বাঙালী এবং নিউইয়র্কে থাকেন অথচ জ্যাকসন হাইটস্ এ আসেননি বা চিনেন না এমনটি প্রায় অসম্ভব | জ্যাকসন হাইটস্ এর ৭৩ নং সড়ক এখন ৫৫০ বর্গহাতের একটি মিনি বাঙলাদেশ বললে সত্যের ঠিক অপলাপ হবে না | বাঙালী রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও নেহাত কম নয় – গ্রোসারী বা কাপড়ের দোকানের তুলনায় |আর সেই সব রেস্টুরেন্টে দেশের মতো রাজা-উজির মারার লোক ও নেহাত অপ্রতুল নয় | বাঙালী আড্ডা প্রিয় সে কে না জানে | আগে হয়তো আমেরিকান জানতো না, এখন ওরাও বেশ জানে | আর বাঙালীর আড্ডা মানে – সর্ববিধ উপাদানের সমাহার, রাজনীতি, সমাজনীতি, ব্যবসানীতি, পরচর্চ্চা, পরনিন্দা, রমণীরুপালোচনা, কবিতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান - মায় আইনস্টাইন, মঙ্গলগ্রহে অভিযান অব্দি কিছুই বাদ যায় না | যেমন হয় বাঙালীর আড্ডা চিরাচরিতকাল ধরে এমনই আড্ডা জমে এই প্রবাসেও এখন প্রচুর | এই জ্যাকসন হাইটস্ এ তেমনি একটি নিয়মিত আড্ডা ‘তৃপ্তি’ রেস্টুরেন্টের সর্বদক্ষিণ কোণায় প্রতি শনিবার বিকেলে বসে বিগত কয়েক বছর ধরেই | এখন এ আড্ডার পারিষদদের পরিচিতি ‘তৃপ্তি’ রেস্টুরেন্টের গ্রাহকদের ছাড়িয়ে জ্যাকসন-হাইটস্ এর বাঙালী সমাজেও সুবিদিত |
এ আড্ডার জ্যৈষ্ট্যতম পারিষদ দেশের এককালীন নামজাদা আইনজীবি ও বর্তমানে অবসর জীবনে প্রবাসী কামালউদ্দিন সমাদ্দার সাহেব অতি সজ্জন মানুষ, বাকপটুতায় কিংবা আড্ডার সচল গতি সঞ্চালনে যথার্থ ভূমিকায় অতি পারদর্শী সমাদ্দার সাহেবকে সকলেই পছন্দ করেন |শুধুমাত্র একটি বদনাম তাঁর অগোচরে সবাই করে – যা মূলতঃ তাঁর অগোচর মোটেই নয়, তাহলো – সমাদ্দার সাহেব অতিশয় কৃপণ মানুষ – এককথায় কিপ্পুষশ্রেষ্ট | এ যাবত আড্ডায় কেউ তাঁকে এক কাপ চা কিনে খেতে বা খাওয়াতে কখনো দেখেনি – তাই বলে আড্ডায় চা জলপানের অভাব হয় এমনতো নয়| এ আড্ডার সকলেই বেশ শিক্ষিত ও দীর্ঘকাল প্রবাসী | আশেপাশে অন্য আড্ডাও বসে না তা নয়| কিন্তু একমাত্র এই আড্ডাটির আশেপাশেই প্রায়ই কিছু উৎসুক শ্রোতাকে এই আড্ডার পারিষদদের খুনসুটি ও আলোচনা উপভোগ করতে দেখা যায়|
এ আড্ডার প্রধান পাঁচটি চরিত্র, মাঝেসাঝে আরো দুএকজন অংশগ্রহণ করেন| এই আড্ডাই একমাত্র মনে হয় এই নিউইয়র্কে, যাতে একজন নিয়মিত রমণী সদস্যা আছেন, তিনিই উৎসুক শ্রোতার আকর্ষণ কিনা কে জানে| তিনি মিসেস লিপিকা বানু – বিশিষ্টা সমাজসেবিকা, অধ্যাপিকা, নেত্রী তথা কবি, লেখিকা| দেশে তিনি একটি কলেজে ইতিহাস পড়াতেন সে কতকাল আগে তা এখন মনে হয় উনারও মনে নেই| হয়তোবা লেখালেখিও কস্মিনকালে করেছেনও, কিন্তু এই নিউইয়র্কে কখনও তাঁর লেখা পড়েছেন এমন কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না| তিনি একবার দেশে থাকতে তাঁর কাজের মেয়ের অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন – দূর্মুখেরা বলে ওটিই তাঁর জীবনে একমাত্র সমাজসেবার নজির ছিল| কিন্তু