আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতার সঙ্গে পথ হাঁটা / সৈকত হাবিব



যারা কবিতা নিয়ে ভাবেন , কবিতা লিখেন , তারা লেখাটা পড়তে পারেন। ভাবনার খোরাক পাওয়া যাবে লেখাটায়। ******************************************************************** কবিতার সঙ্গে পথ হাঁটা সৈকত হাবিব ============================================= মাঝে মাঝে বড়ো বিস্মিত হয়ে ভাবি, কী করে একজন কবি কবিতার সঙ্গে পথ হাঁটেন! কবির সঙ্গী হিসেবে কবিতা কিংবা কবিতার সঙ্গী হিসেবে কবি, সম্পর্ক বা ভ্রমণটা কি খুব সুখের নাকি? হয়তো কখনো কখনো। কিš' যখন সঙ্গ বা ভ্রমণটা হয় দীর্ঘ, তখন জীবনের নানা টানা ও পোড়েন, বেদনা কিংবা শোক, উপলব্ধি ও অস্তিত্বের দ্বৈরথ, রূঢ় বাস্তব ও কল্পনার লতা মিলিয়ে সে কি এক জটিল জড়াজড়ি নয়? আজকের দিনে, যখন ভোগের ভাগের জন্য সীমাহীন কাড়াকাড়ি, জীবনের প্রয়োজন আর দাবিও যখন বাড়াবাড়ি রকমের, জীবন যখন পূর্ব-পশ্চিম আর ধনী-নির্ধন কাউকেই এখন কল্পনা কিংবা অবসরের সুযোগও দিতে চায় না, তখন কবিতার মতো একটি সময়ের হাতে প্রায় পরাজিত শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে বসবাস কতোটা বিষয়সম্মত? (তবে যুক্তিসঙ্গত কিনা সে প্রশ্নই থাকা উচিত নয়, কারণ বিষয়ের যুক্তি আর শিল্পের যুক্তি এক ব¯' নয়। সেটা হওয়ার নানারকম ঝামেলাও আছে।

সে বরং থাক, ভবিষ্যতের অন্য কোনো সময়ে, অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে আরো গভীর কোনো আলোচনার উত্থানের জন্য। ) আরেকটা ব্যাপারও আছে, কবিতার সঙ্গে রহস্যের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অচেনার সঙ্গে, অদৃশ্যের সঙ্গে, রহস্যময়তার সঙ্গে কবিতার দাম্পত্য সেই আদিকাল থেকেই। ব্যাপারটা কেমন, তা এক প্রাচীন গ্রিক কবির উচ্চারণ থেকেই টের পাওয়া যায়, যখন সামান্য রহস্যময় একটি ঘটনায়ই তিনি বলে উঠেন, কোনোই বিস্ময় আর বাকি নেই পৃথিবীতে। আর ঘটনাটি ছিল কোনো অগ্ন্যুৎপাত বা সচরাচর ঘটে না, এমন কোনো প্রাকৃতিক বিষয়।

অথচ, তারপর পৃথিবী অতিবাহিত করেছে আরো প্রায় তিন হাজার বছর, বিশ্বের শুধু নয়, বরং মহাবিশ্বেরও অনেক রহস্যই আজ উন্মোচিত হয়েছে মানুষের হাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর অজস্র-অসংখ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবনের কল্যাণে। তাহলে কবিতার রহস্যময়তার সন্ধান কি বিজ্ঞানই অনেকটা মিটিয়ে ফেলছে না? এমন এক বাস্তবতায় কবিতা কি আরো দুর্বলতর হয়ে পড়ছে? অচেনা যতো চেনা হচ্ছে, অদৃশ্য যতো দৃশ্যমান হচ্ছে, রহস্য যতো উন্মোচিত হচ্ছে, কবিতা কি ততোই তার ভাষা ও বোধের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে? আর এই সবের মধ্য দিয়ে সে কি তার পতনের গানকেই বাজিয়ে চলেছে সময়ের তারে ও বে-তারে? হয়তোবা। হয়তো তা নয়। কিš' আজকের এই পৃথিবীতে পাঠক-মানবের সঙ্গে যেমন, কবির সঙ্গেও কবিতার পথ হাঁটা আরো পিচ্ছিল আর কষ্টকর হয়ে উঠছে। অনেক সময় ক্লান্তিকরও।

