দৈনিক ইত্তেফাক/সাহিত্য সাময়িকী/ ৭ মার্চ২০০৮ শুক্রবার
শিবনারায়ণ রায়ের মৃত্যুতে
সৈয়দ তোশারফ আলী
============================
শিবনারায়ণ রায় আর নেই। ২৬ ফেব্রুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়েছে শান্তিনিকেতনের নিজ বাড়ি রুদ্রপলাশ-এ। এই মৃত্যু সংবাদ ছিল তার সংজ্ঞায়িত স্বজনদের জন্য এক মস্ত দুঃসংবাদ। তিনি স্বজন বলতে রক্ত-সম্পর্কিত, বিবাহ-সম্পর্কিত অথবা অন্যান্য অনির্বাচিত আত্মীয়-কুটুম্বকে বুঝতেন না। যাদের সঙ্গে তার মনের, চিন্তার, কল্পনার মিল হতো তাদেরকে তিনি স্বজন ভাবতেন।
এই স্বজন বা প্রিয়জন তিনি খুঁজেছেন স্বদেশে-বিদেশে, স্বকালে ও অতীতে, সাহিত্যে ও রাজনীতিতে, ইতিহাসে ও দর্শনে। সমকালে স্বজন খুঁজতে তিনি বয়সের ব্যবধান কিংবা ভূগোলের দূরত্বকে বাঁধা হিসেবে গণ্য করেননি। স্থান-কালের গণ্ডি পেরিয়ে যে অর্থে শেলী, কীটস, ইউক্লিড, সক্রেটিস, গ্যালেলিও আমাদের স্বজন সেই অর্থে তিনি স্বজন শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন।
তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার এক অনন্য প্রত্যয়ী প্রাবন্ধিক। যদিও ইংরেজি ও বাংলা দু’টি ভাষাতেই সমান দক্ষতায় তিনি লিখেছেন।
উঁচু মানের ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র ‘জিজ্ঞাসা’র তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ও সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এ পর্যন্ত প্রকাশিত তার গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ।
বাংলা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রেক্ষিত, সাহিত্য চিন্তা, প্রবাসের জার্নাল, নায়কের মৃত্যু, মৌমাছিতন্ত্র, কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা, প্রত্যয়, অণে¦ষা ও অনুচিন্তন, স্রোতের বিরুদ্ধে, খাড়াইয়ের দিকে, রেনেসাঁস, স্বদেশ স্বকাল স্বজন, যে আলোকে অনেক আঁধার, বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি ও অবক্ষয় প্রবন্ধ সংগ্রহ (১ম ও ২য় খণ্ড)। ইংরেজিতে মানবেন্দ্র নাথ রায়ের নির্বাচিত রচনাবলীর সম্পাদনা (৪ খণ্ডে) তার অনন্য কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হবার দাবি রাখে।
শিব নারায়ণ রায়ের আদি নিবাস ছিল বৃহত্তর বরিশাল জেলার রায়েরকাঠি গ্রামে।
১৯২১ সালে জন্মগ্রহণকারী শিব নারায়ণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন পর্ব কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করে ২৪ বছর বয়সে কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার সিটি কলেজে লেকচারার (১৯৪৫) হিসেবে। সেই শুরু, তারপর থেকে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জ্ঞান বিতরণে ও বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর সংস্থা ও সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারততত্ত্ব বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত। তবে প্রবাসের নিরাপদ জীবন থেকে তাকে তার স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন প্রয়াত সাহিত্যিক ও ভাবুক আবু সয়ীদ আইয়ুব। একথা তিনি তার লেখায় অকপটে স্বীকারও করেছেন।
তিনি একাধিকবার স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা তিনি বিভিন্ন লেখায় ও সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সাপ্তাহিক রোববার-এ তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি তার লেখালেখির কার্যকারণ সন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি যে জগতে জন্মেছি, যে সমাজে বাস করি, যে ভাষা ব্যবহার করি, যে সাহিত্য পাঠ করি তার মধ্যে বিস্তর নিকৃষ্ট উপাদান এবং গভীর ত্রুটি আমাকে ক্রমাগত পীড়া দেয়। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি অপসারণ আমার করণীয় বলে মনে হয়।
আমার প্রবন্ধে সেই চেষ্টা আকার পায়। অন্যদিকে আমার প্রবন্ধ ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনেই নিয়োজিত। ’
শিবনারায়ণ রায়ের বাবা বিদ্যাভূষণ শাস্ত্রী ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত। তারও পেশা ছিল শিক্ষকতা। অধ্যয়ন এবং লেখালেখি ছিল তাদের পরিবারে ডালভাতের মতো।
তার দেয়া তথ্য মতে, প্রথম যৌবনে রাসেল, মার্কস এবং ফ্রয়েডের রচনা তার চিন্তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল; সেইসঙ্গে স্বদেশের দারিদ্র, শিক্ষাহীন, আত্মপ্রত্যয়হীন, দৈবনির্ভর, যুক্তিবিমুখ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের জীবনযাত্রা তাকে মর্মাহত করেছিল। তিনি এটাও বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে লক্ষ্য করেন যে, যারা শিক্ষিত, যারা নানা রকমের সুযোগ-সুবিধার অধিকারী, যাদের কর্তব্য ছিল বিদ্যমান ব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচন ও সামাজিক রূপান্তর সাধনের আকাঙক্ষা জাগিয়ে তোলা, সেই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী ব্যস্ত তাদের আখের গোছানোর কাজে।
বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রটির মতো রাজনীতির দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়েও তিনি সমান নিরাশ হন। শুধু নিরাশ বললে ভুল হবে, প্রবলভাবে রাজনীতিমনষ্ক এই ভাবুক তার দেশের দলীয় রাজনীতির প্রতি ছিলেন বীতশ্রদ্ধ। তিনি লিখেছেন, ‘কোন রাজনৈতিক দলের সততায় আমার আস্থা নেই-তাদের একমাত্র সাধনা ক্ষমতা অর্জন, ক্ষমতা লাভের আগে কিংবা পরে কোনো সময়েই তারা ন্যায়-নীতির নির্দেশ গ্রহণ করে না।
সুতরাং কোন দলে যোগ না দিয়ে আমি নিজের যুক্তিনির্ভর এবং বিবেকচালিত ভাবনা-চিন্তা নিজের মতো করেই লিখেছি। ’
নিজের মানস গঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে, এক সময় তিনি কার্ল মার্কসের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, পরে তার চিন্তার উপর প্রভাব ফেলেছিল মানবেন্দ্র নাথ রায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা স্বকীয়তা অর্জনের দিকে এগিয়ে যায়। ‘ই ূণষ ৗণভটধ্র্রটভডণ’ বইয়ে যার আভাস আমরা দেখতে পাই।
সততা কথাটি বলা সহজ হলেও এই চারিত্রিক গুণটি নিজের জীবনে অর্জন করা খুবই কঠিন।
কথার সঙ্গে কাজের সংগতি রক্ষার নামই সততা- সততাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে তিনি লিখেছেন, ‘এ দেশে যারা স্বাধীনতার প্রবক্তা তারাই আবার সমালোচনা এবং দলের মধ্যে অথবা বাইরে চিন্তার স্বাধীনতা দমনে উদ্যোগী। মুখে অথবা লেখায় মৈত্রীর আদর্শ ঘোষণা করলেও আপন আপন গোষ্ঠী, দল, সম্প্রদায় বা জাতির বাইরে যথার্থ বন্ধুত্ব, সহযোগ বা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এমন ব্যক্তি কিংবা পরিবার বর্তমানে খুব বেশি দেখতে পাই না। ’
তার মননশীল প্রবন্ধের সংখ্যা প্রচুর; কিন্তু জনপ্রিয় লেখক বলতে যা বোঝায় তিনি তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন মূলত লেখকদের লেখক, ভাবুকদের ভাবুক। জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে এ তথ্যটির উল্লেখও নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ‘কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা’ বইয়ে তিনি মহাকবি গোয়েটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গভীর ত্রুটি উল্লেখ করেন।
এ কারণে তিনি রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্তদের বিরাগভাজনও হন। কিন্তু আশার কথা যে, তিনি জনমতে গা ভাসিয়ে কোনকিছু লেখেননি। বরং ঘোলাটে ভাবনা-চিন্তা, তামসিক আচার-আচরণ এবং নিকৃষ্ট সাহিত্য রুচির বিরুদ্ধে নিজের যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে তিনি আমৃত্যু কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। তার লেখালেখি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল বহমান স্রোতের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদী এই
লেখকের বিভিন্ন নিবন্ধে ভাষা পেয়েছে সুস্থভাবে, স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশের অধিকার।
তবে বিভিন্ন ব্যাপারে তার অবস্থান ও মতামতের সঙ্গে সবাই একমত হবেন এমনটি কেউ প্রত্যাশা করেন না। কিন্তু তার প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা এবং অনুসন্ধিৎসাকে শ্রদ্ধা জানবার ব্যাপারে কারো মধ্যে দ্বিধা থাকার কথা নয়।
তার মত বিদগ্ধ ও নির্ভীক কলম সৈনিকের পক্ষেই বলা সম্ভব, ‘কবিতা এবং কথা সাহিত্যে বাংলা ভাষা প্রভূত উৎকর্ষ অর্জন করলেও মননশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা এখনও দুর্বল ও দরিদ্র। ’ এই দুর্বলতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে তার প্রয়াস ছিল বিরামহীন। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘গত ত্রিশ বছরে বাংলা সাহিত্যে না ঘটেছে চিন্তার ক্ষেত্রে মৌলিকতার উদ্ভব, না কল্পনার বিস্তার, না অনুভূতির সূক্ষèতা সাধন, না ভাষার সমৃদ্ধায়ন।
বাংলা সাহিত্যের ভাষা ক্রমে পর্যবসিত হচ্ছে বিজ্ঞাপনের, খবরের কাগজের, স্বল্পশিক্ষিত এবং অনুশীলনবিমূখ পাঠক-পাঠিকার চাহিদা মেটানোর ভাষায়। ’ এই অবক্ষয় তাকে পীড়িত করেছে আমৃত্যু।
শিব নারায়ণ রায় অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে গেছেন এই আশা নিয়ে যে, বাংলা যাদের মাতৃভাষা তারা এ অবক্ষয়কে অনিবার্য বলে মেনে না নিয়ে যথাযথ প্রতিকারে এগিয়ে আসবেন। শূন্যগর্ভ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মনন বিমূখ সাহিত্যচর্চা পরিস্থিতিকে হতাশাব্যঞ্জক করে না তুললে অনেক আগেই প্রতিরোধ গড়ে উঠতো।
এসব কথা তিনি উচ্চারণ করেছেন তার দেশের বাস্তবতাকে সামনে রেখে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে তার দূরদর্শি পর্যবেক্ষণকে আমরাও নির্দ্বিধায় সতর্ক সংকেত হিসেবে গ্রহণ করে প্রত্যাশার নতুন দিগন্ত তৈরি করতে পারি। কারণ, বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনের দায়িত্ব ঐতিহাসিক কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের উপরই বর্তেছে।
=======*******===============
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।