আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উদ্-হোস্টেল (হোস্টেল থেকে উৎখাত) - আরেকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা (রিপোষ্ট)

ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...

ডেটলাইন - ১২ অক্টোবর, ২০০১। - হোস্টেলে ফিরলাম রাত সাড়ে বারোটার দিকে। সকালে বেরিয়েছি, সারাদিনে আর হোস্টেলমুখো হইনি। কিছুটা প্রয়োজনে, কিছুটা আশংকায়। কাল মেডিসিন ওয়ার্ড ফাইনাল।

সারাদিন ছিলাম রিডিংরুমে। দুপুর আর রাতের খাবার খেয়েছি হাসপাতালের ডক্টরস ক্যান্টিনে। হোস্টেলে এলেই যদি তাদের কারো সাথে দেখা হয়ে যায়....আরেক ঝামেলা। পরীক্ষার আগের দিন ঝামেলা পোহানোর কোন মানে নাই। কিন্তু নিয়তিতে ঝামেলা লেখা যার, তার শান্তি মিলবে কিভাবে? রুমে ফিরে কাপড়টা চেঞ্জ করে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি, এই সময় দরজায় নক।

খুলে দেখি, বারী চৌধুরী আর আহমেদ রাসেল। কিছুটা বিস্মিত হলাম। ভেবেছিলাম, আজকের মতো ফাঁড়া কেটেছে, কাল কলেজে ধরাটা খাবো। তা-ও কিছুটা আশংকা ছিল হয়তো ব্যাচমেট বা জুনিয়র কাউকে দিয়ে নাভেদ ভাই ডেকে পাঠাবেন, এক ডোজ প্রশ্নোত্তর পর্ব চলবে। বদলে যে এই দুজন সশরীরে চলে এসছেন! এদের একজন- বারী ভাইয়ের সাথে আমার কখনো কথা হয়নি এই আড়াই বছরে।

তিনি আমার দু ব্যাচ সিনিয়র। আমি তার নামও জানতাম না আগে। এই গত এক সপ্তাহ ধরে তার নামটা শুনতে ও তাকে চিনতে হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জিতে যাওয়ার দিন থেকে হোস্টেলে ছাত্রলীগের ভয়ংকর ভয়ংকর নেতাদের কাউকেই আর চোখে পড়ে না। ছাত্রদলের নেতারা এখন লাইমলাইটে।

কারা লাইমলাইটে আসবে তা-ও মোটামুটি জানা ছিল; কিন্তু এই লোক যে কোনোকালে ছাত্রদল করতো , তা শুনি নাই। কখনো ছাত্রদলের লোকজনের সাথে তাকে ঘোরাফেরাও করতে দেখি নাই। কিন্তু পাশা উল্টে যাওয়ার পর তিনি হঠাৎ-ই মঞ্চে বেশ জোশের সাথেই আবির্ভূত। হম্বি-তম্বি , রাফনেস আর মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের তুলনায় যথেষ্ট 'নৃশংস' হওয়ায় সভাপতি নাভেদ ভাইও তার উপর নির্ভর করেন। এবং ছাত্রদলের ত্যাগী ( অর্থাৎ কিনা আগের আমলে ছাত্রলীগের হাতে পিটুনী খাওয়া বা 'সাপ্রেস' থাকা) কর্মী-নেতাদের চেয়েও তার ক্ষমতা বেড়ে গেছে।

রাসেল ভাই বারী ভাইয়েরই ব্যাচমেট। আমার সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে, ভালই ঘনিষ্ঠতা। তিনিও যে ছাত্রদল করেন এটা জানতাম না। রিডিংরুমের অত্যন্ত পড়ুয়া ছাত্র হিসেবেই তাকে জানতাম। আমিও রিডিংরুমেই পড়তাম বলে ঘনিষ্ঠতা।

