মাত্র এক ফার্লং দূরে এক গেরস্ত বাড়িতে ডাকাতি হলো।

সকালে ফোর্স নিয়ে গেলাম। খুব লজ্জ্বা লাগল, এক ফার্লং দূরের একটা বাড়ির সিকিউরিটি দিতে পারি না, আবার মাইলের পর মাইল এলাকার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছি। মাথায় রোক চাপল। সোর্স লাগালাম, নিজের মতো করে ইনক্যুয়ারি করতে লাগলাম। সে সূত্রধরে ডাকাতদের একটা অবস্থান জানতে পারলাম।

পাশের গ্রামের কৈলাশভিটায় এদের আস্তানা। রাতে লাইন ধরে বিপ্লবের শ্লোগান দিতে দিতে ডাকাতিতে যায়। আমার যা ফোর্স তা দিয়ে রাতে ওদের ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। তাই দিনেই রেইড দিলাম কৈলাশভিটায়। ভাগ্য ভালো, অস্ত্রসহ ধরা পড়ল ডাকাত সর্দার।

তাকে ধরে নিয়ে এলাম ফাঁড়িতে। কিছুক্ষণ পরেই এক নেতা গোছের লোক এসে বলল ডাকাত সর্দারকে ছেড়ে দিতে, এটা এমপি সাহেবের নির্দেশ। আমার মাথার ভেতর ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। লোকটার কত বড় স্পর্ধা! আমি ঝাড়ি মেরে ব্যাটাকে বিদায় করে দিলাম। বিকেলে স্বয়ং এমপি আমাদের সার্কেল এএসপিকে নিয়ে হাজির।

তার পর কি হয়েছিল, আমি তোদের বলতে পারব না- কিন্তু এসব কথা কেন লিখছি, কথা ছিল অনিলের সমস্যাটা নিয়ে দুকথা লিখে ইস্তফা দেব, এতো কথা তো নয়। আসা যাক তার রোগ প্রসঙ্গে। গত ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেই ধরা পড়ল তার এই রোগটা। সে ঘুমের ঘোরে কান্নাকাটি করে। খাল্লাম্মা অনিলের এই অবস্থা দেখে জেগে জেগেই কাঁদতে শুরু করলেন, আমার সোনার টুকরা পোলার একি হইলো! এই শহরের মস্তো মস্তো সব পাগলের সঙ্গে আমার পরিচয়, সেই সূত্রে দুয়েকজন পাগলের ডাক্তারও আমাকে চেনেন।

তাই খাল্লাম্মা অনিলকে আমার হাতেই সঁপে দিলেন। ডাক্তার আমাকে পেয়ে জমিয়ে আড্ডা লাগালেন। তার লেখা বাঁশ-ঘাস-মার্কা একটা কবিতার বইও আমাকে প্রেজেন্ট করলেন। আমি তাকে অনিলের সমস্যাটা বলি। সবশুনে উনি অন্যমূর্তি।

মুখটা খুব গম্ভীর করে আমাকে বাইরে যেতে বললেন। দেড় ঘন্টা পর ডাক পড়ল। তার সমস্যাটা হয়েছে একটা মানসিক শক থেকে, ডাক্তার মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন। সেই শকটা তার ইদ অর্থাৎ অবচেতন মনে একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সেই ক্ষত থেকেই সে ঘুমের ঘোরে কাঁদে।

কিরে ব্যাটা শকটা কি, কোন মাইয়ার ছ্যাকা-ট্যাকা খাইছিস নাকি? নাহ নাহ, ওকে এভাবে প্রশ্ন করা যাবে না। এটা ওর চিকিৎসার জন্য ক্ষতি হবে। আর আমরা জানতে পারিনি অনিলের শকটা কি। এদিকে নতুন গভর্নমেন্ট এসে পুলিশে রদবদল শুরু করল। বড়ো বড়ো শহরে সৎ অফিসারদের নিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হল।

সেই সুবাদে অনিলের পোস্টিং হলো ডিএমপিতে। ও তো খুশীতে আত্মহারা, দোস্ত, ফখরুদ্দিন সাহেব লাখ লাখ বছর এদেশ শাসন করুক, দেশটার চেহারা পাল্টাইয়া যাইব। আমি ঘুষ খাই না, ঘুষ দেই না, আমার কোন মামা-কাকা নাই উপরে, উনি যদি পাওয়ারে না আসতেন, তাহলে এই জীবনে আমার ঢাকায় পোস্টিং হত না- গত বৃহস্পতিবার দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল অনিল। ও আমাদের ঢাকার গল্প শোনায়। সেদিন বারিধারায় রেইড দিলাম, আমাদের এডিসি সাহেবের কমান্ডে।

অনিল গল্পের সুরে কথাগুলো বলে যায়। বাগেরহাটের সেই এমপি সাহেবের ঢাকার বাড়িটা বারিধারাতেই। বছরে ন’মাস সেখানেই কাটান। কী কাকতালীয় কাণ্ড, আমাদের দলটা তাকেই ধরতে গেল। আমি তার হাতে হ্যান্ডকাপ পরালাম।

