বৃথা হয়রানি
যেহেতুক অহেতুক
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে দীর্ঘ তিন বছর ধরে দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ‘যেহেতুক অহেতুক’ শিরোনামে এ নিবন্ধগুলো লেখি। একেবারে সাধারণ মানুষ, এসব সমস্যা ও সংকটকে কিভাবে দেখছেন, কি ভাবছেন- তা এ লেখাগুলোর উপজীব্য। কিছুটা গল্পের ছলে, কিছুটা বিদ্রƒপে, কিছুটা আবেগে পরিম্লান হয়েছে সেসব প্রান্তজনের কথা। লেখাগুলোকে যতটা সম্ভব তথ্য ও যুক্তি নির্ভর করে তোলার চেষ্টা করেছি।
আশা করি লেখাগুলো পড়ে পাঠক আবার ফিরে যাবেন অতীতের দিনগুলোতে।
এবং মূল্যায়ন করবেন আমাদের সাফল্য ও বিফলতা। হয়ত এর মাধ্যমে একটা আত্মোপলব্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
অাজ থেকে বছর দুয়েক অাগের ঘটনা। ঠিক এমন দিনে ইরাজ উদ্দিনের তত্ত্বধায়ক সরকার নিয়ে দেশে টালমাটাল অবস্থা। তখনকার লেখা এটি
ফিরোজ স্যারকে মনে পড়ে!
আমার সেই বন্ধুটির নাম জানানো যাবে না, নিষেধ আছে।
তার কর্মস্থল বাগেরহাটের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ। পশুর নদীর কোলে ছোট্ট একটা গ্রামে তাদের ফাঁড়িটি। ওপাশেই সুন্দরবন। প্রথম প্রথম যখন গিয়েছিল রাত-বিরাতে বাঘের ডাকে তার ঘুম ভেঙে যেত।
এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। তার ভয় কিন্তু বাঘ-ভাল্লুকে নয়, এর চেয়েও ভয়ংকর ভয়ংকর জিনিস আছে সেখানে। মেট্রোপলিটন সিটির সুরক্ষিত খাঁচায় আমরা যারা বাস করি, বাগেরহাটের সেই ইউনিয়নটির অবস্থা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। তারপরও বলি, নদীর ওপাশে বন, বনে বনদস্যু; নদী চলে গেছে বঙ্গোপসাগর, সাগরে জলদস্যু, নদী ধরে তারা প্রায় চলে আসে উজানে; ডাঙায় চরমপন্থী; বছর দুয়েক হয় দেখা দিয়েছে জেএমবি’র আনাগোনা। এভাবেই চতুর্মুখী চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় তাকে।
নাহ, ব্যাপারটা আসলে উল্টো, কোন চাপের মধ্যেই নেই সে। সে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আছে। তার ফাঁড়ি এলাকার সীমানা শহরের মাঝারি সাইজের একটা থানার সমান। পশ্চিমে দেড় মাইল, পূর্বে দু’মাইল, উত্তর-দক্ষিণে দু'থেকে আড়াই মাইল। এর মধ্যে আছে পশুর নদীর অনেকটা এলাকা।
এ বিশাল এলাকা তাকে পাহারা দিতে হয়। তার ফাঁড়িতে আনসার-পুলিশ মিলে আছে দশজন। প্রতিদিন দুয়েকজন ছুটিতে থাকে। রাতে দুটি দল করে পাহারায় বের হয় তারা। বড়ো ধরণের কোন ডাকাতির খবর পেলে তারা যায় না, যায় না চরমপন্থীরা কোথাও এসেছে শুনলেও।
তাদের ভয় প্রাণের চেয়ে অস্ত্রের বেশি। উপরমহল থেকে তাদের সেরকমই ইনস্ট্রাকশন দেয়া আছে। তাই বড়ো ধরণের কোন ঘটনা ঘটলে তাকে খুব একটা জবাবদিহি করতে হয় না। এ জন্যই বললাম, সে আছে অনেকটা চাপমুক্ত, অনেকটা নির্বিঘ্নে। ত্রিশ টাকা কেজির পাবদা মাছ আর দশ টাকা কেজির শিম খেয়ে তার চেহারা অনেকটা অনিল কাপুরের মতো হয়ে গেছে।
