। আমার আমি
একজন সন্ধ্যামালতী
সঙ্গীতা
একজন সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে লিখবো ভাবছি। নাম টা মনে আছে খুব স্পষ্ট, সন্ধ্যা মালতী রায়। মুখটা যে খুব মনে আসছে তা নয়। আহামরি রূপ মাধুরী ছিলো না এটুকু বেশ মনে আছে।
কাঁচা লঙ্কার ঝাল খুব ভালবাসতেন, মুড়ি চানাচুর আর অনেক কাঁচা লঙ্কা কুঁচিয়ে ঝাল ঝাল করে আমাদের খাওয়াতেন। আমাদের পড়াতেন ফিজিক্স। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রতি ছিলো তার গভীর মমতা। কথায় কথায় আবৃত্তি করতেন, রবি ঠাকুর, নজরুল, সুকান্ত। খুব করে বুঝাতেন রবি বাবু কি ভাবে জমিদারি তদারকি করতে এসে হৈমন্তী লিখেছেন, হেমন্তের পাকা ধানের ধানী রঙ যে হৈমন্তীর ছিলো, তা আমরা বেশ বুঝতে পারতাম।
সন্ধ্যামালতী ফুলের একটা আলাদা কাঁচা গন্ধ আছে, একদম ভিন্ন, ফুলের গন্ধটাই যেমন মিষ্টি তেমনি কাঁচা সতেজ। ভালো লাগার পাশাপাশি বুকটা খানিকটা টন টন করে। তা যা বলছিলাম, পদার্থ বিজ্ঞানের মতো একটা নিরস বিষয়েও আমরা রস খুঁজে পেয়েছিলাম উনার কারণে। গান শুনতেন প্রচুর, সব ধরেনের গান, পাঁচমিশালী বলা যায়। তখন ছুটি ছিলো শুক্রবার।
মোটামুটি সারা সপ্তাহ শেষে এই একটা দিনের জন্য অপেক্ষা। তো ঐ দিন দিদির বাসায় চলতো পদার্থ বিজ্ঞানের নানা পরীক্ষা। আমরা থাকতাম দর্শক। দিদি আমাদের দেখাতেন, বরফ কেনও পানিতে ভাসে, প্রিজমের মাঝে আলোর বিচ্ছুরণ ইত্যাদি। রঙ ধনুর আলোর খেলার রহস্য জেনে তো আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে কবিতাই লিখে ফেললাম।
সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। জীবনের প্রথম লিখা কবিতা, উত্তেজনায় খানিকটা কাঁপছি, কাকে দেখাবো? কি করবো? রাখবো না ছিঁড়ে ফেলবো এই আর কি। তো অনেক ভেবে চিনতে বন্ধু শাওনের সাথে পরামর্শ করলাম, শাওন স্কুলের মাসিক পত্রিকাতে কিছুটা লেখালেখি করে, তাই তাকেই গুরু মেনে উপদেশ চাইলাম। শাওন বললো, ‘তুই এক কাজ কর সন্ধ্যামালতী দিদিকে দেখা, উনি বুঝবেন তোর কবিতা কেমন হয়েছে’।
কিন্তু আমার নানা অস্বস্তি, মুখচোরা স্বভাব আমাকে বরাবরই পিছিয়ে রেখেছে।
দেখাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। সুন্দর করে সাদা কাগজে লিখে ফেললাম কবিতা পরিষ্কার হাতের লিখায়, যাতে দিদির পড়তে কষ্ট না হয়। এর মাঝে দুই তিন দিন চলে গিয়েছে কিন্তু আমি দেখাবার সাহস পাচ্ছি না। শাওনই একদিন ধরে নিয়ে গেলো, দিদির হাতে কাগজে লিখা কবিতা, শাওন দিদির সামনে দাঁড়ানো আর আমি দরজা দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করছি, দিদি মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন, চশমাটা একটু নেমে এসেছে, জুন মাসের দুপুর, দিদির মুখে হাল্কা ঘাম, ভালো লাগা আর ভয় মিশ্রিত ভাবে আমি উনাকে দেখছি, আমার কবিতার চাইতেও উনাকে সুন্দর লাগছে। পড়া শেষ, দিদি তাকিয়ে বললেন, ‘সঙ্গীতা তোমার বাসা যেনো কোথায়?’ আমিতো ভয়ে পারলে নিজের ভিতরেই ঢুকে যাই।
আস্তে করে বলি, ‘রানীর দিঘীর পাড়’। বললেন, ‘তোমার বাসায় যাবো,’ আমি শুধু ঘাড় কাঁত করি। বুঝতে পারি বিশাল একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার সাহিত্য কর্ম আমাকে ভোগাবে। ভীষণ একটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরছি।
কি হবে? শাস্তির পরিমান কতো খানি হবে?