সত্যি কথা বলতে, ঐ সময় তার ব্যাচের আর মাত্র একটা ভাইয়ের সাথে আমার তার চেয়ে বেশী ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেটাও সন্ধানী করার সুবাদে। এই আমলে রাসেল ভাইও হঠাৎ ক্ষমতা পাওয়ায় তার আচার-আচরণও কেমন যেন বদলে গেল। তাদের ব্যাচে ছাত্রদল কর্মীর সংখ্যা কম থাকাও তাদের উত্থানের কারণ বলে মনে করতাম আমরা। যা-ই হোক মাত্র দুজন দেখে এবং তাদের কাউকেই ‌'সশস্ত্র' অবস্থায় না দেখে কিছুটা ভরসা পেলাম।

হয়তো 'বাক্যালাপে'র ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকবে আজকের অধিবেশন। যদিও কখনো তার সাথে কথা হয়নি আগে, বারী ভাই পরিচিতি-পর্ব, কুশল বিনিময় এইসবের ধার-কাছ দিয়েও গেলেন না। সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলেন। তার হাতে আজকের দৈনিক জনকন্ঠ। সেটি আমার বিছানায় ছুড়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন, 'নিউজটা কে লিখেছে?' কোন নিউজটা সেটা আমাকে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই।

আমি জানি , কোনটার কথা তিনি বলছেন, এইটার জন্যই আমি আজ তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম যতটা সম্ভব। লাভ হলো না। নিউজটা একটা স্পেশাল রিপোর্ট, প্রথম পাতায় ছাপা, ছবিসহ। ছবির বিষয়বস্তু একটা পোস্টার, হাতে লেখা। পোস্টারে লেখা, 'এখন থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সকল ক্লাবের কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে (লিও ক্লাব আর সন্ধানী ছাড়া)।

-- নির্দেশক্রমে ছাত্রদল সভাপতি। ' পোস্টারটা সাটা ছিল কলেজের নোটিশ-বোর্ডে। ঐ ছবির সাথে ১ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যালে ছাত্রদলের কর্মকান্ডের বিবরণ। বিনা যুদ্ধে হোস্টেল দখল, ছাত্রলীগের এক নেতাকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে কর্তব্যরত অবস্থায় তুলে হোস্টেলে এনে পেটানো, আরো অনেককে হোস্টেলে পেটানো, হুমকি-শাসানো, কলেজ-হোস্টেলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ক্লাব কার্যক্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ সহ বিভিন্ন বিষয়। আমি বললাম, 'রিপোর্টারের নাম তো লেখা আছে রিপোর্টের সাথে।

মাসুদ কামাল ভাই লিখেছেন। ' 'তা লিখছে। কিন্তু ইনফরমেশন কে দিছে?' 'এখানে ইনফরমেশন দেয়ার কি আছে, পোস্টার তো আপনারা নোটিশ বোর্ডেই লাগাইছেন, সবার চোখের সামনেই। ফটোগ্রাফার দেখছে , ছবি তুলছে। আর বিজয় ভাইকে যে তুলে এনে পিটাইছেন এটাও তো সবার চোখের সামনেই, আর এটা তো ছাপাও হইছে আগে।

' কথা অনেকটাই সত্য। আমি এমন বেকুবের বেকুব, এক সপ্তাহ ধরে পোস্টারটা চোখের সামনে ঝুললেও এটা যে নিউজ-আইটেম হতে পারে, এইটা মাথায়-ই আসে নাই। দুদিন আগে কামাল ভাই ফোন করে জিজ্ঞেস করলে বলেছি, হ্যাঁ, এইরকম একটা পোস্টার তো আছে। তারপর আনুষঙ্গিক কিছু তথ্য চাইলেন। দেখলাম, আমি যা জানি, উনি তার চেয়ে অনেক বেশী জানেন।

তার সোর্স দেখে আমি বিস্মিত হলাম! আর হবে নাই বা কেন? স্বাস্থ্য-বিষয়ক রিপোর্টের সেরা রিপোর্টারদের একজন তিনি। 'বেশী চালাকি কইরো না। আমি নিউজ পইড়াই আসছি। এগুলো কে জানাইছে , সেটাও আমি ভাল করেই জানি। এই ধরণের নিউজ যেন আর ছাপা না হয়।

' বারী ভাইয়ের স্পষ্ট বক্তব্য। 'এইটা তো আমারে বইলা লাভ নাই। আপনি অফিসে যান। সম্পাদকের সাথে বা মাসুদ কামাল ভাইয়ের সাথে কথা বলেন। এটাতো আমার হাতে না।

