যারা উত্তম কে উচ্চকন্ঠে উত্তম বলতে পারে না তারা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে শুকরকেও শুকর বলতে পারে না। এবং প্রায়শই আর একটি শুকরে রুপান্তরিত হয়।
ঘন্টা দেড়েক আগে শুরু হওয়া ঝড়মুখো বৃষ্টি, ঘরমুখো মানুষগুলোকে যেভাবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খোঁয়াড়ে ঢোকানোর জন্য ছোট্ট একটা মেলোড্রামা করেছিল, দর্শকেরা তাতেই কুপোকাত। উত্তাল বৃষ্টির সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর আবহ সংগীত মহানগরের চিরচেনা এবং মাঝেমাঝে কেবলই নির্বোধ গ্রহীতা; বাসিন্দাদের ভেতরে লুকানো শংকারাশির ম্যাজিক বাক্সটা আবারো নেংটো করে খুলে দিল। এইতো কিছুদিন আগেকার টায়ার ফাটার শব্দেই জেএমবির বোম, অথবা তারো আগে মেয়ে সমেত জটলা মানেই বাঁধন, অথবা ভীরের জায়গা গুলোতে এইচআইভি রোগীর সূচ, অথবা এখন দোকানগুলোর তড়িঘড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া, জোঁটবেধে আড্ডা মারার সময় সামরিকের নজরদারী ইত্যকার নানা গল্প।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর হস্তে লিখিত শংকার স্ক্রীপ্ট, আর বিশ্বস্ত দর্শকের মত এই উত্তর আধুনিক নাটকে অংশগ্রহণ ও আরো নির্বোধের মত মনে করতে থাকা দর্শকের অবস্থান হলে কি হবে নাটক তো চলে আমাদের দেখাদেখিতেই। যেন খুব মিহি একটা সর্ম্পক, ইচ্ছে মত বাতিল বা গ্রহণযোগ্য, নিজকে খুব ক্ষমতাশালী ভাবা অন্তত একালের ক্ষমতাবানদের কাছাকাছি কেউ।
যদিও আরো ভেতরের শিলালিপিতে ক্ষুদিত হয়ে চলছে, চালের দাম, বিদ্যুত, পানি, গ্যাস ইত্যাদির নেই হয়ে যাওয়ার ভয়, মাসে দুই তিন বার মদ না খেতে পারার ভয়, ভুল করে ভুমিষ্ট হওয়া শিশুটির খাবার কিনতে না পারার ভয়, একদা প্রেমিকাকে বাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যেয়েও চুম্বনের নৈতিকতার ভয় এবং স্বামীটির সেলফোনে খোঁজখবর; আসলে নজরদারি, বউকে পালিয়ে নারী, নারীকে পালিয়ে বউ, এফেয়ার এড়িয়ে প্রেম, প্রেম এড়িয়ে কাম, কাম এড়িয়ে বন্ধুত্ব, বিশ্বস্ততা এড়িয়ে ওয়েব পর্ণ। হাহ! বৃষ্টি; উপলক্ষ্য মাত্র। পাবলিক বাসের ঠেলাঠেলির আগে একটু চোখে চোখ, ভেজা শরীরের একটু বে আব্রু আহবান, কানে ঢোকানো হেডফোনে লিংকিন পার্ক; আসলে একটু বৃষ্টি-রতির গান।
এতো গেল ৮০০০ থেকে ৩২০০০রের গল্প।
মঞ্চের প্রায় আলো না পড়া জায়গায়টা, সেখানে আদিকাল থেকেই সবচেয়ে ভীর, উপরের দল এখনো দিয়ে রেখেছে একই চরিত্র, যেন এখানে এসেই সময় স্থির। এদের আমরা আলাদা করে চিনিনা, এরা গোষ্ঠী এরা কেউই ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন নি। যেন এক ঝাঁক, মানুষ নয় পঙ্গপাল। এদের ব্যক্তি করে চেনা কষ্টকর।