সমাজসেবিকা হিসাবে পরিচিতিটা তিনি যে বেশ উপভোগ করেন তা বোঝাই যায়|ব্যাঙের ছাতার চাইতেও দ্রুত গতিতে গজিয়ে ওঠা অজস্র সংগঠনের কোন অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বলে দেন, তাঁর নামের আগে বা পরে কি লিখতে হবে, তার মধ্যে ‘সমাজসেবিকা ও লেখিকা’ অবশ্যই থাকা চাই|তিনি নিউইয়র্কে একটি ফ্যাশন স্টোরের মালিক, তবে এই আড্ডায় চা-জলপানের নিয়মিত সরবরাহে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য|
অপর সদস্য দেশের এককালের জবরদস্ত সরকারী কর্মকর্তা রোকনউদ্দিন সরকার একটু অন্যরকম ব্যক্তিত্ব |আড্ডায় তিনি কথা কম বলেন, কিন্তু যা বলেন, তা অনেক ভেবেচিন্তে বিজ্ঞ্বজনের মতোই বলেন| সরকার সাহেবের বড়গুণ হলো তিনি অতি সত্যবাদী- আর এই অতি সত্যবাদীতার ফল স্বরুপ তিনি তাঁর সরকারী চাকরিটি হারিয়েছেন| দেশে বর্তমানে ‘সত্যবাদীতা যে অমার্জনীয় অপরাধ, সততা একটি হাস্যকর বদগুণ’- তা জেনেশুনেও কেন যে তা করতে গেলেন-এই অভিযোগ সকালবিকাল পরিবারের কাছে তাঁকে শুনতে হয়| সরকার সাহেব জীবনে রাজনীতি করেননি সক্রিয়ভাবে, তাঁর বিশ্বাস, ‘দেশের রাজনীতি কোন সৎ মানুষের পক্ষে সম্ভব না, আলবদর-রাজাকার, আর ধান্দাবাজ প্রকৃতির ও চূড়ান্ত আদর্শহীন কিছু মানুষই এখন রাজনীতির অংগণ দখল করে আছে, সেখানে সৎ যারাও আছেন তাঁরা মূলতঃ কোনঠাসা|’ তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে, তিনি অতি দূর্ভাগ্যবশতঃ তাঁর এলাকার আলবদর বাহিনীর একজন নামকরা নেতার সন্তান| এইরকম সত্যভাষী ও পিতার অপকর্মের জন্য নিত্য অনূশোচনাকারী আর দ্বিতীয় রাজাকার বা আলবদর সন্তান বাংলাদেশে আর একটিও নেই-একথা হলফ করে বলেন সমাদ্দার সাহেব, যিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রথম সারির প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন|মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকার সাহেবের বয়স ছিলো মাত্র দশ বছর| তিনি একদিন আড্ডায় বলেই ফেললেন, তখন তাঁর বয়স মুক্তিযুদ্ধে যাবার মতো যদি হতো তাহলে তিনি নিজহাতে তাঁর পিতাকে হত্যা করতেন| যখন তিনি যথার্থই বুঝেছেন ও জেনেছেন যে, তাঁর পিতা মানবতার বিরুদ্ধে কি জঘণ্যতম অপরাধ করেছেন তখন তাঁর বয়স একুশ| একদিন সকালে তাঁর পিতাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি তাঁর কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত কিনা, উত্তরে ‘না’ শোনার পর তিনি পরণের এককাপড়েই ঘর থেকে এইযে বেরিয়ে গেলেন, তারপর আর জীবনে আলবদর পিতার মুখদর্শন করেননি এবং এক জানোয়ার আলবদরের রক্ত তাঁর ধমনীতে বইছে – এই ভাবনা তাঁকে প্রায় সময় অতি সঙ্কুচিত রাখে| তাঁর এ অভূতপুর্ব সততার জন্যে এ আড্ডায় শুধুই নয়, চেনাজানা সবমহলেই তাঁর একটা আলাদা সম্মান ও সশ্রদ্ধ কদর আছে|এই প্রবাসে সততার কদর অনেক বেশী দেশের তুলনায়, একথা স্বীকার করতেই হবে|
