জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
উদয়নে আমাদের ড্রয়িং আপার একটা মার্কা মারা লাইন ছিল--'অ্যাই তোমাদের কে কে কথা বলছো, এখানে এসে কান ধরে দাঁড়াও!
আপা ক্লাসে এসেই প্রথমে বোর্ডে লিখে দিতেন, 'গ্রামের দৃশ্য' কিংবা 'বর্ষাকাল'। ওগুলো নিয়েই আকঁতে হতো নিজের মত করে। বোর্ডে কখনও তিনি কিছু এঁকেছেন কিংবা কি করে আঁকতে হবে বলে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। পুরাটা সময় ক্লাসজুড়ে সবাই কথা বলতো, নিজের মত কিছু আঁকার শখ হলে আঁকতো।
কেউ আপার সামনে গিয়ে কান ধরে দাঁড়াতো না। অনেকেই শিল্পকলা একাডেমীতে আঁকতে শিখতো। আঁকার শখ কার না থাকে? কিন্তু সহজাত শিল্পীটা কারো পরিচর্যা পাচ্ছিল, কারো পাচ্ছিল না। পরিচর্যা পাচ্ছিল না, আঁকতেও পারছি না, সব দেখে আকা ব্যাপারটাকেই খুব কঠিন মনে হওয়া শুরু হলো। আঁকি বুঁকির শখটা কি করে যেন আস্তে আস্তে মরে গেল।
আমার এক খালাতো ভাই পড়তো চারুকলায়, ও বাসায় এসে আঁকতে বসলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। এক পেন্সিলের খোঁচায় কখনও গাছ, কখনও বাড়ি এঁকে ফেলে। কেবল হিংসায় হতো। এক সময় সিদ্ধান্ত নিলাম, উহু, আঁকা আঁকি সবাইকে দিয়ে হয় না! ব্যাস আমার আঁকি বুঁকি সেখানেই শেষ। প্রাইমারী স্কুলের পরে জ্যামিতি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে পেন্সিল ধরেছি বলে মনে পড়ে না!
ছুটি চলছিল।
বই পড়ছিলাম, সেলাই করছিলাম, রান্না করছিলাম, ঘুরাঘুরি করছিলাম, ব্লগাচ্ছিলাম, কিন্তু কাহাতক আর এসব করা যায়? ছুটির আগে ভাবতাম, আহা, একটা বার ছুটিটা আসুকই না! কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন ছুটিতেও যে মহা বিরক্তি ধরে যায়! কাজের চাপ যেন মিস করা শুরু করলাম...
ইউনিভার্সিটিতে আমাদের কিছু কোর্স করতে হয়, 'জেনারেল এজুকেশন' হিসেবে। নিজের ফ্যাকাল্টি ছাড়া যে কোন ফ্যাকাল্টি থেকে সাবজেক্ট নেয়া যাবে। ভাবলাম, জেনারেল এজুকেশনের কোর্সগুলো সামারেই করে ফেলি। আমার ভীষণ রকমের শখ ছিল ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টির 'ফটোগ্রাফি' করা। ওম্মা, আমি ভর্তি হওয়ার আগেই দেখি দুমাদুম সব জায়গা ভর্তি! এত্ত দু:খ হলো!
আরেকটু খুঁজতেই পেলাম 'স্টাডিজ অফ পেইন্টিং'।
আমার আর্ট গ্যালারি খুব ভালো লাগে, খুব বুঝতে ইচ্ছা করে ছবিগুলোকে। ভেবেছিলাম, স্টাডিজ অফ পেইন্টিং করে পেইন্টিঙের রীতিমত বোদ্ধা হয়ে যাবো। প্রথম দিনেই বিশাল টাসকি খেলাম। আমাদের নিজেদের রং তুলি দিয়ে শিল্পী হতে হবে, আর রং, ক্যানভাস, তুলি সব কেনার আনুমানিক খরচ ১০০ ডলার! মা গো মা, আমি পাগল! ডলারের দাম এত কমলো কবে! বের হয়ে গেলাম ছুটে। পাশের রুমেই দেখি দু'সপ্তাহের একটা ইন্টেনসিভ কোর্স আছে, 'ড্রয়িং'।
রং ধরাবে না, পেন্সিল, চারকোল, এসব দিয়ে আঁকিবুঁকি শেখাবে। ভাবলাম, ভালোই হবে! তাও যদি সোজা দাগ দেয়া শিখি!
দু'সপ্তাহের কোর্স শেষ হলো শুক্রবার। দশ বছর থেকে যেখানে আর আঁকছি না, সেখানে দু'সপ্তাহে আঁকা শিখে শিল্পী হয়ে যাবো তেমনটা আশা করি নি। কিন্তু খুব ভালো লেগেছে কোর্সটা। শিল্পীদের ত্রিমাত্রিক সব কিছুতে দ্বিমাত্রিক করে আঁকতে হয়।
আমরা জানি একটা বাক্সের চার দিক সমান, কিন্তু এঁকে দেখুন চার দিক সমান করে। বাক্স হবে না। শিল্পীকে জানতে হয়, কোন দৈর্ঘে, প্রস্থে কিংবা কৌণিক দুরত্বে বেশ কম করালে কয়েকটা দাগের সমষ্টিকে বাক্সের মত দেখাবে। ওদের আলো ছাঁয়ার খেলা জানতে হয়। একটা মসৃন গোলাকার বলকে কাছ থেকে দেখুন, উপরে আলো, আবার নিচে যেখানে মাটিতে লেগে আছে, সেখানেও ছায়া হওয়ার বদলে আলো।
আমি এখনও আঁকা শিখি নি, কিন্তু অন্তত: শিল্পীরা কি করে দেখে, তা তো জানলাম!
এক সপ্তাহের মাথায় কয়লা দিয়ে আঁকা ছবিটা দিলাম। অনেক ভুল আছে জানি। নিজের চোখেই ধরা পড়ছে। কিন্তু আলসেমী লাগছে, ঠিক করতে ইচ্ছা করছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।