আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মভাবনা ০২ স্পষ্ট মানুষের খোঁজ



ভাবনাবিস্তারের আধুনিক উপকরণবিহীন দিনগুলোতে মানুষের ভাবনার বিকাশ হতো মূলত বাণিজ্যিক বন্দরে, নগরের রাজধানী এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতেই মূলত ভাবনার বিনিময় এবং সংশ্লেষণে ঘটতো অধিক পরিমাণে। ভ্রমন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক রীতির সাথে পরিচিত হওয়াও মানুষকে শিক্ষিত করে তুলে। নিজস্ব সংস্কৃতির দৈন্যতা এবং উদারতাগুলো চিহ্নিত করতে শেখায় এবং মানুষকে তার নিজস্ব অস্তিত্ব সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিসমেত গ্রহন করবার মানসিকতা বিকাশ করে। তাই পৃথিবীর বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো সব সময়ই ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধারণ করে। ধর্মবিচ্ছিন্ন কিংবা ধর্মাচ্ছন্নতামুক্ত একটা সংস্কৃতি বিকশিত হয়ে সেখানে।

সেখানেই অনেক সংস্কৃতির মানুষের নিত্য আনাগোনা, তাই নির্দিষ্ট একটি কৃষ্টিকে সমর্থন করা কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার বদলে সকল সংস্কৃতিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ধারণ করবার একটা প্রবণতা সেখানে থাকে। নতুন উপলব্ধিতে আলোকিত মানুষ বন্দর থেকে নরআহরিত জ্ঞান নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যায়। সভ্যতা যখন থেকেই পারস্পরিক বিনিময়ের সুঁতায় গাঁথা হয়েছে তখন থেকেই মূলত ভাবনাগুলো মানুষবাহিত। মানুষ ভাবনার ভার বহন করে নিয়ে যায়, মানুষ নিজস্ব সমাজ এবং পরিবেশে সাথে নতুন ভাবনাকে যাচাই করে দেখে। এবং ভাবনার আত্তীকরণ ঘটে।

সেই মানুষটাই ঘরোয়া আসরে, অন্যসব মানুষের সাথে ভাবনা এবং শুভাশীষ বিনিময়ের সময়ে এই ভাবনার সংশ্লেষিত রূপ প্রকাশ করে। সমাজ মূলত কাঠামোতে বাধা। এখানে বিভিন্ন পেশাজীবি সমাজের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং নিজস্ব সংস্কৃতির কারণেই তাদের উপলব্ধি এবং সংশ্লেষণগুলো নিজস্ব উপাদানে সমৃদ্ধ। পেশাজীবি গোত্রগুলোর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সূত্রে নবলব্ধ ভাবনাগুলো যাচাই করে দেখে। তবে সামাজিক কাঠামোগুলো নিয়ন্ত্রন করে মূলত নেতাশ্রেণীর মানুষেরা।

সেখানে ভাবনাগুলোর আলোড়ন চলতেই থাকে। তবে যখন প্রচলিত সামাজিক কাঠামো এবং স্তরবিন্যাসে গুরুতর কোনো সংকট থাকে কিংবা সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয় তখনই কোনো একটা স্থিরতা এবং উৎকর্ষতার প্রয়োজনেই নতুন ভাবনা গ্রহনের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে থাকে। এবং কখনই সেই ভাবনা একক কোনো মানুষের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ে না। মূলত ভাবনা আলোচিত এবং বিকশিত হওয়ার জন্য একক মানুষের তুলনায় একটা গোষ্ঠীবদ্ধ উদ্যোগ প্রয়োজন হয়। এই গোষ্ঠিবদ্ধতা কিংবা যুথবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা ভাবনা বিকাশের স্বার্থেই অনুভুত হয়।

তবে এখানেও একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি থাকেন, যারা মূলত এই ভাবনার প্রচারক এবং সংশোধক রূপে চিহ্নিত হয়ে যান। তবে নতুন যে ধারণাই প্রচলিত হোক না কেনো তা সমসাময়িক পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করতে দক্ষ, তা একই সাথে সেই সমাজে অবস্থিত অধিকাংশ মানুষের নৈতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাহিদাকে চিহ্নিত করতে পারে এবং সেটা পুরণের সীমিত অঙ্গীকার দিতে পারে। যদি কোনো মত কিংবা ভাবনা এই যোগ্যতা ধারণ না করে তবে সেই ধারণা পরিত্যাক্ত হয় কিংবা সেই ধারণা কতিপয় যুথবদ্ধ মানুষের উগ্রতায় পর্যবসিত হয়। মূলত সামাজিক ভাবে সেই ভাবনা গৃহীত হয় না। সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার উপরেই নির্ভর করে ভাবনার বিকশিত হয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবাস সম্ভবনা।

