আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরিচয়খেকো ব্র্যান্ড

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আমাদের ছোটসময়ে ওয়াকম্যান ছিল এক স্বপ্নের মতো বস্তু। মনে আছে ক্লাশ থ্রিতে যখন পড়ি, তখন কিংবদন্তী গোলকীপার মহসীনের ভাগ্নে ক্লাশে ওয়াকম্যান নিয়ে এল, ওর মামা কোথায় জানি খেলতে গিয়ে কিনে নিয়ে এসেছিল। সেই ওয়াকম্যান নিয়ে আমাদের সেকি উত্তেজনা! এখন থেকে ক্লাসে বসে গান শোনা যাবে, মিঠুনের 'আই এ্যাম আ ডিস্কো ড্যান্সার' গানটা তখন সুপারহিট। আমরা ক্লাশের পড়াশোনা বাদ দিয়ে, ব্যাগের পেছনে মাথা গুঁজে ওয়াকম্যানে শুনি 'আই এ্যাম আ ডিস্কো ড্যান্সার, জিন্দেগি মেরে গানা ...', আর খুব ধীরে ধীরে মাথা দোলাই যেন স্যার বা ম্যাডামদের চোখে না পড়ি। এমনি ছিল সেই ওয়াকম্যান ফিভার।

একসময় সেই ওয়াকম্যানের পথ ধরে পোর্টাবল সিডিপ্লেয়ার আসল, যার নাম কিভাবে যেন হয়ে গেল সিডিম্যান। এমনকি এই "সিডিম্যান" শব্দটা না জানার জন্য বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্রও হতে হলো আমাকে এক আড্ডায়, সবার এমনভাব যেন যন্ত্রটা বের হবার সাথেসাথেই শব্দটাও ডিকশনারীতে ঢুকে গেছে। তো, বছরকয়েক আগে যখন এমপিথ্রি প্লেয়ার বেরুলো, আমি এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিরে এটাকে কি এখন থেকে এমপিথ্রি-ম্যান বলা হবে নাকি?' ব্র্যান্ড কিভাবে একটা বস্তুর আইডেন্টিটিকেও গ্রাস করে ফেলে, ভাবলেও অবাক লাগে। ওয়াকম্যান কোন যন্ত্রের সাধারন পরিচয়কে বোঝায় না, যেমনটা বোঝায় রেডিও, টিভি বা ব্যাটারী -- এই শব্দগুলো। 'ওয়াকম্যান' হলো সনি'র তৈরী পোর্টাবল মিউজিক প্লেয়ারের ব্র‌্যান্ড নেইম।

যেমন সনির টিভির ব্র্যান্ড নেইম ছিল ট্রিনিট্রন। অথচ আমরা কেউ বলিনা যে "আমাদের একটা ট্রিনিট্রন আছে", যদিও "আমার একটা ওয়াকম্যান আছে" বলাটাই যেন স্বাভাবিক। বেশী চলতে চলতে বা একচেটিয়া বাজার দখল করে ব্র্যান্ডনেইম খুব সহজেই যন্ত্রের মূল পরিচয়টাকেই খেয়ে ফেলে। তবে এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্টর কাজ করে, যেটা হলো ব্র্যান্ডনেইমভ্যালু শুধু দ্রব্য না, মাঝেমাঝে জন্মদাতা কোম্পানীকেও ছাড়িয়ে যায়। যেমন, "আজকে একটা প্যানাসনিকের ওয়াকম্যান কিনেছি" বা "তোশিবার ওয়াকম্যানটা দেখতে চাল্লু" এসব কথা শুনে কারও খটকা লাগেনা, যদিও ওয়াকম্যান শুধু সনিরই হবার কথা! যেমন ওয়াকম্যানের পর হালের ক্রেজ আইপড।

এখনও পুরোপুরি হয়নি, তবে কয়েকবছরের মাথায়ই হয়ত আমরা শুনব, "স্যামসংয়ের নতুন আইপডটা ফাটাফাটি" -- জন্মদাতা এ্যাপল আর তার সন্তান "আইপডকে" নিজের ঘরে আটকে রাখতে পারবেনা। যেমন আরেকটা উদাহরন দেয়া যায়, 'হোন্ডা'। এখনও সম্ভবত বাংলাদেশে হোন্ডা/হুন্ডা/হন্ডা এসব শব্দের একটাই মানে -- মোটরবাইক। তাও একটু পোসপাসওলা গুলো। সাধারন স্লোস্পিডের মপেড গুলোও ব্র্যান্ডের নামে পরিচিত হয়ে গেছে, সেগুলোকে দেশে 'ভেসপা' বলে ডাকা হয়।

