আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জহির রায়হান: একটি ব্যক্তিগত কথন...



জহির রায়হানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই বালক বেলায় 'স্টপ জেনোসাইড' নামক অসামান্য প্রামান্যচিত্র দেখার মধ্যে দিয়ে। আমার নকশালাইট বাবা আজিজ মেহের সঙ্গে তার বন্ধু ও প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর হোসেনের শ্যামলীর বাসায় ছোট্ট প্রজেক্টরে ছবিটি প্রথম দেখি। তখন আমি স্কুলের একেবারে নীচের ক্লাসের ছাত্র। এরপর ওই একই বাসায় দেখি 'ধীরে বহে মেঘনা'সহ মুক্তিযুদ্ধের ওপর আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর সব কয়েকটির নির্মাতা আলগীর হোসেন ও খান আতাউর রহমান (সংক্ষেপে, খান আতা)।

তো সেই সময় বাবার কাছে শুনেছি, পাকিস্তান আমলে আমার বাবা, তার রাজনৈতিক বন্ধু জহির রায়হান ও বিখ্যাত আলোকচিত্রী এমএ বেগ --এই তিনজন একই সঙ্গে পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে স্টিল ফটোগ্রাফীর ওপর ট্রেনিং কোর্স করেছিলেন। আর বাবা জেল খেটেছিলেন তার আরেক বন্ধু শহিদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে। বাবার অনেক দিনের স্মৃতি বিজড়িত একটি বক্স ক্যামেরা আমার শৈশব স্মৃতিতে এখনো উজ্জল। আর তার তোলা সাদা-কালো ল্যান্ড স্কেপ, কক্সবাজারের সমূদ্র সৈকত, জেলে পড়া, রাখাইন নারী-ইত্যাদি ছবির কথাও মনে আছে। অনেক অযত্নে সেইসব ছবির বেশ কিছু পরে নোনা ধরে নষ্ট হয়ে যায়।

এখনো প্রায়-অন্ধ বাবা সেই ছবির অ্যালবামটি তার লকারে যত্ন করে রেখেছেন। তার সেই বক্স ক্যামেরা, টিসট গোল্ড কোটেড হাত ঘড়ি --এখনো বুঝি সেই লকার বন্দী। ... * প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর পর আমি পড়ি জহির রায়হানের উপন্যাস 'হাজার বছর ধরে'। তখনই টের পাই এই মহান শিল্পীর ধারালো মেধা। আর এরও পরে একর পর এক পড়তে থাকি তার অন্যান্য লেখা 'বরফ গলা নদী', 'আরেক ফাল্গুন'...সে সময় তার দু-একটি গল্প বিটিভিতে নাট্যরূপ আকারে দেখানো হয়েছিলো।

আমাদের হাই স্কুলের পাঠ্যবইয়ে জহির রায়হানের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একটি গল্পও সংযোজিত হয়েছিলো। সে সময় যখন তার লেখা গল্প, উপন্যাস, এমন কী চিত্রনাট্য খুব মন দিয়ে পড়ছি, তখন বাবা বলেছিলেন, জহিরের আসল পরিচয় সে চলচ্চিত্রকার। এ কারণে তার সব সাহিত্যই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো কাট-ছাঁট বুননে লেখা। হয়তো তার ইচ্ছে ছিলো, এ সব লেখাকে পড়ে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার। ...জহির রায়হান পড়তে পড়তে বুঝতে পারি, এ সবই সত্যি।

আরো পরে হাই স্কুলে জহির রায়হানের ছোট ছেলে অনল রায়হান আমার ক্লাস মেট হয়। সে অবশ্য অন্য সেকশনে পড়তো। আমাদের ডি-সেকশনের ছেলেদের মধ্যে এক ধরণের অংহ কাজ করতো বলে তার সঙ্গে মোটেও সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। স্কুল ম্যাগাজিনে একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর আমার একটি ছোট লেখা ছাপা হয় একবার। আর ওই ম্যাগাজিনেই অনল রায়হান ছাপেন তার একটি রহস্য গল্প।

ততদিনে আমি শার্লক হোমস, জেমস বন্ড, জেমস হেডলি চেজ, আর দস্যু বনহুর, দস্যু বারহাম, কিরিটি রায়, ব্যোমকেশ, মাসুদ রানা, ফেলুদা তো বটেই--পড়ে পড়ে অকাল পক্ক। তাই অনলের লেখা আমাকে টানেনি মোটেও। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন একদিন জহির রায়হানের বড় ছেলে বিপুল রায়হান বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমাদের আজিমপুরের বাসায়। সে একটি ১৬ মি.মি স্বল্প দৈর্ঘ ছবি বানাতে চায়। এ নিয়েই তারা দুজন বন্ধুর মতো গভীর আলোচনায় মাতেন।