অনিল কাপুর ঈদে ছুটি পায় না। তাই ঈদের মাসখানেক আগেই বাড়ি এসে ঘুরে যায়। বন্ধুদের আড্ডায় আসে। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের দু’জন ‘ভাগ্যবান চাকরি বিজয়ী’র একজন সে। তাকে দেখে অন্যরা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আর সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আমাদের মুক্তবিহঙ্গের মতো ওড়াওড়ি দেখে। আমার পত্রিকায় চাকরি হয়েছে শুনে ও মহাখুশী। পিঠ চাপড়ে বলল, তোদের তো মন্ত্রী-মিনিস্টারের পাওয়ার। লেগে থাক, অনেক দূর যেতে পারবি। আমার অবশ্য লেগে থাকা হয় না।
তার আশাবাদের মাস না যেতেই মাথা গরম করে চাকরিটা ছেড়ে দেই।
সেদিন আড্ডায় সে তার কষ্টের কথাগুলো বলছিলো: এতো লিমিটেশনের মাঝে কী করে পাবলিককে সার্ভিস দেই! মানুষ আমাদেরকে নিয়ে এতো আশা করে, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারি না, মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো হীনজ্ঞান হয়। এসব বলতে বলতে তার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছিল। কথা আর চায়ে রাত সাড়ে ৯টা। সবাই নড়েচড়ে উঠল, বাড়ি ফিরতে হবে।
আমাদের অনিল কাপুর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, ‘দোস্ তোরা দোয়া করিস, সামনে বড়ো কঠিন দিন, যেন সহিসালামতে ফিরে আসতে পারি। ’ ‘কিসের কঠিন দিনরে?’ তার এক শব্দে উত্তর, ‘নির্বাচন। ’
সবাই যখন ঈদের জুতো-জামা কিনতে ব্যস্ত, বাজারে তেল-সেমাইয়ের দাম নিয়ে হাহুতাশরত, তখন আমাদের অনিল কাপুর বাসে কাঁঠাল-ঠাসা হয়ে ঢাকা যায়। অনিল কাপুরের ফাঁড়ির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় সব ফাঁড়ি গুটিয়ে পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। মতার রদবদল হবে।
দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের পাহারা দিতে হবে। সেবাই ধর্ম। তাই ধর্ম পালনে যাও ঢাকা। পশুরের কোলের সেই গ্রামটা, পশুরে মাছ ধরে যে মাঝিটা অরক্ষিত থাক, তাতে কিছু যায় আসে না।
তারপর তো ফিলমের নায়কের মতো ঘন ঘন তার মুখ দেখা যায় টিভির পর্দায়।
কখনো সে গজারি গাছের লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরোধীদলের নেতা কর্মীদের ওপর, কখনো তারকাঁটার ব্যারিকেডের ওপারে দাঁড়িয়ে ধ্বস্তাধস্তি করে, কখনো লেজ গুটানো বিড়ালের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে দু’দলের মারামারি দেখে। আমরা টিভিতে অনিল কাপুরকে দেখি। উৎকণ্ঠায় আমাদের বুকটা ধড়ফড় করে। অনিল কাপুর তুই সাবধানে থাকিস।
অনিল কাপুরের সঙ্গে কথা হয় মোবাইলে।
‘ফিরোজ স্যারের কথা মনে আছে তোর, ওই যে আমরা ক্লাস এইটে থাকতে হুট করে চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন ...’ ওপার থেকে অনিল বলে।
ও হ্যাঁ!
কেন চাকরি ছেড়েছিলেন তিনি, জানিস?