একজন সন্ধ্যামালতী, শেষ করবো করবো ভাবছি, কিন্তু কেনও যেনও কোথায় একটা তার বেসুরে বাজছে। এমন কেনও হচ্ছে তা জানি না। ভুল বানানের ভুল হচ্ছে বার বার। কী এমন কষ্ট আছে যা আমার কথা মালাকে ব্যথিত করছে, ব্যহত করছে, খানিকটা আহতও করছে। দিদির লিখা কবিতা আমার এখনো মনে আছে।
উনার দেয়া উপহারের গায়ে খুব সুন্দর কোনও লাইন লিখা থাকতো।
দিদি বাসায় গিয়েছিলেন আর কি হয়েছিলো সে গল্প আরেকদিন বলবো ক্ষণ। তবে আমাদের একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, তা ঠিক। দিদি আমার জন্মদিন পহেলা ভাদ্রে আমাকে দিলেন সুকান্ত সমগ্র, ভিতরে ছোটো করে লিখা ‘তুনি, বলতে পারিস কি করে ফেরাতে হয় আপন বুকের সুখ’।
দিদি আমাকে তাঁর বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিলেন আমার অজান্তেই।
আজ খুব জানতে ইচ্ছে করে কি অসুখ ছিল তাঁর বুকে, যা কাওকে তাঁর বলা হয়নি। আমি এখনো সেই অপরাধ বোধ মাথায় নিয়ে ঘুরছি। আমার লিখতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছে। তবুও লিখতে যে আমকে হবেই।
দিদির যতোই কাছে যাচ্ছি ততই একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছি।
হাসি খুশী উদ্যমী অসম্ভব প্রান চঞ্চল একটা মানুষ। তাঁর সুখ যেমন সুন্দর, দুঃখ বোধও অনন্য। এক সন্ধ্যায় উনার বাসার ছাঁদে বসে আছি, আমি, শুভ্র, শান্ত, শাওন, বিনি। দিদি ঝাল করে চানাচুর মুড়ি আর চা আনালেন, তারপর হঠাৎ বললেন তোমাদের আজ গান শুনাব। উনি যে গান গাইতে পারেন তা আমাদের জানা ছিলোনা।
আমরা একটু নড়েচড়ে বসলাম। দিদি একটু উঠে গেলেন, দাঁড়ালেন ছাঁদের বেশ কিনারায় যেয়ে, খানিকক্ষণ চুপ, চারদিক শুনশান, সন্ধ্যা বেলার মফস্বলের নীরবতা। দিদি গাওয়া শুরু করলেন, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে’, আমরা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি, কি অপরূপ লাগছে যে তাঁকে, শহরের হাল্কা আলো আর অষ্টাদশী চাঁদের জ্যোৎস্নায় সব কিছু মিলে একাকার। দিদি গান করছেন আর অঝোর ধারায় তাঁর দুচোখ বেয়ে জল ঝরছে।
গান শেষ দিদি কাছে আসলেন, মৃদু স্বরে বললেন, সঙ্গী তুই আজ আমার সাথে থাকবি? তুমি থেকে কেনও জানি উনি তুইয়ে চলে গেলেন।
আমি স্বভাব সুলভ ভাবে মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাঁত করলাম। দিদি দেখতে পেলেন কিনা জানি না। শুধু বললেন, ‘আমি তো রাতে নিরামিষ খাই তোর জন্যে মাছ করতে বলবো’? এবার আমি কথা বললাম, ‘না নিরামিষই চলবে’।
পরিবেশটা যেনও কেমন হয়ে আছে। সবাই বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়লো, আমি রাতে ফিরবো না তা শাওনকে বাসায় জানিয়ে দিতে বললাম।