আড্ডার অপর দুই সদস্য কৌশিক আখন্দ ও তছলিম মজুমদার দুই ভিন্ন চরিত্রের মানুষ| আখন্দ এককালে তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে সংসদে নির্বাচন করেছেন – একবার জিতেছেনও| আর তছলিম মজুমদার মুলতঃ প্রখ্যাত এক মুসলিমলীগ পরিবারের সন্তান, যদিও তাঁর জন্মাবধি মুসলিমলীগের নামনিশানাও এলাকায় ছিলনা| তাঁর পরিবারের অধিকাংশ রাজনীতিমনস্করা পরবর্তীতে বিএনপি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছেন| বর্তমানে দুজনেই সক্রিয় রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও দুজনেরই দুইদলের প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যায়| কিন্তু সেই পক্ষপাতিত্ব কখনো আড্ডার তর্কে শালীনতার সীমা অতিক্রম করে না| অবশ্য এ দুজনেই অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত তরুণ| এই বিচিত্র আড্ডাটির আলোচনায় মনোযোগ দেবার পুর্বে এর কুশীলবদের প্রাথমিক পরিচয় না দিলে একটা অপুর্ণতা রয়ে যাবে বিশ্বাসেই এই ভূমিকার অবতারণা|
শনিবার, সন্ধ্যা ছয় ঘটিকা, জ্যাকসন হাইটস এর ‘তৃপ্তি রেস্টুরেন্টের পুর্বদক্ষিণ কোনায় একটি টেবিল ঘিরে আড্ডার সকল সদস্যগণ যথারীতি উপস্থিত| আজ বানু ম্যাডাম ‘নিজের হাতের বানানো’ পুলিপিঠা নিয়ে এসেছেন| [অবশ্য সমাদ্দার সাহেব উনার ‘নিজের হাতের বানানো’ কথাটা বিশ্বাস করেন না| কারণ একই পিঠা পাশের ‘চকবাজার’ গ্রোসারীতে সুলভ| তদুপরি ম্যাডাম অধিকাংশ সময়েই সকাল বিকেলের খাবারও রেস্টুরেন্ট থেকেই কিনে নিয়ে যান| তাই এই অবিশ্বাসের কারণ|] আখন্দ মিয়া চায়ের অর্ডার দিয়েছেন| এদের চায়ের অর্ডার দেয়াটাও বিচিত্র| প্রতিবারে দু কাপ চায়ের অর্ডার দেন আর পাঁচটা কাপে ভাগ করে সবাই খান| আড্ডার মোট সময়ে তিন চার বার চায়ের অর্ডার দেন| একমাত্র সমাদ্দার সাহেব ছাড়া চা-নাস্তার বিল সবাই ভাগ করে পরিশোধ করেন| সমাদ্দারকে বিলের ব্যাপারে প্রথম দিকে বলা হলে জবাব দিতেন, ‘আরে তোমরা সবাই চাকরিবাকরি করো, আমিই একমাত্র রিটায়ার্ড বেকার মানুষ, আমাকে চায়ের দাম দিতে বলতে তোমাদের একটুও বুকটা কাঁপে না! শ্যামল বাংলার বুকে এহেন পাষাণ সন্তানের জন্ম হয়েছে, এটা তোমরা আমায় বিশ্বাস করতে বলো!’ অতঃপর উনাকে আর কেউ বিলের ব্যাপারে কিছু বলেন না, বলা সম্ভব ও নয়, তাহলেই – ‘শ্যামল বাংলার বুকে এহেন পাষাণ তুমি’ – এ অপবাদ শুনতে হবে, এই কঠিন অপবাদ শোনার চাইতে চায়ের দাম মেটানো অনেক সহজ কাজ| অবশ্য সমাদ্দার সাহেব বছরে একবার নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে সবাইকে এইসা খাওয়ান যে, সারা বছরের চায়ের দাম এতেই পুষিয়ে যায়- মজুমদার সাহেবের এই মত| অতএব এবারে আড্ডার সংলাপে মন দেয়া যাকঃ
বানু ম্যাডামঃ দুই সতীনের সংসার যেমন সংসার না, তেমনিই দুই নেত্রীর চুলোচুলির টানে দেশটাও আর দেশ থাকল না|
আখন্দ মিয়াঃ ম্যাডাম, আপনে নিজে নারী অয়াও এই কথা কইলেন! আপনে না কই অগো পক্ষ নিবেন!
