আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেমের গল্প নয়

... ... ... ...

একটা গল্প শুনবেন? একটা ছেলে আর একটা মেয়ের গল্প। আরে আরে...আমি কি বলেছি নাকি প্রেমের গল্প? একটা ছেলের আর একটা মেয়ের গল্প মানেই তো আর প্রেমের গল্প না। প্রেমের গল্প লেখা অনেক কঠিন, এতো সহজ না... যাই হোক, ছেলেটা অনেকটা ভাবুক ছিল। আর এই ভাবুকতা নিয়ে তার কোনো খেয়াল ছিল না। বই আর পড়ার মধ্যে ডুবে থাকতো।

খুব বেশি বন্ধু তাই আর হয়ে ওঠেনি। বুকশেলফের বেঁটে দানবগুলোই মনে হয় ওর সবচাইতে ভালো বন্ধু ছিল। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছেলেটার স্বপ্নগুলো খুবই অল্প ছিল। রাজ্যের বই...আর তার হাজার হাজার হরফের ভিড়ে ওর ছোট্ট একটা ঘর, ব্যস এটুকুই। অবাস্তব হয়তো শোনাচ্ছে, কিন্তু ছেলেটা কিন্তু সত্যি সত্যি এরকম।

ছেলেটার কথা তো অনেক বলে ফেললাম, মেয়েটাকে এতোক্ষণ বসিয়ে রেখেছি দেখে আবার রাগ করে বসতে পারে। ওর কথাও তাহলে কিছুটা বলে নিই। মেয়েটাকে বলা যেতে পারে ঝড়...যেখানে যায় তাণ্ডব বইয়ে দিয়ে যায়। কখনো আবেগী, কখনো বা ভীষণ জেদী। বন্ধুরা কেউ বলে তাণ্ডবরাণী, কেউ বলে ভয়ঙ্করের হাতছানি।

সেই হাতছানিতে কেউবা আবার প্রেমে পড়ে যায়, কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস আর হয় না। আর কি বলবো? ও আচ্ছা...মেয়েটার স্বপ্নের কথা তো বলা হলো না। কি আর বলবো, সাহসের অভাবে স্বপ্নের কথা জেনে নেয়াটাও তো হলো না! বাদ দিন। চলুন গল্প শুনি। গল্পের শুরুটা ছিল এক ট্রেনে, সুবর্ণ এক্সপ্রেস।

দেরি করে ছাড়ছে, যথারীতি। আর মেয়েটা...লেট ...যথারীতি। আরো কিছু যথারীতি আছে...জানালার পাশে কোলে এক বিশাল আর বিকটদর্শন বই নিয়ে বসে ছিল ছেলেটা--এইটাও আরেক যথারীতি, যদিও নিজের কাছে বেচারার বইগুলোকে কখনোই বিকটদর্শন মনে হতো না। ছেলেটা ভাবছিলো, ট্রেনটা ছাড়ছে না কেন? আশেপাশের হকারদের জ্বালাতন বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে গেছে। কেউ চানাচুর, কেউ ঝালমুড়ি নিয়ে কানের কাছে এতো বার ভ্যানভ্যান করলে কে না বিরক্ত হয়? পাঁচ টাকার চানাচুর না কেনা পর্যন্ত শান্তি নেই।

এক পিচ্চি হকারের কাছ থেকে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি কিনে রাখলো, বুদ্ধি করে হাতে ঠোঙ্গা নিয়ে বসে রইলো যাতে আর কেউ বিরক্ত করার সুযোগ না পায়। ছেলেটা যখন দোয়া করছিলো ট্রেন ছাড়ার, তখন মেয়েটা দোয়া করছিল যেন কোনোভাবেই ট্রেন মিস না হয়... তাহলে মা'র কথাই সত্যি প্রমাণ হবে, ও হারতে পছন্দ করতো না। মা বলেছিল যে আধাঘন্টার সময় হাতে নিয়ে মালিবাগ থেকে কেউ কমলাপুর এসে ট্রেন ধরতে পারবে না। এখন ট্রেন মিস হয়ে গেলে অবধারিত কিছুক্ষণ ক্যাটক্যাট আর ঝাড়ি বর্ষণ, ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। শেষমেষ ট্রেনটা অবশ্য ওর মিস হলো না...ট্রেন মনে হয় যেন ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিল।