ধর্ম এমন একটি সংঘবদ্ধ ধারণা, শুধুমাত্র একটি ইশ্বরকে প্রতিষ্ঠিত করাই ধর্মের মূল লক্ষ্য থাকে না, যেকোনো ধর্মই সামাজিক সহনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং সামাজিক বৈষম্যকে সীমিত আকারে কমিয়ে আনবার উদ্যোগ গ্রহন করে। সেখানে ধর্মের উৎস বিবেচনায় সামাজিক মতধারা অনুসারেই একজন ইশ্বরের প্রয়োজন পড়ে, কিংবা সমাজ যদি ইশ্বর কল্পনায় বিমূর্ত অবস্থানে চলে যায় তবে সেখানে ইশ্বরও ভাবনায় নির্মিত হয়। নিতান্ত কার্যকরণ সম্পর্কিত ধর্ম কিংবা সামাজিক অনুশাসনে তেমন ইহলৌকিক প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই ইশ্বরমুর্তি অনুপস্থিত। যেহেতু প্রচলিত সামাজিক অনুশাসনের তুলনায় অগ্রসর ভাবনার অধিকারী মানুষেরাই নতুন ধর্মমত প্রচার করে সুতরাং সেখানে অবশ্যই সামান্য অগ্রসর ধারণাগুলোই বিদ্যমান থাকে। এমন কি সামাজিক সংস্কারগুলো বদলের আহ্বানও থাকে সেইসব ভাবনায়।

তবে সেখানেও নতুন মতধারা গ্রহন এবং নতুন ভাবনাকে সংযুক্ত করবার পদ্ধতি বিদ্যমান থাকে। এই বিদ্যমান সংস্কার প্রবনতাই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদকে সংশোধিত করতে সক্ষম। নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম এবং সামাজিক নৈতিকতাবোধগুলোকে সংশোধন করতে সক্ষম। মূলত ধর্মভাবনা একক মননের অভিব্যক্তি নয়, যেই মানুষটা পরিবর্তিত একটি মতবাদ প্রকাশ ও প্রসারের উদ্যোগ গ্রহন করছে সেই মানুষটার সাথে সহযোগী আরও অনেকগুলো মানুষ থাকে, তবে সেইসব মানুষের সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা থাকে না সব সময়। তাই নির্দিষ্ট একটি ব্যক্তির মনোগ্রামেই এই নতুন মতবাদ প্রচারিত হয়, সেই মূলত মতবাদের সমার্থক হয়ে উঠে।

বিবর্তনযোগ্যতা বিকাশের প্রধান শর্ত হলেও, সব সময়ই সব মতবাদ একটা পর্যায়ে গিয়ে স্থবির হয়ে যায়। তার বিবর্তনযোগ্যতা পরিহার করে অনুসারী মানুষগুলো নতুন সংস্কৃতির সাথে এর উদ্ভট সংমিশ্রন ঘটাতে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহন করেন। ধর্মকে ব্যখ্যা করা এবং ধর্মীয় মতবাদকে যুগোপযোগী রাখবার জন্যই বিশেষ কিছু মানুষ ধর্মীয় শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। তাদের সামাজিক প্রয়োজনীয়তার কারণেই তারা সম্মানিত হয়ে উঠেন। তবে আত্মপ্রসাদে ভোগা এইসব ধর্মবেত্তারাই সমাজ থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারেন।

এমন আশংকা সব সময়ই রয়ে যায়। এটা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের বিষয়। প্রতিটা সমাজই সময়ের সাথে বিভিন্ন নতুন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হচ্ছে, নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করছে। এবং এইসব নতুন সাংস্কৃতিক উপাদান, নতুন ভাষা, নতুন বাগবিধি এবং নতুন কৃষ্টির গ্রহনযোগ্যতা নির্ধারণের জন্যই তারা ধর্মাভিজ্ঞ মানুষের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তাই একই সাথে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক একটা চরিত্র ধারণ করে ধর্ম।

যে স্থানে এই মতবাদ জন্ম নেয় সেই স্থানীয় সংস্কৃতিকে অনেকাংশে পরিবর্তন করেই নতুন একটা স্থানে সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচে এই ধর্মটির বিবর্তিত রূপটা প্রকাশিত হয়। প্রচলিত বাগবিধি,ইশ্বরের নাম ও গুণাবলী অপরিবর্তিত থাকলেও লৌকিকতার ছোঁয়া না থাকলে নতুন কোনো সংস্কৃতিতে ধর্ম বিকশিত হয় না। তবে বর্তমানের অধিক তথ্যের উৎসসম্বলিত মানুষ এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করলেও তথাকথিত ধর্মবেত্তারাই এই যুগোপযোগী পরিবর্তন এবং প্রশ্নগুলোকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন অধিকাংশ সময়ই। অবশ্য ধর্মাভিজ্ঞ মানুষদের অভিযুক্ত করবো কেনো? আমাদের প্রচলিত সামাজিক সংস্কার থেকে আমরাই মুক্ত হলাম কতটুকু? আমাদের মতাদর্শিক অন্ধত্ব আমাদের সাথেই বৃদ্ধি পায়। পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়ে উঠা কোনো মানুষের বৈশিষ্ঠ্য হতে পারে না, বরং পলিটিক্যালি কারেক্ট একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করবার উদ্যোগ সব সময়ই বিদ্যমান।