বানু ম্যাডামঃ তোমরা তো আর বলবে না, তোমাদের নেত্রী যে! আমি সত্য কথা বলতে পিছপা হই না| সত্য কিনা বল? মজুমদার তুমিই বলোতো খালেদা জিয়ার এই সংসদ বর্জন, এই ফালতু হরতাল ডাকা, এইসব আবার কিসের মতলব?
মজুমদার মুখে পুলিপিঠা পুরেছেন, মন্তব্য করলেন না, মুখ খুললেন আখন্দ মিয়া, ‘অই যে ক্ষমতা দখল! চূড়ান্ত দূর্নীতিবাজ এই মহিলা নিজের পোলাপানকে বিলিওনিয়ার বানিয়েছে – সউদি আরবে জনগণের কোটি কোটি টাকা, মণে মণে সোনা পাচার করেছে, এখনো আবার ও ক্ষমতা দখলেরই পাঁয়তারা, আর কি!
মজুমদার তাড়াতাড়ি ঢোক গিলে একটু জল খেয়ে বাঁ হাতে মুখটা মুছে নিয়ে মত দিলেন-‘ না আখন্দ মিয়া – এভাবে বলতে নেই, জিয়া ম্যাডাম নিজে টাকা পাচার করেছেন, এটা বলা ঠিক না| উনাকে কেউ হাতেনাতে ধরতে পেরেছে? এটা সত্য কথা যে উনার ছেলেরা অনেক অপকর্ম করেছে, আর মা হয়ে ছেলেদের অপকর্ম রোধ করতে পারেন নাই| আর তার দামও তো ম্যাডাম কম দেন নাই| ক্ষমতা হারালেন, মা হয়ে ছেলেদের চোখের দেখাও দেখেন না কতদিন, তবে একটা কথায় বানু আপার সাথে আমি একমত, দেশে এই সময়ে হরতালের রাজনীতিটা তিনি আবার শুরু না করলেই ভালো করতেন, আখেরে সেটা উনারই পার্টির লাভ হতো| উনারও বোঝা উচিত যে উনার দলে অধিকাংশই রাজাকার, আলবদর, কিছু দাগী ক্রিমিনাল, আর কিছু দুশ্চরিত্র ধান্ধাবাজ| ওরা যে কখনও উনাকে সঠিক পথে যেতে দেবে না সে কথা অন্ততঃ এখন উনার বোঝা নেহাতই প্রয়োজন|বাবর মিয়া, মওদুদ মিয়া, হুদা বেহুদা-এসব ধান্ধাবাজদের জন্যেই এবার উনি ডুবলেন, সেটা তিনি উপলব্ধি করতেই পারলেন না|তার খেসারত ও কি কম দিলেন বলেন!!
এতক্ষণে সরকার সাহেব মুখ খুললেন, ‘আরে ঘটে তো পড়ালেখা কিছুই নাই মিয়া, ক্লাস এইট পাশ দেয়া ঘরের বউ কালে চক্রে ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী, উপলব্ধি জিনিসটা কি গাছের ফল নাকি, প্রধানমন্ত্রী হবার মতো – ভেতরে এলেম থাকা চাই ভাই’|
মজুমদার সাহেব চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন, তাড়াতাড়ি হাত থেকে কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ না সরকার সাব- ম্যাডাম ইন্টারমিডিয়েট পাশ, পাকিস্তান আমলের’|
বানু বেগম একেবারে খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন, ‘মজুমদার-আপনি কিন্তু বেহুদা হুদার মতোই ম্যাডামের পক্ষে সাফাই গাইছেন, দুনিয়া জানে, উনি ক্লাস এইট পরা কালে আর্মি অফিসার জিয়া সাহেবের নজরে পড়েন ও উনাকে তুলে নিয়ে আসেন, মানে হলো, উনি এইট পাশও দেননি, উনার মেট্রিক পাশের কোন রেকর্ড দেশের কোন শিক্ষা বোর্ডে নাই’|
সরকার সাহেব বানু বেগমের কথায় নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে বললেন, ‘এটা সত্যি মজুমদার, এইসব তর্ক অনেক আগেই মিটে গেছে, বেগম জিয়ার দুই জন্মদিন ও ক্লাস এইট অব্দি পড়ালেখা – এই সকল বিষয় অলরেডি নিশ্চিত সত্যে পরিণত, এ নিয়ে আর তর্কের অবকাশ নেই’|
