আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গদ্যচর্চায় জসীম উদ্দীন



জসীম উদ্দীন মূলত আধুনিক গীতি কবি। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কবিতা চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। কবিতা অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে খুব সম্ভব তিনি গদ্যচর্চা শুরু করেন। লোক কাহিনী, ভ্রমণ সাহিত্য, প্রবন্ধ-সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি গদ্যচর্চা আজীবন অব্যাহত রেখেছিলেন। জসীম উদ্দীন [১৯০৪-১৯৭৬] কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে গদ্যচর্চা শুরু করেছিলেন বলে মনে হয় না।

জসীম উদ্দীনের গদ্য চারিত্র্য প্রধানত সাবলীল ও সহজ কাব্যধর্মী। কবিতার মতো চিত্রকল্প, উপমারূপক তাঁর গদ্যকে সংহতি দিয়েছে প্রায়শ। বস্তুত ‘শ্রেষ্ঠ লেখকের রীতি বা স্টাইল কেবল তার বক্তব্যকে প্রকাশ করে না, তা কেবল ভাষার বাইরের অলংকারও নয়,- তার ভিতরে রয়ে যায় অন্তঃপুরুষের সুনিবিড় প্রকাশ, গতিসত্তার অনবদ্য রূপায়ন। ’ জসীম উদ্দীনের গদ্যেও ঘটেছে অন্তঃপুরুষের সুনিবিড় প্রকাশ ও রূপায়ন। সে জন্যই তিনি সহজ কথা সহজভাবে বলতে চেষ্টা করেছেন এবং এটি তাঁর গদ্যের মহত গুণ।

উল্লিখিত হয়েছে, জসীম উদ্দীনের গদ্যের চাল সহজ কাব্যধর্মী। আসলে গদ্য দরকার পড়লে কাব্যধর্মী হয়ে ওঠে- যেমন উপনিষদে, প্লেটো ও বের্গসূঁর দর্শনে, গিবন আর সম্সনের ইতিহাসে, তুর্গেনেব, লরেন্স আর জয়েসের উপন্যাসে। কাব্যধর্মিতা বাংলা গদ্যের ইতিহাসেও বিরল নয়। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কমল কুমার মজুমদার প্রমুখের গদ্যও কাব্যনুসারী। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও কমল কুমার মজুমদারের গোপাল সুন্দরী কাব্যসৌন্দর্যমণ্ডিত।

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিভূতিভূষণ, মশাররফ হোসেন প্রমুখের বহু গল্প-উপন্যাসে কাব্যধর্মিতা অল্প নয়। বাংলা গদ্যের দুটো ধারা আজো বহমান। এর একটি হচ্ছে সাধু ও অন্যটি কথ্য। সাধুরীতির ধারাটি ছিল সংস্কৃতানুসারী সাধুরীতি। এ রীতি অলংকার বহুল।

ভাষা বিপ্লবের প্রথম দিকে এ রীতিই প্রাধান্য লাভ করেছে। চলতি বা কথ্যরীতির ব্যবহার শুরু হয়- পরে- অনেকটা প্রমথ চৌধুরীর কাল থেকে। প্রমথ চৌধুরীই সফল কথ্যরীতির প্রথম প্রবর্তক। জসীম উদ্দীন সাধুরীতিতে গদ্য চর্চা করেছেন আজীবন। বিদ্যাসাগরের পণ্ডিতি-রীতি ছাড়াও তিনি তত্ত্ববোধিনী, বঙ্গদর্শন, ভারতী, সবুজপত্র ও ফোর্ট উইলিয়ামের গদ্যচর্চা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।