ও উঠলো আর ট্রেনটা ছেড়ে দিল। দেরি করে বের হয়েও ট্রেন পেলো, সৌভাগ্য... এটা সত্যি। কিন্তু ওর সীটে এক বিকট দর্শন লোককেও মেয়েটা খুব শীঘ্রিই আবিষ্কার করলো। দুর্ভাগ্য বুঝি সৌভাগ্যের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে! হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো মন্ত্রী-তন্ত্রীর ছেলে...হলোই বা...তাইলে শোভন শ্রেনীতে যাচ্ছে কেন? মেজাজ খারাপ করে লোকটাকে বললো,"এই যে ভাই, উঠেন। এইটা মনে হয় আমার সীট।

" লোকটা ঘুম থেকে যেন চোখ তুলে তাকালো, মেয়েটাকে দেখে মনে হ্য় যেন পাত্তাই দিলো না। আবার চোখ বন্ধ করে আরামসে ঘুম দিতে লাগলো। মেয়েটা কি বলবে ভেবে পেলো না... আবার চিৎকার করতে যাবে, এসময় একটা ছেলেকন্ঠ বলে উঠলো,"আপনি এই সীটে বসতে পারেন। " মেয়েটা ঘুরে তাকালো, আঁতেল আঁতেল ভাবের একটা ছেলে, কালো রীমের চশমা। হাতে মোটা একটা বই, হুডোয়ালা গেঞ্জি পড়া, হুডটা অবশ্য কাঁধে ফেলে রাখা।

ক্যাম্পাসে প্রথম দেখায় যেসব ছেলে থেকে দূরে থাকতে হয় লেখাপড়ার ভয়ে সেধরণের ছেলে। ছেলেটার মুখোমুখি সীটটা খালি। ব্যাগটা মেঝেতে রেখে ওই সীটটাতেই বসলো মেয়েটা, তারপর ছেলেটার দিকে একটু ঝুঁকে বললো,"আপনি তো একটা মহা সুবিধাবাদী মানুষ! মেয়েমানুষ দেখেই নিজের উল্টাপাশে বসানোর জন্যে পাগল হয়ে গেলেন, সত্যিকারের পুরুষ যদি হতে চান, তাহলে আমার সীটটা আমাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন দেখি। " ছেলেটা চুপচাপ মেয়েটাকে একনজর দেখলো, তারপর ডুবে গেলো নিজের জগতে। মেয়েটার কথার কোনো জবাবই দিলো না।

এতো বড়ো কথার পরও কোনো ছেলে যে চুপচাপ শান্ত নয়ন ফিরিয়ে নিতে পারে, বিশ্বাস হলো না যেন ওর। মেয়েটা কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,"আমি এখানে বসবো না। " ছেলেটা তাতেও কোনো জবাব দিলো না। মেয়েটার এবার একটু মন খারাপ হলো...একটু বুঝি অভিমানও। আর যাই হোক, কারো অবহেলা ওর ভালো লাগে না।

চুপ করে জানালা দিয়ে তাই দৃষ্টি বাড়িয়ে বসে রইলো। ছেলেটার সাথে আর কোনো কথা বলার চেষ্টা করলো না। এভাবে চুপ হয়ে থাকার অভ্যাস যে আমাদের ঝড়ের নেই তা তো জানেনই। কিন্তু পুরো ট্রেনে যে মানুষটাকে একটু সুবিধার মনে হয়েছিল, সে মানুষটা বইয়ের ভেতর ডুবে, কি করার কিছু ভেবে না পেয়ে তাই একটু একটু করে ঘুম ঘুম ভাবে মজে যেতে লাগলো মেয়েটা। ঠিক এরকম সময় ছেলেটা জজ্ঞেস করলো,"বই পড়বেন?" মেয়েটা চোখ মেলে তাকালো, অবাক হয়ে ভাবছিলো ...আমাকেই বলছে নাকি? ছেলেটা বলতে থাকলো," আমার কাছে ভালো কিছু থ্রিলার আছে।

পড়তে খারাপ লাগবে না। পড়বেন?" মেয়েটা ছোট্ট করে জবাব দিলো,"নাহ। " তারপর আবার চোখ বন্ধ করলো, প্রতিশোধের চেষ্টা আর কি! ছেলেটা আবার চুপ হয়ে গেলো। মেয়েটার ঘুম ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে, শুধু যে ভেঙ্গে গেছে তা না, কোনো এক অচিন রাজ্যে পালিয়েও গেছে। তাই উঠে বসলো আবার।