এনজিও ফান্ড ছাড়া এদের আলাদা করে চেনা, নাটকের চরিত্র ছাড়া আলাদা করে চেনা, শোকশোক উপকার উপকার ছাড়া আলাদা করে চেনার কোন দরকার নেই। এরা কথা বলে আমাদের টিভিতে, বিবৃতি দেয় আমাদের পত্রিকায়, এরা লঞ্চ ডুবে মারা যায় আমাদের উৎসব পার্বণে, এরা ঝুলে থাকে আমাদের প্রদর্শণীতে, এরা ১লা বৈশাখে নোংরা ভাবে প্লেট পরিষ্কার করে, এরা টার্গেট, এরা ক্ষুদ্রঋণ, এদেরই কেউ কেউ আবার কমদামী মোবাইলে কমদামী প্রেমিক প্রেমিকা সেজে সোহরোয়ার্দীকে অশ্লীল করে তোলে। এরা চুরি করে, রাহাজানি করে, এরা ভীর বাসে বুকে হাত দেয়, এরা কাটপিস দেখে আর বসুন্ধরার সুন্দর হাগুখানা নোংরা করে। এরা কিনতে পারেনা বেশি কিছু, কিন্তু এরা বেড়াতে আসে। ছি: শুক্রবারে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকেনা।
এই এরাদের দল আর শেষ হয়না, এরা বাড়ীতে বাসন মাজে, টাকা দিলে ঘরের শোভন জামাই আর উঠতি যুবকদের নষ্ট করে, গার্মেন্টস ম্যানেজারের সাথে কথা না বলে শুয়ে পড়ে, এরা নোংরা থাকে, এদের গা থেকে অদ্ভুত গন্ধ বের হয়, এরা এক্সট্রা হয়, এরা মাটি কাটে, ইট ভাঁটায় মারা পড়ে, এরা বোঝা টানে, এরা ভিক্ষা করে, এরাই সন্ত্রাসী, এরা গাবতলীতে থাকে, এরা বস্তি টস্তিতে থাকে, এরা কমিউনিটি সেন্টারে হাড় কুড়ায়, এদের ভাতের দরকার হয়না এরা শুধু বংশবৃদ্ধি করে আর দেশটাকে নষ্ট করে। এদের মধ্যে একটু যারা ভাল তারা গার্মেন্টস এনজিও আর ক্ষুদ্রঋণ করে। এরা ভোটের জন্য ঠিকমত ছবিও তোলেনা। এরা নিজ শিশু বিক্রি করে, এরা কমদামী বেশ্যা হয়, এরা রিকশা চালায়; আবার কি ঢং দেখ নিজেদের গানের অনুষ্ঠানও করে। এরা অশ্লীল, এরা সারা রাত জেগে যাত্রায় কাচুঁলি খোলা আর ছায়া তোলার জন্য অপেক্ষা করে।
এরা ধনী গৃহকত্রীকে খুন করে বিদেশে যাওয়ার টাকা যোগার করে, এরা কি বেকুব এরা প্লেনের টায়ার ধরে সাইপ্রাস যেতে চায়। এরা কি বোকা কন্টেইনারে পঁচে পঁচে মরে। এরা মঙ্গা, সিডর প্রুফ বৃষ্টিতে এদের কিছু হয়না। এরা বৃষ্টিতে ভারা বাড়ায় কিন্তু এদের সর্দি কাশি হয়না।
আর তারা; যুদ্ধ, বৃষ্টি, মঙ্গা, নির্বাচন, সামরিক, গ্লোবালাইজেশন, ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭১, ৭৫, ৮৬, ৯২, ৯৬, ২০০১, রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধ, সেকুল্যার, জঙ্গীবাদ ইত্যাদিতে তাদের কিছুই হয়না।
এদের নিম্ন পদস্থরা রাজনীতি করে আর মাঝে মাঝে জেলে যায়। এদের নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। ঈশ্বর নিয়ে আসলে বেশি কিছু বলার থাকেনা, তিনিই বৃষ্টি দেন। আর বৃষ্টিভেজা আমরা কেবল ঈশ্বর হতে চাই।
বাড়ী ফেরার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, আবার দাঁড়িয়ে নেইও।
আমার শংকা স্তর পারিপার্শ্বিকের তুলনায় এত বিষ্ময়করভাবে হ্রস যে বৃষ্টির আনন্দের কিছুটা অংশ এখনো উপভোগ্য। হঠাৎ করেই পিঠে হাত; বুঝলাম পরিচিত স্পর্শ। কিন্তু পূর্বে যেমনটা হোত তেমন উচ্ছাস আমার মধ্যে তৈরী হলনা। অপরপক্ষ একটা নিশ্চিত অপরাধবোধ থেকে কথা বলছেন, এবং তার অপরাধের কথা আমি জানি কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইছেন। অপরাধ আমার কাছে গুরুতর।
