নাজিল আযামীর ব্লগ সাইট
এ দেশের ইসলামপন্থীরা পঞ্চাশ দশক থেকেই ধর্মবিদ্বেষী প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির নৃশংসতার শিকার। ১৯৫৮ সালে ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় হামলা চালিয়ে বেশ ক'জন ইসলামপন্থী রাজনীতির সমর্থক মানুষকে রক্তাক্ত করার মধ্য দিয়ে যে ধর্মবিদ্বেষী রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, প্রায় অর্ধশতাব্দী পর সেই একই স্খানে একই গোষ্ঠী একই অস্ত্র দিয়ে ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর ইতিহাসের চরম নৃশসতার মধ্য দিয়ে ৫টি তরুণ-তাজা প্রাণকে হত্যা করে ধর্মবিদ্বেষী প্রতিহিংসার নজির স্খাপন করে।
তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী ১৯৫৮সালের ফেব্রুয়ারীতে পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে। এতে দলের আমীর মাওলানা মওদূদী প্রধান অতিথি থাকার কথা। কিন্তু সে সময় ক্ষমতাসীন আ'লীগ সমর্থিত ফন্সন্ট সরকারের লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র গুন্ডাদল সভাস্খল আক্রমণ করে এবং বহু নেতৃস্খানীয় ব্যক্তিকে নির্মম আঘাতে ধরাশায়ী করে।
গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী প্রাদেশিক সরকার গণতন্ত্র ও মানবতা বিরোধী এহেন দুষ্কার্যের জন্য অনুতাপের বদলে বিজয়গর্বে উল্লসিত হয়ে উঠে। সে সময় মাওলানা মওদূদী দেশের উত্তরাঞ্চল সফর শুরু করলে রংপুরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়।
১৯৬৯সালের ১২ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্খার রূপরেখা প্রণয়ন বিষয়ে এক আলোচনায় ইসলামী শিক্ষাব্যবস্খার পক্ষে বক্তব্য দেয়ার ‘গুরুতর অপরাধ' করে ফেলেন মেধাবী ছাত্র আবদুল মালেক। এর চরম দন্ড দেয় ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। ঐদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারা মালেকের উপর নির্মমভাবে আঘাতের পর আঘাত করে।
তিন দিন পর ১৫ই আগস্ট তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারী এই পল্টনেই জামায়াতের আরেকটি জনসভায় হামলা চালায় ধর্মবিরোধীরা। তারা সভামঞ্চ দখল করে তান্ডব চালায়। আহত করা হয় অর্ধশত কর্মী-সমর্থককে। এই হামলার প্রতিবাদে পরদিন সারাদেশে মিছিল-সমাবেশের আয়োজন করা হলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবঞ্জসহ বিভিন্ন স্খানে একই মহল হামলা চালিয়ে বহু সংখ্যক ইসলামপ্রিয় নিরীহ মানুষকে আহত করে।
এভাবে ষাট ও সত্তর দশক জুড়ে সারাদেশে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ইসলামপন্থী রাজনীতির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উপর অসংখ্য আক্রমণ চালায়। এই ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন রেখেছেন, তখনতো ইসলামপন্থীদের গায়ে ‘স্বাধীনতাবিরোধী' তকমা লাগেনি, তাহলে কোন ‘অপরাধ' তাদেরকে এতোসব আক্রমণের শিকার হতে হলো? ১৯৭১ সালের ১০ই আগষ্ট ঢাকার আব্দুল্লাপুর গ্রামে একটি ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় দেশের একজন শ্রেষ্ঠ আলিম মাওলানা মোস্তফা মাহমুদ আল- মাদানীকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের এই হামলা ও খুনের স্বাধীনতা যেন আরো অবাধ গতি লাভ করে। সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে ২০০৬সাল পর্যন্ত তিন দশকে বিভিন্ন ঘটনায় ইসলামী সংগঠনের দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে লোমহর্ষক কিছু ঘটনার বিবরণ দেয়া যেতে পারে।