বললো,"আপনি কি লেখক-টেখক নাকি?" ছেলেটা মৃদুহেসে বললো,"নাহ, আমি শুধুই পাঠক। " "তাহলে এতো পড়ে কি লাভ?"প্রশ্ন করে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো মেয়েটা। "জীবনানন্দ পড়ার সময় লাভ খুঁজতে নেই"-একটু হেসে জবাব দিল ছেলেটা। শুনে মেয়েটা হাসতে হাসতে গড়াগড়ির মতো অবস্থা। মেয়েটার হাসি দেখ ছেলেটা বিব্রত হলো যেন কিছুটা, আশেপাশে তাকিয়ে বললো,"এতো হাসির কি হলো, জীবনে কখনো জীবনান্দ পড়োনি?" হাসির দমক থামিয়ে মেয়েটা কোনো মতে জবাব দিল,"পড়েছি, কিন্তু পাহাড়ের মাঝে এঁকেবেঁকে যাওয়া রেলপথ, লোহার ব্রীজ আর দুপাশের ঘন সবুজকে ফেলে রেখে কেউ জীবনানন্দ পড়ে প্রকৃতি খুঁজতে পারে সেটা আমার মাথায় আসেনি! " ছেলেটার মুখের হাসি মুছে গেলো।

মেয়েটার চোখ এড়ালো না, বললো,"মন খারাপ করলেন নাকি? জীবনান্দ ভাবতে শেখায়, ভাবতে গিয়ে অন্ধ হতে শেখায় না, বুঝলেন মশাই?" ছোট্ট করে মাথা নাড়লো ছেলেটা, যেন সব বুঝতে পেরেছে...মেয়েটা এখানেও ছেলেটাকে রেহাই দিলো না,"আপনি কি সবসময় যে যা বলে মেনে নেন?" ছেলেটা ভাবতে শুরু করলো, এ কোনো নতুন ফাঁদ না তো! ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,"কেন? আপনি তো কিছু ভুল বলেন নি, মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?" মেয়েটা কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো, ততটুকু সময় ছেলেটার মনের সবটুক যেন আউলায় গেল। তারপর মেয়েটা বললো,"কমসে কম এটুকু তো কাউন্টার যুক্তি দিতেই পারতেন যে---পাহাড়ের মাঝে এঁকেবেঁকে যাওয়া রেলপথ, লোহার ব্রীজ আর দুপাশের ঘন সবুজ দেখার জন্যে তো দিনের আলো চাই, এ রাতের বেলায় দেখব কিভাবে?" ছেলেটা এবার যেন নিজের ভুল বুঝতে পারলো, বোকার মতো হেসে বললো,"ঠিক আছে, যান। আজ আর কোনো বই-ই পড়বো না। বুঝতেই পারছি যতক্ষণ বই পড়বো ততক্ষণই আপনি আমাকে বোকা বানাতে থাকবেন। " মেয়েটা তো তা মানতে নারাজ, বললো," আপনাকে বোকা বানানোর কি এমন ঠেকা পড়েছে?? আপনি তো এম্নিতেই বোকা!" "ঠিক আছে, কিছু বুদ্ধি ধার দিন দেখি!" "হুমম, ভেবে দেখি, ধার দেয়া যায় কিনা! " এমনি করে দুজনের মধ্যে অনেক কথা হলো সেযাত্রায়...সব কথা বলার মানে হয় না।

কিছু কথা আজকের মতো ওদের জন্যেই তোলা থাক নাহয়! শেষের কথা বলি। একসময় স্টেশন এলো, দুজনের পথ দুদিকে চলে গেলো। আমার গল্পও কিন্তু প্রায় শেষ। ছোট্টবেলার লেখা "গরু" রচনার মতো এ গল্পের কোনো বর্ণনা, উপকারিতা ইত্যাদি নাই। পড়ে হতাশ হলেন? আগেই বলেছিলাম, এটা কোনো প্রেমের গল্প না, প্রেমের গল্প লেখা এতো সোজা না।

তবে ছেলেটা এখনো প্রায়ই সুবর্ণ এক্সপ্রেসে উঠে বসে। জীবনান্দের বইটা হাতে নিয়ে ভাবে, ট্রেনটা এতো সময় মেপে চলে কেন? একটু দেরি করলেই হয়তো...হয়তো... ... বহু দূরে মেয়েটাও অন্য কারো হাতে হাত রেখে হঠাৎ ভাবতে থাকে, সবুজে ঘেরা পাহাড়ের বাঁকে মোড় নেয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেসটা কি এখনো ঠিক আগের মতোই চলছে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.