লজ্জ্বায় লোকটা আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। তার বাঁ হাতটা জাপটে ধরে কানে কানে বল্লাম- স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন? ক্যানো ভাই মিছে মিছে লজ্জ্বা দিচ্ছেন। এমপি সাহেবের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনতে কেমন বেখাপ্পা লাগছে। স্যার, মনে মনে আপনাকে অনেকদিন ধরে খুঁজেছি, একটা ধন্যবাদ দেয়ার জন্য। কেন ভাই, আমার জানা মতে তো আমি কোনদিন আপনার কোন উপকার করিনি, পারলে অপকার করার চেষ্টা... না স্যার, করেছেন।

আমার এই পুলিশ জীবনের সবচেয়ে বড়ো উপকারটা আপনি করেছেন। সেদিন যে ওই লাল পতকার খায়রুলকে ছাড়িয়ে নিতে আমার ফাঁড়িতে এলেন, আমি বেয়াদবি করেছিলাম বলে এএসপি সাহেবের সামনে একটা চড় মারলেন, সেই চড় খেয়ে কিন্তু আমার মনোজগতে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। সেটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কী পরিবর্তন এসেছে ভাই? আগে নিজেকে খুব হেয় মনে হত। ভাবতাম, পুলিশের এক সাব-অর্ডিনেট অফিসার, নাই সামাজিক মর্যাদা, নাই আর্থিক স্বচ্ছলতা, নাই কিছু করার ক্ষমতা, অনেকটা ঘর-পাহারা-দেয়া কুকুরের মতো।

আমরা আপনাদের মতো কতগুলো ফালতু লোকের নিরাপত্তা দেই, দেই মিনিটে মিনিটে স্যালুট, বিনিময়ে আপনারা আমাদের উচ্ছিষ্ট দেয়ার মতো যৎসামান্য বেতন দেন। যা দিয়ে কোনভাবেই স্বচ্ছল জীবনযাপন সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে আমরা দুনাম্বারি করি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য ডিউটি করি, কিন্তু সেই মানুষই আমাদের ছি ছি করে। কুকুরের সঙ্গে পুলিশের এরকম আরো অনেক মিল আছে।

তাই বড়ো অফিসারদের দুর্ব্যবহার কিংবা আপনাদের গালাগালি কখনোই গায়ে মাখতাম না। ভাবতাম এটাই তো মুনিবভক্ত কুকুরের প্রাপ্য। হ্যাঁ, অনেকেই দুর্ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কেউ কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। আপনিই প্রথম তুললেন। সেদিন আপনার চড়টা খাবার পরে আমি কাঁদতে পারিনি।

লুকিয়ে লুকিয়ে কেবল ঢোক গিলেছি। কিন্তু তারপর থেকে আমার একটা রোগ দেখা দিল। আমি ঘুমের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করতাম, পুলিশ যদি কুকুরই হয়, তাহলে কাঁদে কেন! আমার ভেতরের একটা মানুষ জোরে জোরে বলত, ‘মানুষ মানুষ, পুলিশও মানুষ!’ সেন্ট্রাল প্লাজার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা গরম জিলাপি খাই। কিছুদিন আগে ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী জিইসি মোড় থেকে ডাউস ডাউস বিলবোর্ডগুলো সরিয়ে দিয়েছেন।

মোড়টা এখন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সবুজ নগরীর বুক যেন কংক্রিটের খাঁচা ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে। কী রমণীয়ই লাগছে না এ নগরীকে! এতো লেখালেখি, হৈচৈ করে আমরা যা করতে পারিনি, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের একদিনের অভিযানে তা হয়ে গেল! এদেশে সজ্জনের অকুতির কোন মূল্য নেই, লাঠিই সব। কী আশ্চর্য! অনিল কাপুরের কথায় চিন্তার তাল কেটে গেল। সিগারেটের গোল গোল ধোঁয়া ছেড়ে ও বলে, এদেশে নির্বাচিত সরকারগুলো চলে গেলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলেই বরং বোঝা যায় দেশে এখনো গণতন্ত্র আছে, আইনের শাসন আছে।

আর নির্বাচন মানে গণতন্ত্রের চর্চা নয়, যেন আরেকদল লুটেরার জায়গা করে দেয়া, বারোটা বাজার আগাম সংকেত। অনিল কাপুর ভরাট গলায় রুদ্রের কবিতা আওড়ে যায়- ...তুমি চলে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে তুমি চলে গেলে মনে হয় তুমি আছো হৃদয় জুড়ে তুমি আসবে বললে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা... (স্কুলের সব সহপাঠীর কাছে মাপ্রার্থনাপূর্বক) ৩ এপ্রিল ০৭, দৈনিক আজাদী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।