গভীর কিছু শেখার আছে ....
মানুষ জন্মায়, পৃথিবীতে জীবনযাপন করে কিছুদিন; তারপর মৃত্যুতে ঘটে তার পরিসমাপ্তি। এভাবে যতো মানুষ এসেছে, সবাই চলে গেছে, দু’-চারদিন পর তাকে ভুলে গেছে সবাই। এটাই সাধারণের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। কিন্তু যিনি কীর্তিমান, মানুষের মনে অপার ভালোবাসা যিনি রেখে যান, তাকে কেউ বিস্মৃত হন না। তিনি থাকেন এবং নানা প্রসঙ্গে ঘুরেফিরে আসেন আমাদের মধ্যে।
মৃত্যুও তার মৃত্যু ঘটাতে পারে না।
সঞ্জীব চৌধুরী, আমাদের প্রিয় সঞ্জীবদা ছিলেন এমনই একজন মানুষ। যে কোনো মানুষের জন্যই মৃত্যু অবধারিত, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই হয়। তবু কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। সঞ্জীবদার মৃত্যু আমি কোনোদিনই মেনে নিতে পারবো না।
এতো তাড়াতাড়ি সঞ্জীবদার চলে যাওয়া ঠিক হয়নি। তার কাছ থেকে আমাদের আরো অনেক কিছু পাওয়ার ছিল।
আমাদের শিল্পীরা, আমাদের গীতিকার-সুরকাররা, সাংবাদিকরা, সর্বোপরি আমাদের দেশের মানুষ সঞ্জীবদার কাছ থেকে আরো অনেক কিছু পেতে পারতো। সঞ্জীবদাকে মূল্যায়ন করার সাধ্য এবং সাহসের কোনোটিই আমার নেই। সঞ্জীবদা সব মূল্যায়নের ঊর্ধ্বে।
শিল্পী হিসেবে সঞ্জীবদা
সঞ্জীবদা ছিলেন সত্যিকারের শিল্পী। একজন শিল্পীর মধ্যে যেসব গুণ থাকলে তাকে সত্যিকারের শিল্পী বলা যায় সঞ্জীবদার মধ্যে তার সবকয়টি গুণই ছিল। প্রকৃতিগতভাবেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পবোধ। পরবর্তী সময়ে প্রবল ইচ্ছা, দৃঢ়তা আর চর্চার মাধ্যমে নিজের ভেতরের শিল্পীটাকে তিনি বাইরে নিয়ে এসেছিলেন।
তবে সেটা তিনি করেছেন সম্পূর্ণ শৈল্পিকভাবে।
অন্য শিল্পীদের মতো শিল্পী হতে চাননি বলেই হয়তো গান করাটাকে উনি পেশা হিসেবে নেননি। এর ফলে গানের ব্যাপারে তার মধ্যে কিছুটা উদাসীনতাও ছিল। শুধু গান নয়, জগতের অনেক কিছুর প্রতিই তার উদাসীনতা ছিল খুব।
তিনি বাস করতেন সম্পূর্ণ নিজের ভেতরে। বাইরের পৃথিবী, তার কলরোল কোলাহল তাকে ছুতে পারতো না খুব একটা।
আবার প্রয়োজনে ঠিকই তিনি ঝাপিয়ে পড়তেন। মূলত দাদা গানের প্রতি অনেক বেশি ইনভলভড ছিলেন।
দলছুটের সতীর্থ হিসেবে সঞ্জীবদা
’৯৩ সালে সঞ্জীবদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে শিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের একটা অফিস ছিল। আমারও খুব যাতায়াত ছিল সেখানে।
জুয়েল ভাই একদিন পরিচয় করিয়ে দেন সঞ্জীবদার সঙ্গে। গান করি শুনে দাদা আমাকে দু’-একটা গান শোনাতে বললেন। গান শুনে দাদা খুব খুশি হলেন। এরপর প্রায় প্রতিদিন দাদার সঙ্গে দেখা হতো, আড্ডা হতো, গান হতো।
’৯৬ সালে শিল্পী অশোক কর্মকারের একটা সলো একজিবিশনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করার দায়িত্ব পাই।
কাজটা করার সময় দাদা আমার খুব কাছাকাছি ছিলেন আর এ কাজটা করতে করতে দুজনেরই উপলব্ধি হলো যে, গান নিয়ে, মিউজিক নিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনা, আমাদের রুচিবোধ পুরোপুরি একরকম। দাদা একদিন বললেন, তুমিও গান করো, আমিও গান করি, কিন্তু আমাদের তো কোনো প্লাটফর্ম নেই। চলো, আমরা একটা গানের দল করি।
তৈরি হলো আমাদের গানের দল দলছুট। তারপর এতো বছর কেটে গেল।
