আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতিশ্রদ্ধাঞ্জলি : হৃদয় দিয়ে কবিতা লিখেছেন সমুদ্র গুপ্ত

কবিতা ও যোগাযোগ

সমুদ্র গুপ্ত কৃষকের রোদ ঝলসানো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। প্রবল আবেগে তিনি রচনা করতেন স্বপ্নমঙ্গলকাব্য। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। এই সমর্থনের কথা ব্যক্ত হতো কবিতায়। তিনি বিশ্বাস করতেন এখনো উত্থান আছে।

দারুণ আড্ডাবাজ এই কবি মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন। একাকী রৌদ্রের দিকে হেঁটে যেতেন। শেকড়ের শোকে উন্মাতাল কবি ঘাসপাতার ছুরি দিয়ে নিজের দুঃখ বিদীর্ণ করতেন। সমুদ্র গুপ্ত কবি ছিলেন। বয়সও ষাট পেরিয়েছিল।

কিন্তু যাওয়ার সময় তাঁর হয়নি। একথা তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করবেন। তবু কালের কাছে তিনি সমর্পিত। আমরাও অসহায়। একজন প্রিয় মানুষ, একজন প্রিয় কবিকে হারানোর বেদনা ভোগ করা ছাড়া আর উপায় নেই।

জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তায় কেটেছে তাঁর দিন। এ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা থাকলে কাউকে তিনি বুঝতে দেননি। সমুদ্র গুপ্ত একসময় সাংবাদিকতা করেছেন। প্রশিকার মতো বেসরকারি সংস্থায় তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক ছিলেন। চাইলে যে কোনো ও পত্রিকায় কিংবা যে কোনো এনজিও তে চাকরি নিতে পারতেন।

কিন্তু কারো কাছে হাত পেতে খাওয়ার মানসিকতা তাঁর ছিল না। শেষ দিকে লেখালেখিকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। ঢাকার ভেতরে কিংবা বাইরে কোনো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেলে সম্মানী নিতেন। এভাবে কোনো রকমে সংসার চালাতেন।

চাকরি না-করেও অনেকে বাড়িগাড়ির মালিক হয়েছেন। তিনি সে পথ মাড়াননি। সত্তর দশকের শুরুর দিকে তিনি লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। যশোর সাহিত্য পরিষদও তাঁকে পুরস্কার দিয়ে সম্মাননা জানায়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাওয়া বিষ্ণু দে পুরস্কারও তাঁর কবিপ্রতিভার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

কিন্তু বাংলা একাডেমী পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম মনোনীত হয়নি। তদ্বিরে তকদির নীতিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতা লিখে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভেতরে ভেতরে শরীরে লালন করেছেন দুরারোগ্য ব্যধি। তা হয়তো নিজেও টের পাননি।

নাকি টের পেয়েও লুকিয়ে রেখেছেন, চিকিৎসার নামে অর্থ অপচয়ের ভয়ে! তবে এই ভেবে ভালো লাগছে যে, তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাতে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা এগিয়ে এসেছিলেন। আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোও তাঁর সুচিকিৎসার দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তাঁর প্রাণপ্রিয় সংগঠন জাতীয় কবিতা পরিষদও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। এটি তাঁর প্রতি কারো করুণা নয়, এই সহযোগিতা তাঁর প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তাঁর অসময়ের প্রস্থান তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যাকে কীভাবে মেনে নেবে, তা ভেবে কষ্ট পাই! সমুদ্র গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয় ১৯৮৬ সালের দিকে।

ঢাকায় এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। মফঃস্বলের এক কবিতাক্রান্ত তরুণ। কবি ও কবিতার খোঁজ পেলে ছুটে যাই। নিজেকে মেলে ধরার বয়স ও যোগ্যতা তখনো হয়নি। বেসরকারি সংস্থার ‘আশা’-র উদ্যোগে গ্রাম সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় হুমায়ুন রোডে আশার অফিসে তিনি প্রশিক্ষণ দিতে এলেন।

কী করে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, কী করে মানুষের ভেতরের কথাটি বের করে আনতে হয়, কী করে খুঁড়ে আনা তথ্য সাজিয়ে সংবাদ লিখতে হয়, সমুদ্র গুপ্ত তা শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু মাস্টারির ভঙ্গিতে নয়, বড়ভাইয়ের আন্তরিকতায়। কেবল সাংবাদিক নয়, কবি বলেই তাঁর সঙ্গে ওই পরিচয় আমার চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে। ওই প্রশিক্ষণেই পরিচয় হয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের সঙ্ঘে। আমার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রের দুই আদি শিক্ষক আজ পরলোকে।

চারণ-সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদের আমি তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। হয়তো চারণকবি সমুদ্র গুপ্তের নামেও স্মৃতি সংসদ হবে। হয়তো সেখানেও দায়িত্ব পালন করব স্বেচ্ছায়। সমুদ্র গুপ্তকে চারণকবি বলাটা কি ঠিক হলো! মোনাজাতউদ্দিনের সঙ্গে মেলাতে গিয়েই শব্দটি আঙুলের ডগায় এসে গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে শব্দটি অমূলক নয়।

তিনি তো যথার্থই চারণ ছিলেন। কবিতা হাতে নিয়ে চরে বেড়িয়েছেন দেশের আনাচে-কানাচে। কারো সঙ্গে পরিচয় হলে জানতে চাইতেন, বাড়ি কোথায়? জবাবে জেলার নাম বললে বলতেন, গ্রামের নাম বলুন। কী আশ্চর্য, সমুদ্র গুপ্ত গ্রামের অবস্থানও চিনতেন। প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো কাব্যসভায় ডাক পড়লেও তিনি ফেরাতেন না।

