আমলাতন্ত্র নিয়ে চমৎকার একটি গল্প লিখেছিলেন হাসান আজিজুল হক- 'পাবলিক সার্ভেন্ট' শিরোনামে। আমলাদের চিন্তাভাবনার ধরন, ক্ষমতার কেন্দ্র সম্বন্ধে তাদের মূল্যায়ন, সামরিক শাসকের সঙ্গে তাদের আঁতাত, নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার প্রক্রিয়া এবং তার প্রতিক্রিয়া- কী নেই এ গল্পে? বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে, যেখানে সামরিক শাসন এক অনিবার্য ও দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবতা হিসেবে রয়ে গেছে, এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। এই একটি গল্পেই বোঝা যাবে, কীভাবে আমাদের দেশে সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, বৈধতা পায়; কীভাবে আমলাতন্ত্র তাকে সহায়তা করে, সমর্থন করে। 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস' এই কথা নাকমুখ খিঁচিয়ে যতই বলা হোক না কেন, ক্ষমতা কেন কখনোই জনগণের হয়ে ওঠে না, তার কারণ বোঝা যাবে আমলাদের এই ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে-
তোমাদের বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট, কিন্তু আদতে তোমরাই জনগণের শাসক। কাজেই ঘোড়ায় চড়তে শেখো এবং চাবুক চালানো আয়ত্ত্ব করো।
... কিন্তু দাঁত কেলিয়ে ঘাড় চুলকে বিনয় দেখিয়ে পাবলিক সার্ভেন্ট কথাটা সবসময় চালিয়ে যাবে। তা না হলেই বাঁশ যাবে, চামড়া খিঁচে নেবে জনগণ...। শাসক তুমি যতোই হও তুমি কিন্তু সত্যি সত্যিই সেবক, ক্ষমতার সেবক। ক্ষমতা কার? সেটা প্রশ্ন পর্যন্ত করবে না। ক্ষমতার নাক মুখ চোখ নেই।
...
কিংবা
মামুন রশীদের আলাপের সূত্রগুলো এইরকম : যে কোনো প্রস্তাব, যে কোনো কাজ সমর্থনযোগ্য। দুই, যে কোনো প্রস্তাব, যে কোনো কাজ খণ্ডনযোগ্য। তিন, পথের কোনো অন্ত নেই এবং সব পথই পিচ্ছিল, অতএব যে কথাটা সত্যিই বলা হয়েছে, সে কথাটা সত্যিই বলা হয় নি। আর সর্বশেষ হলো বাস্তবের দিকে কখনো চেয়ে দেখা যাবে না, হিসেবটা সব সময়েই আমাদের দিক থেকে। ...
কিংবা সামরিক শাসক যখন নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন; কারণ, জনগণের কাছে না গিয়ে কতদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যাবে, এ নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, তখন মামুন রশীদের কথামালা-
জনগণের কাছে যেতে হবে কেন, ক্ষমতা যখন জনগণের কাছ থেকে আসেনি?...ক্ষমতা এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছে সে বিষয়ে জনগণের কোনো ভুল ধারণা আছে বলে আমার মনে হয় না।
...আসল কথা হচ্ছে ক্ষমতাটা যিনি দখলে রেখেছেন তাঁর শাসন জনগণ মেনে নেবে। ... সেনাবাহিনী জনগণের অংশ, বিচ্ছিন্ন অংশ। ... সেনাবাহিনী একটা সংঘবদ্ধ শক্তি- জনগণের সঙ্গে সেটা কখনো মিশ খায় না। ... ফায়ার আর্মস এমনিতে ঠাণ্ডা হিম কিন্তু ইস্পাতে হাত পড়লে... বদলাবদলির সময়টায় জনগণ স্পষ্ট করে বুঝে যায় যে তাদের কখনো কিছু করার নেই। ... ক্ষমতা ভাগ হয় না, ক্ষমতা এক, অবিভাজ্য।
এইরকম নানাবিধ উজ্জ্বল বাক্যমালায়, এক অনবদ্য গদ্যে, উইট আর হিউমারের সহযোগে তিনি ফাঁস করে দিয়েছেন আমলাতন্ত্রের গোমড়।
আসলে সেনাবাহিনী যেমন একটা সংঘবদ্ধ শক্তি, তেমনি আমলাতন্ত্রও এক সংঘবদ্ধ শক্তি। সেনাবাহিনীর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল, আর আমলাদের ক্ষমতার উৎস সুদীর্ঘকাল ধরে প্রত্যক্ষভাবে জনগণকে শাষণ করার 'অমূল্য' অভিজ্ঞতা। আমলারা যে জনগণের পাল্স বোঝেন না, তা নয়, খুব ভালো করেই বোঝেন এবং বুঝেশুনেই সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেন। আর এই দুই সংঘবদ্ধ শক্তি যখন 'ক্ষমতা' নামক চোখনাকমুখহীন একদেহে লীন হয়, তখন জনগণের আর কিছুই করার থাকে না।
ক্ষমতার পালাবদলে কার কী ভূমিকা এ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা রাজনীতিবিদদের কথা বলি, সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রচুর কথা বলি, কিন্তু কখনোই আমলাদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা হয় না। অথচ এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে, আমলারা এই ধরনের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জিয়া ও এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আমলা তাঁদের কাছে গিয়ে সর্বাত্নক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরশাদের পতনের সম্ভাবনা দেখে, নব্বইয়ের আন্দোলনের শেষদিকে কতিপয় আমলা এরশাদ সরকারের পক্ষত্যাগ করেছিলেন! এমনকি 'গণতান্ত্রিক' শাসনামলেও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে আমলাদের সদম্ভ অংশগ্রহণ এবং বিএনপি সরকারের পতনের মধ্যে যে যোগসাজশ ছিলো সেটি সকলেই বোঝেন।
আবার ২০০১ সালে নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশনে কয়েকজন আমলার প্রশ্নবোধক উপস্থিতি এবং অতঃপর চারদলীয় জোটের বিস্ময়কর জয়ের সংবাদ প্রচারের মধ্যেও যোগসাজশ খুঁজে পাওয়া যায়। ২০০৭-এর পরিবর্তনে আমলাদের ভূমিকা কী ছিলো, সেটিও হয়তো কিছুদিন পর জানা যাবে।
সমস্যা হলো, আমলাদের এই ভূমিকাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে প্রচারিত হয় না। ঠিকভাবে বুঝেও ওঠা যায় না। কিছু কিছু ব্যাপার অনেক পরে জানা বা বোঝা গেলেও ততোদিনে এগুলো পুরনো হয়ে যাওয়ায় গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না।
আমলারা তাদের যাবতীয় কুকীর্তির ইতিহাস নিয়েও নিরাপদেই থাকেন!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।