' 'অতসব বুঝি না। এই ধরণের রিপোর্ট ছাপা যেন আর না হয়। ' ' আমি ভাইয়া এই গ্যারান্টি দিতে পারবো না। ' 'তাহলে তোমাকে চাকরি ছাড়তে হবে। ' 'আমি কেন চাকরী ছাড়বো? আমি চাকরী চাড়লেই তো আর এইসব রিপোর্ট ছাপা বন্ধ হবে না।

জনকন্ঠ ছাত্রদলের এইসব নিয়া রিপোর্ট করবেই। ' গর্জে উঠলেন বারী চৌধুরী- 'বের হয়ে যাও। এক্ষণ হোস্টেল থেকে বের হয়ে যাও। আর যেন হোস্টেলের ত্রিসীমানায় না দেখি তোমাকে। দেখলে পিটাইয়া হাত-পা গুড়া গুড়া কইরা দিব।

' আমি সুবোধ বালকের মতো বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। বেশী প্যাঁচাইলে ডিরেক্ট অ্যাকশনে চলে যতে পারে এই লোক, কোন ভরসা নাই। রাত সাড়ে বারোটার সময় মাইর খাওয়ার তেমন ইচ্ছা হইলো না আমার। কড়া মাইর দিলে আমারে নিয়ে হাসপাতালে ছুটাছুটি করবে কে এখন? তা-ও সেইটারও চান্স নেয়া যাইত, যদি কালকে পরীক্ষাটা না থাকতো। বের হয়ে যাওয়াই সবচেয়ে ভাল বলে মনে হলো।

'তোমার মতো বেয়াদব ছেলেকে আগেই হোস্টেল থেকে বের করে দেয়া উচিত ছিল। ' কি বেয়াদবী করলাম ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার কথা তো বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েই আমি বের হয়ে যাচ্ছি। বেয়াদবিটা কোনটা হয়েছে তা অবশ্য একটু পর বুঝিয়ে দিলেন রাসেল ভাই। আমি যখন বের হয়ে যাওয়ার জন্য আবার কাপড় পড়ছি, বারী ভাই বের হয়ে গেলেন।

রাসেল ভাই আর আমি রুমে। তিনি বললেন, 'তুমি একটু নরম হও, ওর কাছে মাপ চাও,বল আর এরকম হবে না, তাহলে আর তোমাকে বের হতে হবে না হোস্টেল থেকে। ' আমি বললাম, ' না ভাই উনি বলছেন বের হয়ে যেতে বের হয়েই যাই। আমি মাপ চাইতে যাব কেন, কি দোষ করছি? আর আমি তো কথা দিতে পারবো না যে , এইরকম নিউজ আর ছাপা হবে না। এইটা তো আমার হাতে না।

' কালকের পরীক্ষার প্রয়োজনীয় বই-খাতা আর সরঞ্জাম ব্যাগে ঢুকিয়ে দরজায় তালা মেরে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি বারী চৌধুরী আবার কোথা থেকে হাজির হয়েছেন। 'চাবি দাও। ' 'চাবি কি জন্যে দিব? আপনি এই তালা ভাইঙ্গা নতুন তালা লাগায়া দিয়েন। ' 'বাংলা কথা বুঝ না, চাবি দিতে বলছি , চাবি দাও। ' তার মারমুখী ভঙ্গিমায় আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলাম না।

চাবি দিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় শুনলাম একই কথা , ' আর যেন কখনোই হোস্টেলে তোমাকে না দেখি। পিটাইয়া তক্তা বানায়া দিব বেয়াদ্দপ ছেলে...' ইত্যাদি ইত্যাদি। নিচে এসে খেয়াল হলো, রুমে পড়ার স্যান্ডেল পরে চলে এসেছি। এ অবস্থতায় কালকে ওয়ার্ডে যেতে হবে। একবার ভাবলাম, ফিরে গিয়ে তিনতলায় উঠে বারী ভাইকে বলি, 'ভাইয়া চাবিটা একটু দেন, জুতা নিব'।