এখন এই আধুনিকযোগাযোগনির্ভর প্রায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে পলিটিক্যালি কারেক্ট একটা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশী উপলব্ধ হচ্ছে। আমরা তথ্যের জন্য তেমন সংকটে পড়ছি না এখন। অন্তর্জালে তথ্য ছড়িয়ে আছে। তবে আমাদের প্রচলিত সামাজিক ধারণাগুলো যতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হোক না কেনো, যতই অবমাননাকর হোক না কেনো আমরা কি এইসব প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ আধুনিক হয়ে উঠতে পেরেছি? আমাদের নির্মিত ভাবনা যা কি না সরাসরি প্রকাশিত তথ্যমাধ্যমজাত, সেই তথ্যমাধ্যমজাত উপলব্ধি এবং ভাবনাগুলো আমাদের তাড়িত করে। আমরা নিজস্ব উপলব্ধি দিয়ে হয়তো তথ্যগুলোকে যাচাই করে সংশ্লেষিত করতে পারতাম, তবে আধুনিকতার অন্যতম প্রধান ব্যধি আমাদের ভাববার সময় পর্যন্ত নেই, কিংবা আমরা ভাবতে অপরাগ।

তাই তথ্যমাধ্যমের প্রদত্ত তথ্যগুলো আমরা যৌনতা এবং ক্ষমতার মতো আদিম অনুভবে বিভাজিত করি। এইসব ভাবনার কিছু কিছু আমাদের উদ্দীপ্ত করে, কিছু কিছু আমাদের প্রলুব্ধ করে। সুতরাং আমরা এইসব চর্চা করতে থাকি। উৎকর্ষতা আসে না। তথাকথিত উচ্চমানবিকতাসম্পন্ন মানুষেরাও যখন এমন স্থির ধারণা নিয়ে বসে থাকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষতা এবং তার শরীরের কাঠামো সব সময়ই ব্যস্তানুপাতিক- এবং এইসব ইতরামির মূল লক্ষ্য যখন হয়ে উঠে নিছক নারী শরীর তখন এই ভাবনাগুলোর অন্তর্গত অশালীনতা দেখে বিমুঢ় হই।

এখদল আধুনিক তথ্যউৎসের একেবারে গভীরে বসবাস করা একদল মানুষ নিজেরাই নিজেদের ক্ষুদ্রতা এবং অশালীন ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে এখন সবাইকে মানুষ ভাবতে শিখলো না। এখনও নারীকে তার শরীরের অস্তিত্বের বাইরে ভাবতে শিখলো না এবং এইসব আদিরসাত্মক উপলব্ধিতে আহ্লাদিত হয়ে উঠা কতিপয় মানুষও নিজস্ব প্রবৃত্তির বশেই নিজের অবস্থান এবং উচ্চারণকে প্রশ্ন করতে শিখলো না এখনও। তারাই ধর্মকে পরিবর্তনের আহ্বান জানায়। ধর্মের অসারতাকে প্রকাশিত করতে চায়। তবে সবার আগে প্রয়োজন নিজস্ব ভাবনার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি।

যখন আমরা ধর্মের পশ্চাৎপদতা চিহ্নিত করি এটাকে যথেষ্ঠ মানবিক নয় বলেই বর্জন করতে চাই, তখন এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, আমরা আধুনিক মানুষেরাও যথেষ্ট মানবিক নই। আমরা তথ্যে বিভ্রান্ত হই। আমরাও ব্যপক প্রচারণায় অন্ধ হয়ে যাই। আমরা এখনও বুদ্ধিবৃত্তিচালিত না হয়ে নিছক প্রবৃত্তিচালিত। আমাদের ভেতরে ফ্যাশন হিসেবে যে পরিবর্তনবাঞ্ছা এসেছে সেটাও কোনো একটা প্রচারণার সূত্রেই আসে।

সেটা আমরা নিজের ভেতরে ধারণ করি না। আমাদের ধর্মবেত্তারা সামাজিক পরিবর্তনগুলোকে উপলব্ধি করে না, ধর্মকে সংশোধিত কিংবা সংস্কারের ধারণা নির্মান করে না কারণ আমরাই নিজস্ব প্রবৃত্তির বশেই এই পরিবর্তনকামনাকে রুদ্ধ করে রেখেছি। আমাদের এই হুজুগে মেতে থাকা ধর্মীয় যোদ্ধা এবং ধর্মবিরোধী যোদ্ধাদের দেখলে আমোদিত হই। আদতে লক্ষ্যবিহীন উদ্দেশ্যবিহীন হুজুগে মত্ত হুজুরদের সবারই নিজস্ব লক্ষ্যহীনতাই এইসব আপাতলক্ষ্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তাদের জীবনে। আমাদের খুব কম মানুষেরই আসলে স্পষ্ট কোনো একটা অভিলক্ষ্য বিদ্যমান।

সেইসব মানুষদের প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করছি প্রতিদিন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.