পথ হাঁটা তবু থামছে না। থামা সম্ভবও নয়। হয়তো। কারণ, জীবন যদিও আমাদের তার ভারবাহী গাধায় পরিণত করেছে, প্রতিনিয়ত ঘৃণায়-বিবমিষায়-ক্লান্তিতে-ক্ষুধায়-রুগ্ণতায় বিপন্ন করে তুলছে, তবু আমরা তো প্রতিটি মুহূর্তে জীবনেরই শস্য ফলাই আর জীবনের ভাঁড়ার পূর্ণ করে চলি। জীবনের এতো বৈরিতা, এতো বিপর্যয়, এতো পরাজয়, তারপরও জীবনই আমাদের নিয়ে হেঁটে চলে অন্তহীন পথ ধরে।

আর কবিতাও তো জীবনেরই এক গূঢ়-গভীর অঙ্গ। তাকে অনঙ্গ করে কী করে চলবে স্বয়ং জীবন! প্রশ্নটা এমন আসতেই পারে যে, শরীরের অনেক অংশ না থাকলেও তো জীবন ঠিক ঠিক চলে যায়, যদি প্রাণটা থাকে। কাজেই কবিতা না থাকলে ক্ষতি এমন কী-ই বা। জীবন তো অপূর্ণতার মধ্য দিয়েই নিজেকে যাপন করে চলে। কথাটা সঙ্গতও বটে।

আর এ তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, কবিতার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষেরই সম্পর্ক এখন পাঠ্যপুস্তক আর পরীক্ষা পাস পর্যন্ত, তাও যদি খুব জরুরি হয়। পৃথিবীর কোনো অক্ষরহীন (এবং ‘আমাদের’ চোখে ‘অ-সভ্য’) সমাজ বা জনগোষ্ঠীর কাছে এখনো হয়তো তন্ত্র-মন্ত্র কিংবা দিনানুদৈনিকের প্রয়োজনে কবিতা টিকে থাকলেও, আমাদের স্বাক্ষর সমাজে এর ব্যবহারিকতা এখনো শিশুদের পদ্য বা রাইমসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারপর জীবন যতো দীর্ঘ ও জটিল হতে থাকে, তার প্রয়োজনও লুপ্ত হতে থাকে। অন্যদিকে আজকের ভোগব্যাকুল, কামনাজটিল পৃথিবীতে, কবিতাতেও আর সারল্যের সুযোগ নেই। সময় ও মননের জাটিল্যের ভেতর কবিতাও ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠেছে গূঢ়জটিল।

তাই তাও সকলের কিংবা অধিকাংশের আস্বাদবঞ্চিত। অথচ, কী আশ্চর্য, কবিতার মতো অনাথ একটি মাধ্যমের জন্যও জীবনপাত করতে দেখি কতো কতো কবিকে। সে কেবল আজকের দিনে নয়, সুদূর অতীতে যেমন ছিল, হয়তো দূর আগামীতেও দেখা যাবে। কবিতা কী দেয় কবিকে যে, তার এই গভীর আত্মনিগ্রহ? অথচ তার ভেতরেই নিজের চূড়ান্ত নির্বাণ দেখা? যেন কবিতার বাইরে তার কোনো আর পৃথিবী নেই, সুখ নেই, সুন্দর নেই, পূর্ণতা কিংবা গন্তব্য নেই? মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শামীম কবিরÑ আমাদের সামনে এমন অজস্র নতুন ও পুরোনো উদাহরণ ছড়ানো, যারা কবিতার সঙ্গে পথ হাঁটতে গিয়ে ক্রমাগত নিজেকে নিঃশেষ কিংবা বিনাশ করেছেন। এখনো অনেকেই আমাদের অজান্তেই করে চলেছেন।