পরক্ষণেই পরিকল্পনাটা বাদ দিলাম। এখন এ কথা বললে ঐ জুতা দিয়েই তিনি আমাকে পেটাতে শুরু করে দিতে পারেন। একদিন না হয় গেলাম-ই স্পঞ্জ পরে ওয়ার্ডে। হোস্টেল গেটের কাছে এসে দেখা হলো আমার ব্যাচমেট কয়েক ছাত্রদলকর্মীর সাথে। জিজ্ঞস করলো, কই যাস এতো রাতে।

' বললাম, 'তোদের নেতা বের করে দিছে হোস্টেল থেকে , রিডিং রুমে যাই। ' প্রথমে দুষ্টামী ভাবলেও ওরা পরে বুঝতে পারলো ঘটনা সত্যি। বললো, চল নাভেদ ভাইয়ের কাছে। এইটা নিশ্চয়ই নাভেদ ভাই বলে নাই। তারা নিজেরাই গেছে তোর রুমে।

নাভেদ ভাই বললে তো আমরা জানতাম, আমরাই ব্যাপারটা সলভ করতাম। ' আমার তখন নাভেদ ভাইয়ের রুমে যাওয়ার ইচ্ছা হলো না। ঐখানে তো আরো লোকজন আছে। আমার ব্যাচমেট বা জুনিয়ররা না হয় আমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু সিনিয়র যারা আছে, তারা অতো খাতির না-ও করতে পারে।

ঐ যে বললাম, এতো রাতে রক্তাক্ত, প্রহৃত হওয়ার কোন আকাংখাই আমার ভেতর জাগলো না। বের হয়ে এলাম হোস্টেল থেকে। ........................... এতো রাতে বাসায় যাওয়া সম্ভব না। ঢাকাতে হলেও বাসা বহুত দূর। আগে হাসপাতালে গিয়ে কার্ড ফোনে ফোন করলাম জনকন্ঠ অফিসে।

নাইট করছেন মাহমুদ হাফিজ ভাই। তাকে বললাম ঘটনা। তিনি বললেন, আজ রাতটা কোনমতে কোথাও কাটানোর ব্যবস্থা কর, কালকে অফিসে এসে নিউজ করো। এখন করলে সেকেন্ড এডিশনে ছোট করে যাবে হযতো। ওহো, আমার তো এটা খেয়ালেই আসে নাই, এটাই তো নিউজ হবে কালকে।

চার নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে ডক্টরদের টেবিলে গিয়ে বসলাম। সিনিয়র ভাইয়াদের তেমন চিনি না বলে ডক্টরস রুমে গিয়ে কাউকে জাগানোর ইচ্ছে হলো না। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। নাহ! সম্ভব না এখানে এভাবে ঘুমানো। কলেজ বিল্ডিংয়ের চারতলায় রিডিং রুমে এলাম।

রিডিংরুম খোলাই থাকে। তবে রাত বারোটার পরে কেউ সেখানে থাকে না আর। চারটা চেয়ার পাশাপাশি জোড়া দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বই খুলে একটু পড়ার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর বই রেখে একটু ঘুম দেয়ারও চেষ্টা করলাম।

কিন্তু ঘুম কি আর হয়! যে মশার মশা! তা-ও ওয়ার্ডের চেয়ে ভাল। শোয়া তো যাচ্ছে। না ঘুমাতে পারি। মশা তো মারতে পারছি অন্তত শুয়ে শুয়ে। বসে সারা রাত কাটানো খুবই প্যাথেটিক।

ওর মধ্যেই কেমন করে যেন একটু ঘুমিয়েও গেলাম। ছয়টার দিকেই আবার উঠে গেলাম। একটু ফ্রেস হয়ে নিয়ে বইয়ে আবার একটু চোখ বুলাতে হবে। নয়টা থেকেই তো পরীক্ষা আরম্ভ হবে। ( ছাত্র/নেতাদের নামগুলো পরিবর্তন করে দেয়া।

এখনো ব্যক্তিগত এইসব কাহিনীতে জড়িতদের আসল নাম দেয়ার বয়স হয় নাই আমার। রিপোষ্টের জন্য দুঃখিত। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।