আমার নিকট বন্ধুর তহবীল তছরূপ। এই ব্যক্তিকেই, যাকে আমি বন্ধুর মতই মনে করতাম, তিনি আমার বন্ধুর অন্য ব্যস্ততা ও অমনোযোগের সুযোগে ব্যবসায়িক অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আমার সেই বন্ধু; তার কারণেই তসরুফকারীর প্রাক্তণ এমপ্লয়ারের সাথে ঝগড়া করেছিলেন এবং একটি সন্তানের জনক তসরূফকারীকে বের করে দেবার জন্য সর্ম্পক ছেদ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নিজের আর্থিক সংকটের কালেও তসরূফকারীকে কাজ দিয়েছিলেন।
একই বাসে ফিরছি, জলো বদান্যতায় তসরূফকারী নিজেই টিকেট কেটেছেন।
আমার তখন তাকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। টিকিটের দাম দিতে চেয়ে স্বস্তি না জুগিয়ে আমি বরং তাকে উদ্বেগের শাস্তিটা দিতে চাইলাম। আমি নিখুঁত অভিনয়ে তার সাথে কথা বললাম এবং প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে গেলাম। তিনি নানাভাবে আমি কিছু জানি কিনা জানতে চাইছিলেন। আমি বুঝতে দিলাম না।
ভেতরের ছন্দটা অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। ডানদিকে দেখছিলাম শেরাটনের সবুজ প্লাষ্টিকের দ্যুতি, কৃত্রিম না হলে বোধহয় এমন সবুজ আর পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়না। যদিও একদা বন্ধু এবং কার্যত বিশ্বাস ঘাতক সর্ম্পকে সেই সবুজের কথাই আমি মনে করেছিলাম। সমস্ত যাত্রায় স্নিগ্ধ বৃষ্টি আমার কাছে থকথকে গুয়ের মত ভারী হয়ে উঠল।
স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, তসরূফকারী জাগতিক মঞ্চের সবচেয়ে উপেক্ষিত জায়গা থেকে সেন্টার স্টেজে উঠে আসতেই চেয়েছেন ।
কেননা জন্ম যে তার নিম্ন মাঝারীর দলে, এরপর কষ্টে সৃষ্টে-মহানগরে আশ্রয়, এরপর বন্ধুদের সহযোগীতা, আবার শুরু করা আবার হারানো, এরপর শুধু উপরে উঠতে চাওয়া, কেননা সেই সবচেয়ে ভাল বোঝে দলিতের সারির গল্প। এটা খুব নতুন কিছু নয় যেমনটা আমরা অনেকেই করি প্রতিনিয়ত। এজন্যই বন্ধুর পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতে তার একটুও হাত কাঁপেনি। জানি ব্যাক স্টেজ থেকে সেন্টার স্টেজে চলে আসার এটাই সবচেয়ে সহজ পথ আজকাল। যদিও এটাই একমাত্র রাস্তা নয়, যদিও এটাই কোনক্রমে সর্বোত্তম রাস্তা নয়।
এই মঞ্চের নির্মাতারা এমনটাই স্ক্রীপ্টে লিখে দিয়েছেন, এমনটা মনে করাও আবশ্যক নয়। যদিও মঞ্চ থেকে বাদ পড়ার নানাবিধ ভয়ের গল্প এভাবেই কাজ করে আসছে। তাই শেষ পর্যন্ত কষ্টক্রোধে তার টুটি ছিঁড়ে ফেলতে আমার আর ইচ্ছে হল না। মনে হল আরেকজন ভীতু তসরূফকারীর ক্ষুদ্র ঈশ্বর হবার বাসনাই জেগেছে কেবল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।