তদুপরি রাজা রামমোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত এবং অনেকের গদ্যচর্চা সম্পর্কেও তিনি অনবহিত ছিলেন না। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালী গদ্য’ তার রূপও বৈশিষ্ট্য যেমন- প্রমথ চৌধুরীর ভাষার তীব্র শ্লেষ, কৌতুকরস, কাব্যরীতির কথ্যভঙ্গি, কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলের ভাষা, আরবি-ফারসি শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ, অবলীলাক্রমে দেশি-বিদেশি তৎসম শব্দের ব্যবহার, ক্রিয়াবিভক্তি, কারকবিভক্তি ও অব্যয়ের নতুন রূপ আবিষ্কার এবং সন্ধিপূর্ণ দীর্ঘবাক্য পরিহার ইত্যাদি জসীম উদ্দীনের জানা ছিল। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুঁতোমী গদ্যের কথা ও সাধুরীতির মিশ্রণহীন খাঁটি সরলতা এবং বিভিন্ন ভাষার শব্দ গ্রহণের সুচিবায়হীনতাও তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। মোটকথা,- মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১৪) গদ্যরীতি, বঙ্কিমী রীতি, রবীন্দ্র-নজরুল এমন কি প্রমথ চৌধুরীর গদ্যচর্চা ও রীতি সম্পর্কে জসীম উদ্দীনের চেতনাবোধের অভাব ছিল না। সে কারণেই তিনি না আলালী, না হুঁতোমী, না বঙ্কিমী, না রবীন্দ্রনাথ কিংবা প্রমথ চৌধুরীর রীতিকে অনুসরণ করেন।

কারণ ‘বঙ্কিকমের রুচিশীলতা, রবীন্দ্রনাথের শালীনতাবোধ ও প্রমথ চৌধুরীর বিদগ্ধ মনোবৃত্তির ফলে বাংলা গদ্য লোকায়ত জীবন থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। বাংলা গদ্য হয়ে উঠেছে কৃত্রিম এবং গণজীবন থেকে বহু দূরবর্তী। এ কারণেই জসীম উদ্দীন তাঁর গদ্যরীতিতে আঞ্চলিক বাক্রীতি প্রয়োগে একটি নতুন ভাষারীতি গড়ে তুলেছিলেন এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। জসীম উদ্দীনের গদ্যচর্চাকালে গদ্যে কথ্যরীতি প্রয়োগের প্রবল ঝড় ওঠে। এদিকে ‘বাংলা গদ্যের চলতি রূপকে চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

প্রমথ চৌধুরী একে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেলেও এর সর্বশেষ রূপকরণের জন্য রবীন্দ্রনাথের মতো অসাধারণ শিল্পীর প্রয়োজন ছিল। গদ্যচর্চার এই বিপ্লবে জসীম উদ্দীন যোগ দেননি। তিনি বলেন, ‘একদিনের কথা মনে আছে। পণ্ডিত মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আমি বাংলায় বই লিখিতে চাই। আপনি আমাকে কিছু উপদেশ দেন।

এ জন্য আমাকে কি করিতে হইবে। ’ তিনি হাসিয়া বলিলেন, ‘তুমি বাঙালির ছেলে। যাহা লিখিবে তাহাই বাংলা হইবে। এজন্য তোমাকে কিছু করিতে হইবে না। তোমার যাহা বলিবার আছে- যেমন আমার সঙ্গে কথা বলিতেছ, তেমন করিরাই লিখিবে।

তাহাই হইবে তোমার উৎকৃষ্ট রচনা। পরবর্তী জীবনে পণ্ডিত মহাশয়ের এ উপদেশ আমি আমার গদ্য রচনায় প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। রীতি যা-ই হোক-জসীম উদ্দীন সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ এবং সহজভাবে অত্যন্ত দরদ ও আবেগ দিয়ে খোলামেলাভাবে বলতে চেষ্টা করেছেন। গ্রামের মানুষ যেভাবে, যে ভঙ্গিমায় কথাবার্তা বলে, চলাফেরা করে, খায়-দায়, ধর্ম-কর্ম করে অর্থাৎ গ্রামের মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের ভাষাই তিনি তাঁর গদ্যে প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করেন। সহজতা ও সাবলীলতাই জসীম উদ্দীনের গদ্যরীতির প্রকৃষ্ট পরিচায়ক।