সবাই চলে গেলো দিদি বসে আছেন, নীরব। রাত বাড়তে থাকলো। কেশব বাবু, দিদিদের পুরনো গৃহ সহযোগী দুবার এসে ঘুরে গিয়েছেন, দিদি কিছুই বলছেন না। ধীরে ধীরে চাঁদ নুয়ে আসছে, হাল্কা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। দিদিদের মাধবী লতার ঝাড় থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ দমকা বাতাসে কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসছে।
দিদি হঠাৎ বললেন, ‘চল আজ রাতটা ছাঁদে কাঁটাই। কাল তো রোববার একটু দেরী করে উঠলেও অসুবিধা হবে না’।
দিদিকে আমার খুব অচেনা লাগতে লাগলো।
আমাদের মধ্যবিত্তের একটা হ্যাপা আছে, ভালো থাকার হ্যাপা। আমরা ভালো থাকার নেশায় অনেক ভালো কাজ থেকে নিজেদের দূরে রাখি।
কতো ভুল যে হয় যায় এক জীবনে। কতো না পাওয়ার কষ্ট বুকে চেপে চলে যেতে হয়, কতো না দিতে পারার কষ্টে সারারাত বালিশ ভিজে চোখের জলে। এমন আরও কতো কি?
মধ্যবিত্তের এই কষ্ট বোধটুকু খুব ছোট বয়সেই আমাকে স্পর্শ করেছিলো। আমি খুব বুঝতে পেরেছিলাম তখনই যে সমাজ, পরিবার, ধর্ম কিভাবে মানুষের মনকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আবেগ, কিংবা আবেগিক সব কিছু প্রকাশেই কতো বাঁধা বিপত্তি।
সামাজিক ছক গুলো কচ কচ করে উঠে চোখের মাঝে। সেই বয়সেই নিজেকে খুব অসহায় বোধ হতো।
একদিন দিদি আর আমি বসে মুভি দেখছি ভি সি আরে, দ্বীপ জ্বেলে যাই। দিদিকে একটু চুপচাপ মনে হচ্ছে, কী যেনো ভাবছেন, পুরো মনোযোগ নেই। আমি উঠে যেয়ে পানি খেয়ে আসলাম দুবার, কিছুই বলেন না।
অন্য সময় হলে খানিক বকা খেতাম অস্থিরতা করার জন্যে। কিন্তু দিদি আজ শুধু একবার তাকালেন আবার সিনামা দেখতে লাগলেন, বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। দিদি হঠাৎ করে বললেন, ‘সঙ্গী, সুজয়কে চেনো’? আমি আস্তে করে বললাম, ‘নিলীমা দির ভাই’? দিদি মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, চিনি, খুব ভালো একটা মানুষ’। দিদি সাথে সাথে উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘কি করে জানলে যে ভালো’? আমি বললাম, ‘এমনি, উনার লেখা অনেক চমৎকার, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শানিত উনার কলম’, দিদি শুধু একটু হাসলেন, কিছুই বললেন না।
এর কদিন বাদেই দেখলাম সুজয় দা আর দিদি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, সুজয় দা কথা বলছেন, দিদি চুপ করে শুনছেন, একটু করে মাথা নাড়ছেন। আমাকে দেখেই দিদি ডাক দিলেন, আমাকে দেখিয়ে সুজয় দা কে বললেন,
‘একে চিনো’?