একবার তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ির বর্ষাপাড়া গ্রামে। আদিবাসী কাব্য শিল্প নিকেতনের (আকাশিনি) কবি জ্যাঠা টুডু ও কবি পূরবী যাফরের আমন্ত্রণে তিনি প্রধান অতিথি আমি বিশেষ অতিথি। কাঁকর বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে তিনি গ্রামে পৌছলেন। সঙ্গে স্ত্রী সোহানা হ্যাপী ও মেয়ে নীল সমুদ্র। সাঁওতাল নরনারীর সঙ্গে কী আন্তরিকতায় তিনি মিশে গেলেন।

প্রধান অতিথির আসন ছেড়ে কী অবলীলায় তিনি চাটাইতে গিয়ে বসলেন। দেশের এমন কোনো উপজেলায় নেই, যেখানে কবি হিসেবে সমুদ্র গুপ্তের পদচারণ ঘটেনি। তিনি তো অবশ্যই চারণকবি! বাস করেছেন নগরে। তাই হয়তো নাগরিক চারণকবি বলে তাঁকে সম্মাান জানাতে আপত্তি থাকে না। সমুদ্র গুপ্ত চাকরি করতেন না।

তাঁর মতো চাকরি না করার দুরবস্থা আমারও দু’একবার হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। প্রথমবারের মতো যেদিন চাকরি হারাই, সেদিন বিকেলে শাহবাগে আজিজ মার্কেটে দোতলা উঠতেই দেখি সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন সমুদ্র গুপ্ত। তিনি নিচে নেমে আসছিলেন। আমাকে দেখে দাঁড়িয়েছেন।

এগিয়ে যেতেই দুই বাহু দিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বললেন, ‘আমি জানি, কার জন্য তুই চাকরি ছেড়েছিস। ও তো হিংস্র! তোকে আমি তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। আমার কবিতার বই নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিস ওর পাতায়, আর ওর অফিসে চাকরি করে ওর বই নিয়ে আলোচনাই লিখিসনি, এই অপরাধে তোর তো চাকরি আরো আগেই যাওয়ার কথা!’ বলেই হো-হো করে হেসে উঠলেন। আমার চাকিরহারার বেদনা আমি ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে গেলাম।

তাঁর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন দেখা হতে গত কয়েক বছর ধরে। তাঁর ধমকের ভাষাও যে কত মধুর ছিল, যারা না খেয়েছে তারা টের পাবেন না। অস্বাভাবিক মনোবল ধারণ করতেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি যোগাড় করতে পারিনি -- এখবর তিনি জানতেন। একদিন এক গলির মোড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই আমাকে জাড়িয়ে ধরলেন, তাঁর চোখ দিয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে দেখে আমি হতবাক।

তিনিও নির্বাক চলে গেলেন। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার এ এক অভিনব কৌশল! প্রকৃত প্রস্তাবেই তিনি ছিলেন বঞ্চিতের সমব্যথী। সমুদ্র গুপ্ত মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথের প্রথম কাতারের সৈনিক। জাতীয় কবিতা পরিষদের আন্দোলনে প্রথম থেকেই যুক্ত, ওতপ্রোত যুক্ত।

দীর্ঘদিনে সাংগঠনিক সম্পাদক। দুইবার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ কাব্যোন্দলনের জন্য গঠিত হয়নি। রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য কবিদের সংগঠন ও বার্ষিক উৎসব আয়োজনের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। এরশাদের পতনের আন্দোলনের এই সংগঠন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।

এপ্রসঙ্গে কবি মোহন রায়হায়ন ও কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা মনে পড়ে যায়। তাঁদের পরিকল্পনায় উপ্ত হয়েছিল এই সংগঠনের বীজ। সমুদ্র গুপ্তরা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। মত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। লোকটি কবি ছিলেন।

কবি ছাড়াও লোকটি ভালো মানুষ ছিলেন। সদাহাস্য, সদাপরিহাসপ্রিয়, সদাবিদ্রোহী অনাবিল মানুষ ছিলেন। তাঁর বন্ধুভাগ্য ঈর্ষণীয়। প্রথম দেখাতেই আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর সঙ্গে একাবার যাঁর সম্পর্ক হয়েছে তিনি আর তাঁর সান্নিধ্য-বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।

লোকটা সাহসী ছিলেন। সত্য প্রকাশে অকপট ছিলেন। পিতৃদত্ত নামের আড়ালে গিয়েছিলেন সত্যপ্রকাশের কৌশল হিসেবে। আবদুল মান্নান ঢেকে গিয়েছিল সমুদ্র গুপ্ত নামের আড়ালে। দিনবদলের রাজনীতিতে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে করেছেন। স্বাধীন দেশে আর আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়নি। কিন্তু আড়ালের নামটিই হয়ে ওঠে তাঁর প্রকাশ্য পরিচয়। তাঁর জীবনাচরণেও একজন সমুদ্র গুপ্তের নামের আড়ালের আবদুল মান্নান বাদশা কখনো প্রকাশিত হয়নি। মেয়েদের নাম রেখেছেন নীল সমুদ্র ও স্বপ্ন সমুদ্র।

আচারসর্বস্ব ধর্মকর্মে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাঁর বিশ্বাস ছিল সততায়, উদারতায়, মানবিকতায়। সমুদ্রের মতো বিশাল ছিল তাঁর হৃদয়। সর্বার্থেই গুপ্ত ছিল তাঁর বৈষয়িক চাওয়া-পাওয়া ও লোভ-লালসার আকাকঙ্ক্ষ। আর্থিক দারিদ্র্যে কেটেছে তাঁর সংসার।

কিন্তু মানসিক দৈন্য তাঁর ছিল না। হৃদয় দিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবিতাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।