এটি তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রকাশক স্টাইল। শুধু রীতি বা ভঙ্গি নয়- লেখকের ব্যক্তিত্ব যখন তাঁর রচনার ভেতর দিয়ে গভীরভাবে প্রকাশ পায়- তখন একটি স্টাইলের রূপ-বৈচিত্র্যে তার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে- যা জসীম উদ্দীনের গদ্য রচনায়ও তা দুর্লক্ষ্য নয়। আসলে গদ্য লেখকরা সবাই জয়েস বা কমলকুমার না হলেও সূক্ষ্মভাবে অনেকেই ভাষাটাকে কিছুটা নিজের মত করে ব্যবহার করতে ভালোবাসেন। তবে যেহেতু গদ্যের ভাষায় সামাজিক চরিত্র থাকতেই হয়- তাই দেখা যায়- নিজস্ব ভঙ্গির বা স্টাইলের প্রয়োজন যতটা দরকার, ততটাই গদ্য লেখক দাবি করেন, তার বেশি নয়। জসীম উদ্দীনও তা করেছিলেন।

কিন্তু কমলকুমার মজুমদার ইংরেজির অনুকরণে নয়, ফরাসি রীতির অনুকরণে বাংলা গদ্যচর্চা করতে চেয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর গদ্যেরও একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। জসীম উদ্দীন সাধুক্রিয়াপদ আঁকড়ে থেকেও সকলের জন্য একটি ভাষারীতি তৈরি করেছিলেন যা আধুনিক কথ্যরীতির খুব কাছাকাছি। আসলে গতি ও স্টাইল নিয়েই গদ্য। জসীম উদ্দীনের গদ্যের স্টাইলের জন্যই কেবল আমরা তাঁকে নাম স্বাক্ষরবিহীন অবস্থায়ও চিনে নিতে পারি।

জসীম উদ্দীন তাঁর গদ্য রচনার সর্বত্রই ক্রিয়ার সাধুরীতির রূপ অনুসরণ করেছেন। এবং এ বিচিত্র ব্যবহারের ফলে তাঁর সাধুরীতির মধ্যেও শক্তি ও লাবণ্য ফুটে উঠেছে। এছাড়া তৎসম, তদ্ভব, দেশী-বিদেশী এবং আঞ্চলিক তথা গ্রাম জনপদে প্রচলিত আটপৌরে এবং সর্বজন ব্যবহৃত ‘শব্দ’ ব্যবহার পূর্বক গদ্যকে তিনি মৌখিক বাক্রীতির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর গদ্যের মুখ সর্বদা আধুনিক কথারীতির দিকে। এটিই তাঁর গদ্যশৈলীর মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

জসীম উদ্দীনের গদ্যরীতি আজীবন একই খাতে প্রবাহিত। কোনো বাঁক নেই। গদ্যের চাল, গদ্যের মুখ হামেশা একই দিকে বহমান ছিল। তিনি গদ্যে ক্রিয়ার কালরূপ নির্ধারণ ও প্রয়োগে সর্বাংশে সচেতন শিল্পী ছিলেন- যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, আবুময়ীদ আয়ুব, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ। সব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বলতে হয়-জসীম উদ্দীনের গদ্যের সাবলীলতা, সহজবোধ্যতা, আন্তরিকতা, আবেগময়তা, বিশ্বস্ততা, চিত্রলতা ও পরিণত বাক্-বিন্যাসের প্রবণতা কোনো সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়াবার কথা নয়।

[ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনা ও জীবন কথা গ্রন্থ দুটো এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য] এবং এইটেই জসীম উদ্দীনের গদ্যের মৌল বৈশিষ্ট্য এবং এখানেই তিনি শিল্পী-গদ্যশিল্পী। (সূত্র: বাংলাপিডিয়া, ইত্তেফাক)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.