প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
পাঠ্যবইতে আলতু ফালতু জিনিষের সমাবেশ ঘটানো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য প্রধান দিক। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক র্বোড বলে আমাদের একটি সংস্থা আছে যেটি নানান সরকারের আমলে নানানরূপে এই আকামটি করে থাকে। পঞ্চম শ্রেণীর 'পরিবেশ পরিচিতি সমাজ' বইতে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিবরন অন্তর্ভূক্ত করেছে। অবশ্যই ভালো কথা, কিন্তু আমার বড় আগ্রহ কোন জাতিসত্তা, তাদের জীবনধারা, ভাষা বা সংস্কৃতির মতো র্স্পশকাতর বিষয় নিয়ে র্চচা করার র্পুবে র্পযাপ্ত গবেষনা ও মাঠ র্পযায়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন কিনা । কারণ বইটিতে মণিপুরীদের জীবনধারা, ভাষা ও সংস্কৃতি সমন্ধে যেভাবে ভিত্তিহীন, খন্ডিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে মনগড়া ও হাস্যকর তথ্যের অবতারনা করছে যেগুলো খুবই প্যাথেটিক।
বিশ্বের বিভিন্ন জাতি র্শীষক অধ্যায়ের ১৪৩, ১৪৪ ও ১৪৫ পৃষ্ঠাব্যাপী 'মণিপুরী' শিরোনামে লেখাটিতে বাস্তবের সাথে সংগতিপুর্ণ তথ্য খুবই কম। ছোটবেলায় আমরা যেমন বানায়া "গরু রচনা" লিখতাম অনেকটা সেইরকম। কিয়দংশ উল্লেখ করি -
(১) ‘এদের আদি বাসস্থান আসামের মণিপুর রাজ্যে। ’
প্রকৃতপক্ষে মণিপুর ভারতের উত্তর-পুর্বাঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র রাজ্য (২৩.৫μ-১৫.৩μ উত্তর আংশ থেকে ৯৩.১μ -৯৪.৩ μ পুর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং আয়তন ২২, ৩২৭ বর্গ কি.মি.); এর রাজধানীর নাম ইম্ফাল। মণিপুর আসামের অন্তর্গত নয়; আসাম হলো মণিপুরের সীমান্তবর্তী আরেকটি ভিন্ন রাজ্য এবং এর রাজধানী দিসপুর।
(২) ‘তাদের গায়ের রং ফর্সা, চোখ ছোট, নাক কিছুটা চ্যাপ্টা, উচ্চতা মাঝারি। ’
প্রকৃতপক্ষে মণিপুরীদের সবার গায়ের রং ফর্সা নয়,সবার চোখ ছোট বা সবার নাক চ্যাপ্টাও নয়। মণিপুরীদের মুখাবয়বে একইসাথে ভোটব্রহ্মী এরিয়ান দুই ধরনের বৈশিষ্ঠই আছে।
(৩)‘বিয়েতে ছেলেমেয়েরা একত্রে দেবতাকে খুশী করার জন্য নৃত্য পরিবেশন করে। ’
মণিপুরীদের বিবাহের দিন বৈষ্ণব রীতি অনুসারে পুরুষ পালাকার ও মৃদঙ্গ বাদকদের পরিবেশনায় বৈষ্ণব পালাকীর্ত্তন পরিবেশিত হয়, এর বাইরে কোন প্রকারের নাচের অনুষ্ঠানের অবকাশ নেই।
(৪) ‘পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য তারা নদীর ধারে বাড়ি নির্মান করে। ’
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য নদীর ধারে বাড়ি বানাতে হবে কেন? এদের কাজ হলো উপজাতিদের নিয়া যথাসম্ভব অদ্ভুত তথ্য বের করা। মণিপুরীরা অরণ্যচারী বা যাযাবর কোনটাই নয়, থাকে সমতলে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রত্যেকটা গ্রামের পাশ দিয়া কোন না কোন নদী বয়ে চলছে, আলাদাভাবে মণিপুরীদের বাড়ীঘরের আশেপাশে নদীর অবস্থান খুঁজে বেড়ানোর মানে কি?
(৫) ‘মণিপুরীদের নিজস্ব কোন ধর্ম নেই। ’
মণিপুরীদের নিজস্ব লৌকিক ধর্ম আপোকপা যা অত্যন্ত প্রাচীন, আধ্যাত্তিকতায় গভীর ও র্দাশনকিভাবে উচ্চস্তরের।
প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টকর্তা নিজের প্রতিকৃতি থেকে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটা মানুষ সৃষ্টিকর্তার একেকটা ছায়া। এখনো মণিপুরী মৈতৈদের অনেকে এই ধর্মের অনুসারী। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের একাংশের মধ্যে আপোকপা পুজার প্রচলন রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরীরা বৈষ্ণব র্ধমে দীক্ষিত হয়।
দেখুন: The Manipuri Religion
(৬)‘রাধা, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, গৌড়াঙ্গ এদের প্রধান দেব দেবী।
’
লৌকিক দেবদেবী সরালেল, সনামাহি, পাখাঙবা, ইমাগিথানি ইত্যাদির নাম এদের জানা নেই এটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু গৌরাঙ্গ তো কোন দেবদেবী নন, তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা মহাপুরুষ।
(৭) ‘মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা আছে। এই ভাষাকে বলা হয় মেথেয়ী। ’
"মেথেয়ী" নয়, মৈতৈ। আর ভাষাগতভাবে বাংলাদেশের মণিপুরীরা বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ এই দুই শাখায় বিভক্ত ।
Sil International বাংলাদেশের ৩৯টি ভাষার মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও মৈতৈ ভাষাকে তালিকাভুক্ত এবং উভয় ভাষার জন্য ISO 639-2 Language code প্রবর্তন করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ও দলিল দস্তাবেজে দুইটি ভাষাই মণিপুরী ভাষা হিসাবে স্বীকৃত এবং ভারত সরকার আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের ইস্কুলগুলোতে উভয় ভাষায় শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ করে দিয়েছে।
দেখুন: Languages of Bangladesh এবং ISO 639 Code: mni
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঢাকা থেকে প্রকাশিত পঞ্চম শ্রেণীর ‘পরিবেশ পরিচিত সমাজ’ পাঠ্যবইটির রচনায় ড. সাবিহা সুলতানা, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সেলিনা আক্তার ও লুৎফুর রহমান এবং সম্পাদনায় প্রফেসর মোহাম্মদ আলতাফ হোসেনের নাম রয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।