ইটালিয়ান এই কোম্পানীর বানানো মপেডগুলো দেশে এতবেশী এবং একচেটিয়া চলে যে, ভেসপা নিজেই মপেডের প্রতিশব্দ হয়ে গেছে। আর ক্রাইসলারের জীপের ব্যাপারটাতো এমনই হলো যে, জীপ নিজেই শব্দ হয়ে ডিকশনারীতে উঠে গেল। এয়ার জীপ, লুনার জীপ, জীপ হকি -- আরো কত শব্দ! যদিও আমাদের কাছে "পুলিশের জীপ" শব্দটা সবসময়েই আতংকের ছিল। এখন সম্ভবতঃ র‌্যাবের জীপ সেটাকে প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে। শুধু যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেই না, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের ক্ষেত্রেও এরকম ব্র্যান্ডের আগ্রাসন লক্ষণীয়।

ইদানিং অবশ্য তেমনটা দেখা যায়না, কারণ নিত্যব্যবহার্য কোন এক পণ্যের একচেটিয়া বাজার আছে এমন কোম্পানী খুবই কম। তবে একসময় ছিল যখন এ্যান্টিসেপটিক বলতে লোকে 'ডেটল'কেই বুঝত, বিকেলের খেলা শেষে বাসায় গিয়ে হয়ত মাকে বলতাম, "আম্মা খেলতে গিয়ে হাঁটু ছিলে গেছে, একটু ডেটল লাগিয়ে দেন। " অথবা মা বাবাকে বলত, "জেট শেষ হয়ে গেছে, নতুন এক প্যাকেট নিয়ে আইসেন। " হ্যাঁ, কাপড় ধোয়ার গুড়া পাউডারকেও মানুষ জেট বলেই জানত। আচ্ছা, এরকম কি আরো আছে? তবে ব্র্যান্ডের এই দিগ্বিজয়ী খেলায় মনে হয় সবচেয়ে বড় তাসের বাড়িটা মেরেছে গুগল।

সম্ভবতঃ পৃতিবীর অনেক ভাষতেই এটা এখনএকটা শব্দ হয়ে গেছে, যার মানে হলো ইন্টারনেটে কিছু সার্চ করা। আমরা এখন খুব সহজেই বলি, "গুগুলাইয়া দ্যাখতো অমুক জিনিস নিয়া কি কি লেখা আছে?" এখনও হয়ে যায়নি, তবে অচির ভবিষ্যতেই আমরা শুনব ছোট্ট মেয়েটি মাকে হয়ত বলছে, "আম্মু আমার হোমওয়ার্কের খাতাটা পাচ্ছিনা, একটু গুগল করে দাওনা। " যদিও ঠিক ব্র্যান্ড বলা যায়না, তবে কাছাকাছি ধরনের আরেকটু ঘটনা ঘটে গেছে পৃথিবীতে। হ্যাঁ, আর কিছুদিন পরেই যিনি দেখা দেবেন, সেই সান্টা ক্লজ। বড়দিন উপলক্ষে যে সান্টাক্লজ বাড়ী-বাড়ী গিয়ে বাচ্চাদের ভাল হয়ে বছর কাটানোর জন্য পুরস্কার হিসেবে উপহার দিতেন, তিনি এখন শুধু রাতের বেলা "জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল" বাজিয়ে বাচ্চাদের বিছানার পাশে চুপচাপ উপহার রেখেই চলে আসেননা, তাঁখে এখন দোকান পাট, শপিং মল, রেস্তোরা সবখানেই দেখা যায়।

আর তাঁর হাত থেকে উপহার হোক আর ম্যালা পয়সা খরচ করেই হোক, এটা সেটা নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহটাও এখন আর শুধু বাচ্চাদের মাঝে সীমিত নেই। ছেলেবুড়ো সবাই সান্টার ভক্ত। কেজানে, হয়ত অলরেডী এমন দিন চলে এসেছে যে, "বড়দিন কি?" জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশেই বলবে, " কেন? সান্টার জন্মদিন!" তারপর আপনি যদি আবার বেড়ে বলে বসেন যে, "নারে ভাই, এটা হলো ইয়েস বা জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন", তখন হয়ত দেখা যাবে আপনাকেই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, "জিসাস ক্রাইস্ট? সে আবার কে?"

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.