আখন্দ মিয়া অতি আত্মপ্রসাদের দৃষ্টিতে মজুমদারের কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ মজুমদার- কার পক্ষ নাও মিয়া, নিজে তো এম.এ পাশ দিছ, তাও আবার রাজনীতি বিজ্ঞানে, অমন অশিক্ষিত মাইয়ালোগরে নেত্রী মানো কওন দু;খে কও দেহি’|
এতক্ষণে সমাদ্দার সাহেব হাত তুললেন, ‘আরে মিয়ারা, তোমরা দেখি ব্যাক্তিগত আক্রমণে জড়িয়ে যাচ্ছ, এই আমেরিকার মত দেশে এসেও তোমাদের বাঙালী-কোন্দল স্বভাবটা গেলো না! হচ্ছে রাজনীতির কথা, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা, বেগম জিয়ার সার্টিফিকেট ঘেঁটে কি হবে! তবে এটা ঠিক যে, সুযোগ সন্ধানী জঙ্গী মৌলানাদের সাথে মিলে এভাবে টানা হরতাল দিয়ে দেশের মানুষের দূর্ভোগ বাড়ানোর রাজনীতি বেগম জিয়ার ছাড়া উচিত| ভাবা উচিত- ভিন্ন রকম আন্দোলনের পন্থা| আরো বেশি গণসংযোগমূলক কর্মকান্ড, সঠিক ও সত্য ইস্যু নিয়ে শান্তিপুর্ণ জনসভা, আওয়ামী নেতা কর্মীদের অরাজনৈতিক আচরণের তুখোড় সমালোচনা করা, সরকারের ভূলভ্রান্তি নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোকে জোরদার করাই মূলতঃ বিএনপি’র রাজনীতি প্রশস্ত করার পথ|কিন্তু বেগম জিয়ার চারপাশে কিছু শকুনের দল, শকুন তো শুধু ভাগারের স্বপ্নই দেখে, আর সেই ভূল স্বপ্নই ওরা বেগম জিয়াকে দেখিয়ে ভুল পথে নিচ্ছে| মজুমদার-শিক্ষিত মানুষ তুমি, তোমার কোন রাজনৈতিক ধান্ধাও নেই কখনো, অন্ধভাবে কোন রাজনৈতিক নেতাকেই সমর্থন দিওনা| জানো তো এখন আর দেশে সৎ রাজনীতিও নেই, সৎ নেতাও বড় একটা নেই, দুএকজন যারাই আছেন ওরাও বড় কোনঠাসা হয়ে আছেন এই অসৎ রাজনীতির বাজারে’|
বানু ম্যাডামঃ তবে সমাদ্দার ভাই, এই কথা কিন্তু বলা বড় জরুরী যে, হাসিনা বেগম এখন ক্ষমতায়, উনি চিরকাল বড্ড ‘লুজ টক’ করেন, উনার কথায়ও কিছুটা লাগামের দরকার| প্রয়োজনহীন ফালতু কথা বড্ড বেশীই বলেন অনেকসময়, যা না বললেই বরঞ্চ তাঁর দল ও সরকারেরই ভাবমূর্তি বাড়ে| এখন তো বয়সও হয়েছে, উনার কাছে কিছুতা প্রাজ্ঞতা ও পরিণত আচরণ অন্ততঃ মানুষ আশা করলে তা নেহাত অমূলক হবেনা|
সরকার সাহেব হেসে ফেললেন হা হা করে, তারপর বললেন, ‘বানু-এইটা আপনি কি বললেন, প্রাজ্ঞতা ও পরিণত আচরণ কি সবসময় সবার ক্ষেত্রে বয়স হলেই আসে! প্রাজ্ঞতা থাকলে আজ হাসিনা বেগম অবিসংবাদিত জননেত্রীই হতেন, শুধু আওয়ামীলীগের নেত্রী হতেননা| দেশের আপামর জনগণের নেত্রীই উনি হতে পারতেন – উনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এই সত্যটাই উনি রাজনীতির মাঠে এসে ভূলে যান| যে মহান উদারতা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা করেছে- সেই বঙ্গবন্ধুর কন্যার কাছে একটু প্রাজ্ঞতা ও উদারতা আশা করা অসংগতঃ নয় বানু, কিন্তু কি করবেন আমাদের দেশের জনগনের দূর্ভাগ্য’|