দাদা বললেন, ‘নাতো’,
দিদি একটু হেসে বললেন, ‘তোমার ফ্যান’।
দাদা হো হো করে হাসতে লাগলেন, আমি দিদিকে দেখছি, একটা অদ্ভুত ভালো লাগা দিদির মুখে তখন জ্বলজ্বল করছে। আমার কেমন জানি মনে হলো। এতো কাছ থেকে ভালোবাসাকে আমি কখনো দেখিনি।
এতো সুন্দর? আমি স্তব্ধ বিস্মিত হয়ে গেলাম, মনে হলো, তাজা কিছু শিউলি ফুল আমার কোঁচড়ে কেউ ঢেলে দিয়েছে, আহ! মিষ্টি একটা গন্ধ।
সুজয়দার বোন নিলীমা দি ছিলেন আমাদের ম্যাথ টিচার, সুজয় দা ঢাকায় থাকেন মাঝে মধ্যে দিদির বাড়িতে বেড়াতে আসেন, সেই সুত্রেই ছোট শহরের নিয়ম মাফিক সখ্যতা হয়ে যায় সবার সাথে। দাদাও তেমনি সবার সাথে মিলে গেলেন, শহরের ইয়ং জেনেরেশন দাদাকে রীতিমতো গুরু মানা শুরু করলো। দাদার পরিচয়টা অনেক গভীর হয়েছিলো আমার ছোটো কাকার সাথে, ও তখন একটা জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি। দুর্দান্ত কবিতা লিখে।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দাদার একান্ত সহযাত্রী। দিদির বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, খুব সাহসী আর উদ্যমী মানুষ। দিদিদের বাসায় তাই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের একটা অস্থায়ী ক্যাম্প হয়ে গিয়েছিলো। সারা দিন চলতো মুক্তবুদ্ধির চর্চা। আর কিভাবে স্বৈরাচার মুক্ত দেশ পাওয়া যায়, তা নিয়ে বিতর্ক।
দাদা আর ছোট’কা প্রায়শই বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন, সরকারকে রাজনৈতিক দল গুলো বেশি ছাড় দিচ্ছে। নির্বাচন হবে কিনা? হলে দল গুলোর যাওয়া উচিৎ কি অনুচিত, আরও কতো কিছু। দাদা ছিলেন চে গুয়েভারার একনিষ্ঠ ভক্ত, তাই বিপ্লব নিয়ে কথা শুরু করলেই চোখ মুখ কেমন যেনও চক চক করে উঠতো। দিদি চুপচাপ বসতেন, মাঝে সাঝে দুয়েকটা কথা বলতেন এই যা। তবে যতোক্ষণ দিদি থাকতেন, দাদার উচ্ছলতা আমার অদ্ভুত লাগতো।
দাদা মনে হোতো স্বয়ং দেবীর সামনে বসে আছেন। আমি কিছু ব্যাপার আঁচ করতে পেরেও দেখতে চাইছিলাম না। কারণ দাদা ছিলেন বিবাহিত। এক সন্তানের জনক। পরকীয়া শব্দটির প্রতি একটা ভয় সেই ছোটো বেলাতেই হয়ে গিয়েছিলও।
(পুনশ্চঃ সন্ধ্যামালতী দিদির গল্পটা শেষ করে দেই। আর লিখতে ভালো লাগছে না, সংক্ষেপে বলি, সন্ধ্যামালতি দিদির বিয়ে হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, যে কারনেই হোক সেটা টিকেনি, দিদিও আর ও মুখো হননি। কিন্তু দিদির জীবনে ঝড়ের মতোই সুজয়দার ভালোবাসা আসে। বয়সে ছোটো তার উপর বিবাহিত সুজয়দাকে দিদি অনেক চেষ্টা করেও দূরে রাখতে পারেন নাই। দিদির সেই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ভরা দিন গুলোর বিস্তারিত বর্ণনা আর দিতে মন চাইছে না বলেই গল্পটা শেষ করে দিলাম।
শুধু বলি দিদি মনি আমার, তুমি এমন একটা মানুষকে মন দিয়েছিলে যে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারে বলে দাবী করতো ঠিকই, কিন্তু তোমাকে তোমার মর্যাদা টুকু দেয়ার সাহস রাখতো না। ভালোবাসা এমন কিনা আমি জানি না। আমি এখনো ভালবাসাতেই বিশ্বাস করি, কিন্তু দিদির কথা মনে হলেই কেমন যেনো একটা ঘৃণার দেয়াল দেখতে পাই। কেনও এমন হলো??? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। সুজয় দা আমি তোমাকে কেনও জানি ঘৃণাও করতে পারিনা পুরোপুরি।
তবে ভালোবাসার কথা বলার আগে তার মর্যাদাটুকু দিতে পারবে কিনা তা ভেবেই সবার বলা উচিৎ। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।