না তো। আর ওসব খবর তো তুই-ই বেশি রাখতিস।
আমাদের কেউ জানে না। আমিও জানতাম না।
সেদিন জানলাম। স্যারকে নিয়ে সেভেনের বিকাশ একটা বাজে ছড়া লিখে ক্লসের দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছিল। সেটা স্যারের চোখে পড়ে। স্যার কোন কথা না বলে পরের দিন চাকরি থেকে রিজাইন দেন। স্যাররা অনেক চাপাচাপি করেছিলেন কেন তিনি চাকরি ছাড়ছেন জানতে।
তিনি কিছু বলেননি। তাই কেউ জানেনি কেন তিনি চাকরি ছাড়লেন। ১১ বছর পর আমি সে রহস্যের কূল খুঁজে পেয়েছি।
তাই নাকি!
হুঁ। অনেকদিন পর গত বছর তার সঙ্গে আবার দেখা হলো আমার।
সে ঘটনার পর তিনি আর শিকতায় ফেরেননি। এখন একটা সরকারি ব্যাংকে আছেন। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। আমাকে দেখে চিনতে পারেননি। আমি যখন পরিচয় দিলাম, তিনি মাথায় হাত রেখে আমাকে আশীর্বাদ করলেন।
জিগগেস করলাম, স্যার স্কুলের চাকরিটা ছাড়লেন কেন?
স্যার বললেন, শিক্ষকের সবচেয়ে বড়ো জিনিস হলো সম্মান। অর্থবিত্ত তো কম বেশি সবাই করতে পারে। কিন্তু সম্মান সেটা সবার কপালে জোটে না। এটার আশায় মানুষ শিক্ষকতা করে। সেটাই যদি না থাকল শুধু শুধু গলগ্রহ হয়ে লাভটা কি।
তিনি একনাগাড়ে বলে গেলেন। আমি বল্লাম, স্যার তাই বলে কি মন্দ লোকের কথা শুনে চাকরি ছেড়ে দেবেন, তা কি মেনে নেয়া যায়। তিনি শুধু বললেন, মন্দ ছেলেটাও তো আমার ছাত্র ছিল। ওকে তো আমি ভালো করতে পারিনি।
শুনে খুব খারাপ লাগছে রে দোস।
আমার জানিস এখন কেবল ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। বঙ্গভবনের সামনে দাঁড়াই, প্রেসিডেন্ট স্যারের গাড়ি যায়, ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। মুক্তাঙ্গনে দাঁড়াই, দুপাশে দু’দলের বক্তৃত্বা চলে, আবার ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। জয়কালি মন্দির রোডে দাঁড়িয়ে থাকি, ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে ১৪ দলের নেতাকর্মীরা, কোলাহলে চারদিক নরক গুলজার, এর মাঝে ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। ইস, সব শিক্ষকের যদি ফিরোজ স্যারের মতো আত্মসম্মানবোধ থাকত!
মোবাইলে সব কথা বলা যায় না।
টিভি খুললেই অনিলকে দেখা যায়। আমারা যখন ফার্স্ট ইয়ার-সেকেন্ড ইয়ারে, দুপুর দুটার পর জার্নালিজমের আতিক স্যার আসতেন হায়দারের দোকানে, দরাজ কণ্ঠে গাইতেন একটার পর একটা গান। তার একটা গান প্রায় গুনগুনিয়ে গাইতো অনিল।
... আমার আমি নাইরে
আমার আমি নাই।
ছেড়া পলিথিনের মতো
উড়ি বাতাসে
বাদামের খোসার মতো
ঘুরি পার্কে পার্কে...
... কে আমারে খেয়ে দেয়ে
ফেলে রেখেছে ...
আমার আমি নাইরে
আমার আমি নাই।
টিভিতে দেখি, আমাদের অনিল পলিথিনের ঠোঙার মতো কখনো ডেমরায়, কখনো মুক্তাঙ্গনে, কখনো গণভবনে হাওয়া হাওয়ায় ওড়ে। গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় লোহার টুপি, তাই তার চেহারাটা দেখা যায় না। সেকি দাঁড়িয়ে এখনো ফিরোজ স্যারের কথাই ভাবছে?
৫ ডিসেম্বর ২০০৬, দৈনিক আজাদী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।