১৯৮২সাল থেকে ২০০৩সাল পর্যন্ত শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই হত্যা করা হয়েছে ১৫জনকে। এরমধ্যে '৮২-র ১১ই মার্চ ঘটে নৃশংসতম হত্যাকান্ড। এদিন লাঠি- হকিষ্টিক দিয়ে পিটিয়ে এবং ইটের ওপর মাথা রেখে ইট দিয়ে থেতলিয়ে হত্যা করা হয় সাব্বির আহমদ, আব্দুল হামিদ, আইয়ুব আলী ও আব্দুল জব্বারকে। ১৯৮৫ সালে ১১মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঈদগাহ ময়দানে সংঘটিত হয় এক পৈশাচিক হত্যাকান্ড। সেইদিন অর্ধশতাধিক মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঈদগাহ ময়দান আর নিমতলা মোড়ের পিচঢালা পথ।
গুলি করে শহীদ করা হয়েছিল স্কুলের ছাত্র আব্দুল মতিন, রাশিদুল হক, শীষ মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সেলিম ও শাহাবুদ্দিন, রিক্সাচালক মুক্তার হোসেন, ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ও আলতাফুর রহমান সবুর সহ ৮ জনকে। ভারতের ২ জন উগ্র সাপ্রদায়িকতাবাদী নাগরিক পদ্মমল চোপড়া ও শীতল সিং কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি মিসেস পদ্মা খাস্তগীরের আদালতে পবিত্র কোরআনের সকল কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য রিট আবেদন করে। এরই প্রতিবাদে কোরআনের মর্যাদা রক্ষায় ইসলামপন্থী জনতা সমবেত হলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহেদুজ্জামান মোল্লার নিদের্শে এই গুলি ছোঁড়া হয়।
দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলো থেকে ইসলামপন্থী হওয়ার দায়ে ছাত্রশিবিরকে উৎখাতের জন্য বাম-ধর্মনিরপেক্ষবাদী ছাত্র সংগঠনগুলো নিরন্তর হামলা চালিয়ে হত্যা করে ১২৫ জন ছাত্রকে। তাদের প্রিয় শ্লোগান ছিল, ‘একটা করে শিবির ধর সকাল-বিকাল নাস্তা কর।
' তাদের নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার বহু ছাত্র এখনো অঙ্গ হারানোর যাতনা নিয়ে দিনযাপন করছে। হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯৮৬ সালে ৪জন , ১৯৮৭ সালে ৪জন, '৮৮-তে ৭জন, '৮৯-এ ১১জন, '৯৩ সালে ১৪জন, '৯৪ সালে ৬জন, '৯৫ -এ ১২জন, '৯৬-এ ৮জন, '৯৮তে ৫জন, '৯৯-এ ১০জন এবং ২০০১-এ ৫জন। এছাড়া সর্বশেষ ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর ঢাকার পল্টনে লাঠি-বৈঠা দিয়ে আরো হত্যা করা হয় ৫জন ছাত্রকে।
এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা হত্যা করেছে ইসলামপন্থী আরো রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে। ১৯৮৬ সালের ১০ই মে সিলেটের বিয়ানীবাজারের জামায়াত কর্মী সোহেল পারভেজ নঈমকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
১৯৮৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার জামায়াত নেতা শাহ্বাজ উদ্দিনকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্মীরা রড ও চাইনিজ কুড়াল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। একই বছর চট্রগ্রামের কুমিরা ইউনিয়নের জামায়াত নেতা মফিজুর রহমানকে সারা শরীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবার দায়ে ১২ই নবেম্বর রংপুর শহরের অন্যতম জনপ্রিয় জামায়াত নেতা আতাউর রহমান হামিদিকে সারা শরীরে ২৭টি আঘাত করে হত্যা করে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ১৯৯০ সালের ৪ঠা মে রাতে চট্রগ্রামের তরুণ জামায়াত কর্মী মুহাম্মদ আবু তাহের কে ২৫/৩০টি ছুরির আঘাতে হত্যা করে ওরা। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, নিহতরা প্রায় সকলেই নতুন প্রজন্মের মানুষ।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করাই ছিল তাঁদের ‘দোষ'। আর এসব নৃশংস হত্যা ও খুনের দীর্ঘ তালিকা খুনীদের ঘৃণ্য চরিত্র ও মুখোশকেই নগ্ন করে দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।