আখন্দ মিয়া চায়ের শুন্য কাপের দিকে একমনে তাকিয়ে মুখটা নীচু করে আছেন- যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছেন, আর মজুমদার আখন্দের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছেন| বানু বেগম জ্যাকসন হাইটস থেকেই প্রকাশিত অসংখ্য ফ্রি বাংলা পত্রিকার একটি বামহাতে টেনে নিয়ে [মুলতঃ অনলাইনে দেশের বাংলা পত্রিকা থেকে হুবহু কপি করে অন্যরকম ‘হলুদ সাংবাদিকতার’ ফসল] দেখালেন, - পুলিশ কি নির্মমভাবেই হরতালকারীদের গণধোলাই দিচ্ছে| মেয়েদেরও নিস্তার নেই-এইসব শয়তান হিংস্র পুলিশবাহিনীর হাতে! বানু বললেন, ‘পুলিশবাহিনীর এই হিংস্রতাই চিরকাল দেশের রাজনীতির ধারা পাল্টে দেয়| যে দলই ক্ষমতায় যায় তারা এই মিলিশিয়া বাহিনীকে সামলাতে পারেনা| কোন দরকার ছিলো- এই গণপিটুনির? হরতালেরও দরকার ছিলো না-এই গণপিটুনিরও দরকার ছিলো না| এখন বেগম জিয়া এটাকেই একটা ইস্যু করবেন- তিনি ও তাঁর দলতো এরকম ইস্যু খোঁজার তালেই ছিলেন| হাসিনা বেগম সেটাই ওদের হাতে তুলে দিলেন! এতদিন রাজনীতিতে থেকেও দুজনের কারোরই কোনরকম প্রাজ্ঞতার ছাপ নেই- এটাই বড় অনুতাপের বিষয়| ওরা তো ভোগেনা, ভোগে গরীব সাধারণ মানুষ| আর সাধারণ মানুষকে ভোগানোর রাজনীতিতেই সব দলগুলি মেতে আছে! আর যার যার আখের গোছাচ্ছে’| দীর্ঘ বক্তব্যের পর বানু বেগম থামলেন- আর ক্রোধে তাঁর ফর্সা মুখটি লাল হয়ে গেছে|
সরকার এক নিমেষ বানু বেগমের লাল মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বানু কি লাভ বলেন তো এই দুই নেত্রির কথায় শরীরের প্রেসার বাড়িয়ে!! আলোচনা করবেন, মতামত দেবেন, কিন্তু উত্তেজিত হবেন কেনো? ওঁরা কি সত্যি জনগণের জীবনের, ভবিষ্যতের কোন পরোয়া করেন, ওঁদের লক্ষ্য তো শুধুই ক্ষমতা|
সমাদ্দারও বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন সরকার, বানু তোমার কিন্তু প্রেসার, সুগার সবই প্রবল-উত্তেজিত হইও না|
মজুমদার আরেকদফা চায়ের অর্ডার দিলেন, আড্ডা মনে হয় এবার ভাঙবে, সমাদ্দার সাহেব বাংলা পত্রিকা গুলো সব গুছিয়ে পলিথিনের ব্যাগে ঢোকাচ্ছেন, আর তাতে হাসিনা-খালেদার ছবি একাকার হয়ে পলিথিনের অভ্যন্তরে স্থান পেয়ে গেলো| দৃশ্যটি দেখে সরকার সাহেব মনে মনে হাসলেন ও ভাবলেন- দৃশ্যটি বাস্তবে হলে নেহাত মন্দ হতো না, যদি দুই নেত্রীকেই দিয়ে সরকার করা যেতো!! একজন রাষ্ট্রপতি, একজন প্রধানমন্ত্রী- তাহলে কি দেশের অনেকই উপকার হতো না, অন্ততঃ দেশের মানুষ এই দুজনের প্রতিহিংসার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যেত, কিন্তু মুখে সেকথা আর বললেন না|
[এই লেখাটি মুলতঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে উদ্দেশ্য করে গ্রন্থিতঃ, এর স্থান, কাল বা পাত্র সবই কাল্পনিক, বাস্তব জীবনে কারও সাথে যদি মিলেই যায়-তা নেহাতই কাকতালীয়, এর জন্যে লেখক বা প্রকাশক দায়ী নন]
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।