সত্যি কথা বলতে, সে সময় ওই ছবিটিও দেখে আমার মনে হয়, নাহ্, এ-ও তার বাবার নাম রাখতে পারে নি! * 'হাজার বছর ধরে' প্রসঙ্গে আবারো বলছি, কলেজে পড়ার সময় দৈনিক সংবাদে মোনাজাত উদ্দীনের একটি সচিত্র প্রতিবেদন দেখে চমকে উঠি। ওই উপন্যাসেরই যেনো সার্থক রূপায়ন ছিলো সে প্রতিবেদনে। রংপুরের এক অভাগা চাষী হালের বলদের অভাবে নিজের দুই স্ত্রীর কাঁধে জোয়াল তুলে দিয়েছেন--এমনই নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয় এতে। আমি নিজে যখন এরশাদ বিরোধী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে রাত জেগে জেগে পোস্টার লিখতে থাকি, তখনও আমার মনে পড়ে জহির রায়হান। মনে পড়ে তার সেই পাক-শাসন বিরোধী গল্প।

... ওই গল্পটিতে বলা হয়, এক সদ্য চাকরিচ্যূত কেরানী বাসায় ফিরছেন। বাসায় ঢোকার মুখেই তিনি দেখলেন তার বাসার দরজায় কোন বেক্কেল যেনো সেঁটে রেখেছে হাতে লেখা এক পোস্টার। তিরিক্ষি মেজাজে পোস্টারটি ছিঁড়ে ফেলতে গিয়ে তার হাত আটকে যায়। তিনি দেখেন, এতে লেখা: ছাঁটাই করা চলবে না! * আরো পরে সাংবাদিকতায় এসে জহির রায়হানকে আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। সেই সময় ভোরের কাগজে আমার সহকর্মী জুলফিকার আলি মানিক (এখন ডেইলি স্টারে) করেন একটি অসাধরণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, জহির রায়হান আদৌ নিখোঁজ হননি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ রনাঙ্গণ মিরপুরে বীরের মতো যুদ্ধ করতে শহীদ হয়েছিলেন তিনি। কী আশ্চর্য! মানিকের ওই প্রতিবেদনটি সে সময় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির অনুসন্ধানী বিভাগে পুরস্কৃত হয়নি। আর এখনও সামাজিকভাবে, কী রাষ্ট্রীয় ভাবেও জহির রায়হান অন্তর্ধানই রয়ে গেলেন!... কিছুদিন আগে এক ব্লগে জহির রায়হান নিয়ে তিন বাহু গং বিতর্ক তোলে। সেই পুরনো কাসুন্দি: জহির রায়হান না কী বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে চাপ দেওয়ায় মুজিব সরকারই তাকে গুম করেছিলো।

জানি না, এর স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমান তত্ব-তালাশ কতটুকু। এই সব দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাবেক সহকর্মী, সহব্লগার অমি রহমান পিয়াল ক্ষিপ্ত হন। তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসি আমি। ছোট্ট সহকর্মী রনিকে কাজে লাগাই আমরা। মানিককে ফোন করে তার প্রতিবেদন প্রকাশের দিনক্ষণ জেনে নেই।

রনি প্রেস ইন্সটিটিউট লাইব্রেরি ঘেঁটে ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ফটোকপি জোগাড় করে আনেন। পিয়াল ভাই রাতের পর রাত জেগে আরো কিছু তথ্যসহ তৈরি করেন ওই ব্লগটির কাউন্টার ব্লগ। সমৃদ্ধ হয় অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ... কিছুক্ষণ আগে বিডিনিউজ এর পাতায় যখন আবারো পড়ি জহির রায়হান সংবাদ, তাকে নিয়ে সহোদরার চলচ্চিত্র বানানোর উদ্যোগ...খবরটি প্রথমেই টেলিফোনে আমি জানাই বাবাকে। আর নিউজের ব্যস্ততার পরে এই রাতে লিখে ফেলি ব্লগরব্লগর এই লেখাটি।

তবু কী জহির রায়হান পিছু ছাড়েন?... * ওদের জানিয়ে দাও/ ওরা আমার মা-বাবাকে হত্যা করেছে/ কুকুর বেড়ালের মতো/ ওদের স্টিম রোলারের নীচে/ ওরা দেখেও যদি না দেখে/ বুঝেও যদি না বোঝে/ গরম লোহার শলকা দুচোখ দিয়ে/ ওদের জানিয়ে দাও/ মরা লাশগুলোতে কেমন জীবন এসেছে। ...জহির রায়হান। । --- দেখুন: ১. গ্রুপব্লগ, জন্মযুদ্ধ ২.বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.