তাদের অনেকেরই আজকের পৃথিবীর কাম্য বিত্ত, বিলাস, ভোগ, বৈভব সবকিছু অর্জনের বেশ সক্ষমতা ছিল কিংবা আছে। অথচ, কবিতার মতো কুহকিনী, দুঃখজাগানিয়ার সঙ্গে পথ হাঁটতে গিয়ে তারা অনেকেই কষ্ট-লাঞ্ছনা-দারিদ্র্যের পথকেই শ্রেয়তর ভেবেছেন। কিš' এই শ্রেয়বোধের সঙ্গে কি যাতনাও মিশে নেই? নইলে কেন কারুবাসনা উপন্যাসের নায়কের মুখে জীবনানন্দ দাশের নিজেরই এমনতর কাতর কণ্ঠস্বর শুনি, কারুবাসনা আমার জীবনকে বড়ো ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ভোগের বাসনা নয়, কারু, অর্থাৎ শিল্প, কিংবা আমাদের আলোচ্য কবিতা-বাসনার জন্য কবির এই যে অন্তর্গত রক্তক্ষরণ আর দৈন্যতা- এ কি এক অনিঃশেষ দ্বৈরথ জীবন ও কবিতার? যদি এই আত্মত্যাগ, তবে কেন এই দৈন্য-গাথা, এই করুণ স্বীকারোক্তি? কোন বাসনা তাকে এমন ছিন্নভিন্ন করে, পার্থিব হিসাব-নিকাশের বাইরে নিয়ে যায়? তাকে কেন ঘরহীন, আত্মহীন করে? কেন করে? সে কি তার নিয়তি? একসময় মনে হতো, অমরত্বের বাসনা হয়তো এর প্রেরণা। এখন আর তা মনে হয় না।

বরং কবির ভেতরে থাকে কবিতার এমন তীব্র বীজ, যে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তার ভেতরের জমিনে কবিতার শস্য রোপণ করে, শস্য ফলায়। কবিতা হয়তো কবিকে এমন এক কৃষকে পরিণত করে, যেখানে তার নিজের কবিতাজমিনের বাইরে যাওয়ার খুব বেশি পথ খোলা থাকে না। আর যদি কবি সেই জমি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, অনেক সময়ই সে আর ফিরে আসতে পারে না, দু-এক পরম ভাগ্যবান ছাড়া। কারণ, কবিতা নিজেই যে এক অপার জমিন, এক জীবনে তার কতোটাই বা পাড়ি দেওয়া যায়? কিš' আজকের পৃথিবীতে আমাদের এই তেলাপোকা-জীবন, যা প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-প্রয়োজনের হাতে আর কেবলই পিছলে পিছলে যাচ্ছে, সে কেমন করে পথ হাঁটবে কবিতার মতো নির্জন বন্ধুর পথে? এই প্রশ্ন আমাকে বড়ো বিপন্ন করে তোলে। কোনো সদুত্তর পাই না।

তবু মনে হয়, যতোই বন্ধুর হোক কবি ও কবিতার বন্ধুত্ব, পথ তবু এক দুজনের। কেননা, অনন্তের উৎসারিত বেদনা কাউকেই পৃথক হতে দেয় না। যদি তা পৃথক হয় তবে আর মানুষটি কবি থাকেন না। আর এই বেদনার ভেতর থেকেই তো জেগে ওঠে তাদের লাবণ্য পৃথিবী। এই পুঁজিপৃথিবী হয়তো দেবে না কবিকে শান্তি, কিন্তু কবি জানে বৈরী পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব রক্ষার মন্ত্র।

কারণ, তার কবিতাও তো অনেকাংশে এই বৈরিতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার অস্ত্র হিসেবেই কাজ করে। জীবনকে পাঠ করার, অনুভব ও আস্বাদ করা আর যে পৃথিবী তার আরাধ্য তাকে অর্জন করার যে অন্তর্গত বোধ ও পিপাসা তাও অনেক ক্ষেত্রে কবিতাই তার ভেতরে জাগিয়ে দেয়। তাই কবিতার সঙ্গে তার পথ হাঁটা হয়তো পৃথিবীর পরমায়ু পর্যন্ত ফুরোবে না। কিংবা, পৃথিবী বিনাশের আগে যদি তার অন্য কোনো সৌরলোকে যাওয়ার সুযোগ হয়, নিশ্চয়ই সে কবিতাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। ===== ভোরের কাগজ / ২৩ মে ২০০৮


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।