দলছুটের চারটি ব্যান্ড অ্যালবাম বের হলো। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিটি অ্যালবামের সময় দাদা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। রাতের পর রাত জেগেছেন। বয়স, শিক্ষা, মেধা, মনন সব দিক থেকে সিনিয়র হলেও দাদা কখনো কাউকে ডমিনেট করতেন না। সবার প্রতিই দাদার স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অফুরান।
গীতিকার হিসেবে সঞ্জীবদা
আমার প্রথম সলো অ্যালবাম তখন ভোর বেলায় দাদাকে আমি প্রথম গীতিকার হিসেবে পেয়েছি। এ অ্যালবামে দাদা আমার জন্য রানী ঘুমায়, চক্ষু খুলে দেখ, হাট্টিমাটিম টিমসহ বেশ কিছু গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন। এক জীবনে দাদা খুব বেশি গান লিখেননি। কিন্তু যে কয়টি গানই লিখেছেন, তার প্রতিটি গানই হয়ে উঠেছে এক একটি জীবন, এক একটি দর্শন।
দাদার লেখায় রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্পের ব্যবহার ছিল অসাধারণ।
এমন শব্দের চয়ন, এমন বাক্যের গাথুনি আমি আজ পর্যন্ত কোনো গীতিকারের লেখায় পাইনি। এখন যারা গান লিখছেন তাদের অধিকাংশই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দাদার ছাত্র। সবাই কোনো না কোনোভাবে দাদাকে অনুসরণ করছেন। আমার সঙ্গে কিংবা দলছুটের জন্য যারা এখন গান লিখছেন, তাদের অনেককেই আমি চিনতাম না। দাদাই আমাকে চিনিয়েছেন।
এ ব্যাপারে দাদা খুব উদার ছিলেন।
কারো মধ্যে লেখার প্রতিভা খুজে পেলেই দাদা তাকে নিয়ে উঠেপড়ে লাগতেন। গানের কথার ব্যাপারে দাদার বলা একটা কথা প্রায়ই কানে বাজে। দাদা বলতেন, গানের কথায় যদি সময়ের টঙ্কার না থাকে তাহলে সে কথা আধুনিক নয়, যেই অর্থে আধুনিক নয় একটা কবিতা কিংবা একটা পেইন্টিং। দাদার লেখা শেষ গান ছিল জোছনা বিহার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ গানটি লিখেছেন দাদা অ্যালবামের প্রচ্ছদের ওপর ভিত্তি করে। এক ভোরবেলা হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা সুর আসে, দাদাকে সেটা শোনালে দাদা আগেই তৈরি হয়ে থাকা অ্যালবামের কভারের সঙ্গে মিল রেখে গানটি লিখে দেন।
সুরকার হিসেবে সঞ্জীবদা
দাদার সুর করা গানের সংখ্যা খুবই কম। সুরের ব্যাপারে দাদার মধ্যে সম্ভবত একটা অলৌকিক ব্যাপার কাজ করতো। দাদার বেশির ভাগ সুরই উঠে এসেছে দাদার নিজের অজান্তে।
সুর করার জন্য দাদা কখনো অন্যদের মতো আয়োজন করে বসতেন না। তার মাথায় যখন যা আসতো, তাই তিনি লিখতেন, তাই তিনি সুর করতেন।
হয়তো হাটতে হাটতে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন মাথায় কোনো সুর বাজতে থাকলো। কিংবা আড্ডা দিচ্ছিলেন, আড্ডার মধ্যেই হঠাৎ আনমনা হয়ে গেলেন আর একটু পরই আমাদের একটা সুর শোনালেন। এভাবেই তৈরি হয়েছে দাদার অধিকাংশ সুর।
যার ফলে, অন্য কারো সুরের সঙ্গেই দাদার সুরের কোনো মিল ছিল না কখনো।
কবি হিসেবে সঞ্জীবদা
গানের চেয়েও কবিতা লেখার প্রতি একটু বেশি ঝোক ছিল দাদার। দেশের প্রায় সব পত্রিকাতেই দাদার কবিতা ছাপা হয়েছে। রাশপ্রিন্ট শিরোনামে দাদার একটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে। কবি হিসেবে দাদা কেমন ছিলেন তা মূল্যায়নের ভার দাদা নিজেই দিয়ে গেছেন সময়ের ওপর।
কবিতা আমি খুব ভালো বুঝি না। অন্যরা যখন দাদার কবিতার প্রশংসা করে, তখনই কেবল বুঝতে পারি।
সাংবাদিক হিসেবে সঞ্জীবদা
সাংবাদিক হিসেবে দাদা কেমন ছিলেন এটা আমি বলতে পারবো না। কারণ সাংবাদিকতার ‘স’ও বুঝি না আমি। এটা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন সাংবাদিকরাই।
আমি যতোদূর জানি, প্রিন্ট মিডিয়ায় এখন যারাই কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে দাদার শিষ্য। দাদার হাত ধরেই উঠে এসেছেন বহু সাংবাদিক, যারা এখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
বন্ধু হিসেবে সঞ্জীবদা
দাদা ওয়াজ এ ওয়ান্ডারফুল ফ্রেন্ড। শুধু আমার কাছেই নয়, সবার কাছেই দাদা বন্ধুর মতো ছিলেন। আমি ও আমরা সবাই দাদার কাছ থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি।
চমৎকার আড্ডারু ছিলেন দাদা। দাদার আড্ডার জায়গাগুলো হয়তো লিমিটেড ছিল। সব জায়গায়, সবার সঙ্গে হয়তো আড্ডা দিতেন না। তবে দাদার আড্ডার একটি প্রিয় জায়গা ছিল আমার স্টুডিও।
কারণ সুযোগ পেলেই দাদা আমার স্টুডিওতে চলে আসতেন।
এখানে এসেই দাদা প্রাণখোলা হয়ে যেতেন। আড্ডা দিতে, জীবনের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে মজা করতে পছন্দ করতেন। নিজে যেমন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত থাকতেন সবসময়, তেমনি মজার মজার কথা বলে আড্ডার সবাইকে প্রাণবন্ত রাখতেন। আমরা যেসব কথা কাউকে বলতে পারতাম না দাদাকে সেটা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারতাম। দাদাও সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, ভালো এবং সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন।
দাদাকে সারা জীবন মিস করবো।
কারণ খুব কম মানুষই আছেন, যাদের সঙ্গে বেশি কথা বলা যায়। আমাকে মনে হয় দাদা একটু বেশি ভালোবাসতেন। তাই আমার প্রতি দাদার রাগও ছিল বেশি। প্রায়ই বলতেন, এতো বেশি মিউজিক করিস কেন? দাদা চাইতেন আমি মিউজিকে বেশি ইনভলভড না হয়ে যেন গানের প্রতি বেশি মনোযোগী হই।
অভিভাবক হিসেবে সঞ্জীবদা
দাদাকে আমি শুরুতেই একজন অভিভাবকের মতো করে পেয়েছি। আমার মিউজিক ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে দাদা সবসময় একজন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু গানের ব্যাপারে নয়, জীবনের যে কোনো ব্যাপারেই দাদা আমাকে সব দিক থেকেই সহযোগিতা করেছেন। কোনো সমস্যায় পড়লেই দাদার কাছে ছুটে যেতাম, দাদাও হাসিমুখে আমার যন্ত্রণা সহ্য করতেন। কোনোদিন দাদা বিরক্ত হননি।
বরং খুশিই হতেন।
মানুষ হিসেবে সঞ্জীবদা
মানুষ হিসেবে দাদা এক কথায় অসাধারণ। একজন ইউনিক মানুষ। সব মানুষই ইউনিক, সব মানুষই ভিন্ন। তবে দাদা ছিলেন ভিন্নদের থেকেও ভিন্ন।
চিন্তা-ভাবনা, চেতনা আর নীতির দিক থেকে তাকে যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মানুষ থেকে অ্যাবসলুটলি আলাদা করে ফেলা যায়। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত একজন মানুষ। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। নিজের প্রতি যতœ নিতেন না।
নিজেকে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেয়াই যেন দাদার একমাত্র ব্রত ছিল।
সব মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু নেগেটিভ ব্যাপার থাকে। দাদার মধ্যেও যে ছিল না, তা নয়। তবে দাদার এতো বেশি পজিটিভ ব্যাপার ছিল যে তার মধ্যে দু’-একটি নেগেটিভ ব্যাপার ম্লান হয়ে যেতো।
দাদা, তোমাকে মিস করছি আমি!
ভীষণ মিস করছি তোমাকে দাদা!
[অনুলিখন : টি আই অন্তর]
ফটো ক্যাপশন :
* (বাম থেকে) মারজুক রাসেল, সঞ্জীব চৌধুরী, বাপ্পা মজুমদার ও (নিচে বসা) হাসান মাসুদ।
বন্ধুদের সঙ্গে সঞ্জীবদার এমন হাস্যোজ্জ্বল দৃশ্য আর কখনো চোখে পড়বে না *
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।