পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে
(ব্লগে দেখলাম কোন এক অভিনেত্রীর বিয়ে প্রসঙ্গে লায়নের কথা উঠল। তাই এই পোস্ট। )
বাপ-মায়ের দেয়া নাম ওর কেউ মনে রাখে নি। সিংহের মত নির্ভীক ছেলেটা নিজেই পছন্দ করে নিজের নাম রেখেছিল লায়ন। সেটাই ছড়িয়ে গেল দিগ্বিদিক।
পার্বতীপুরের অজ পাড়া গাঁ থেকে এসে ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’- এর মত রুপকথার গল্পকেও হার মানিয়ে সে নিমেষে বুয়েট জয় করে নিল।
লায়নের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা এখনো মনে আছে! হল থেকে আমরা অনেকেই গিয়েছিলাম নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানের সামনে আড্ডা দিতে। তখন সবাই নতুন, অনেককেই চিনি না। লায়ন নিজে এসেই পরিচিত হল... ‘বন্ধু, তোর নাম কি?’ প্রথম কথাতেই এমন ‘তুই’ করে বলতে আমি আর কাউকে দেখি নি! নজরুল হলে ঘন ঘন যেতাম, লায়নের সাথেও তাই প্রায়ই দেখা হত, আড্ডা হত। যদিও আমাদের আড্ডা কিছুক্ষণ পরেই গানের আসর হয়ে যেত।
আর তার মধ্যমণি লায়ন। জেমস-এর গান এত ভাল জেমসও গাইতে পারে কি না আমার সন্দেহ (আজকে না হয় একটু বাড়িয়েই বল্লাম)। বিশেষ করে হলে বিদ্যুত চলে গেলে লায়ন যখন উদাত্ত কন্ঠে গান ধরত, সে মূহুর্তগুলো এখনো স্বপ্নের মত মনে হয়।
আমাদের ব্যাচ ঢোকার কিছুদিন পরেই ইউকসু ইলেকশন হল। হাসিব ভাইয়ের প্যানেল থেকে লায়ন দাঁড়াল আপ্যায়ন সম্পাদক হিসেবে।
প্রথম বর্ষের কেউ এসে সরাসরি ইউকসু ইলেকশন করতে বুকের পাটা লাগে। লায়নের তাতে কমতি ছিল না। ইলেকশনে এক সিনিয়র ভাইকে হারিয়ে দিল তো বটেই, সবচাইতে বেশী ভোটের ব্যবধানেও জিতল! আমার এখনো ভাবতে মজাই লাগে, ওই সিনিয়র ভাইয়ের কাছ থেকে মেলা টাকা খেয়ে , আমরা সবাই ভোটটা লায়নকেই দিয়েছিলাম।
লায়নের সেই হল উত্থান। ইলেকশনে জেতার পরে অনেককেই বদলে যেতে দেখেছি।
লায়নকে দেখি নি। ক্যাম্পাসে কিছুটা ফরমাল থাকলেও হলে সেইরকম আন্তরিক। কিন্তু, এই এত জনপ্রিয়তাই লায়নের কাল হল! ’৯৮-এ বিশ্বকাপ দেখা নিয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর হল। আমাদের সাধের ক্যাম্পাস কারা যেন গুঁড়ো গুঁড়ো করে পিষে ফেলল। এটাও একটা হতভম্ব হওয়ার মত দিন।
একটা কাঁচও মনে হয় সেদিন ক্যাম্পাসে আস্ত ছিল না! কর্তপৃক্ষ আরো অনেকের সাথেই লায়নকে দোষী সাব্যস্ত করল। লায়ন ঐ ঘটনায় আসলে জড়িত ছিল নাকি পরিস্থিতির শিকার এটা আমি জানি না। তবে স্যারদের একবার রোষানলে পড়লে যে আর রেহাই নেই, সেটা লায়ন হাড়ে হাড়ে টের পেল। ওকে মনে হয় দু’-এক টার্মের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল। আরো শুনলাম, লায়ন পরীক্ষা দিলে ইচ্ছে করেই স্যাররা ফেল করিয়ে দিত।
আমাদের যখন ফোর্থ ইয়ার শেষের পথে, লায়নের তখনো আরো ১০০ ক্রেডিট শেষ করা বাকী! যতটুকু জানি, লায়ন মোটেও সচ্ছ্বল পরিবারের সন্তান নয়। পরিবার থেকেও পড়াশুনা তাড়াতাড়ি শেষ করে সংসারের হাল ধরার একটা চাপ ছিল। এসব চাপে, রাজনীতি ইত্যাদির নানামুখি চাপে লায়ন হঠাৎ করেই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেল। যারা বলে লায়ন কোন এক অভিনেত্রীর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে- এটা মিথ্যা কথা। অভিনেত্রীকে জড়িয়ে যে সমস্যা- এটা লায়নের অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ছিল।
এটা নিয়ে যারা মজা লুটতে চায়, আমি তাদের ধিক্কার জানাই।
সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল অপ্রকৃতিস্থ লায়নকে যখন জোর করে ইউকসু ভিপি ইলেকশনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। বুয়েটে ছাত্রদল তখন অন্তসারশুণ্য। ইলেকশনে জিততে হলে লায়নের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো ছাড়া কোন গতি নেই। লায়নের তখন বোধ-বুদ্ধি নেই।
কিছুদিন আগেই এক মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। যে ছেলেটা একসময় রাজনীতির জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল, তার দুঃসময়ে তাকে সাহায্য করার পরিবর্তে, পার্টি তাকে নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলল। এরা কি মানুষ! আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, ভিপি-জিএস বিতর্কের সময় আমরা কয়জন স্তম্ভিত আর উতকন্ঠিত হয়ে দেখছিলাম লায়ন কি সব গত বাঁধা বুলি আউড়ে গেল, আর পার্টির লোকজন চারপাশে সারাক্ষণ তটস্থ হয়েছিল এই বুঝি লায়ন বেফাঁস কিছু বলে ফেলে। না, লায়ন বেফাঁস কিছু বলে নি। লায়ন যখন সুস্থ ছিল তখন তার ধারে কাছেও কেউ কখনো আসতে পারে নি, অসুস্থ লায়নও ভিপি পদে ইলেকশনে জিতে আসল! লায়ন ইউকসু ভিপি! কিন্তু, ভিপি পোস্ট তখন তার পতনকে আরো তরান্বিত করল মাত্র।
আরও চাপে সে আবার অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেল।
আমি জানি না লায়ন এখন সুস্থ আছে কি না (কেউ কোন খবর জানলে দয়া করে জানাবেন)। আমার মনে হয় না সে বুয়েট থেকে পাশ করে বের হতে পেরেছে। তবে আমরা যারা লায়নকে চিনতাম তারা চিরদিন লায়নকে মনে রাখব একজন অকুতোভয়, উদার, অসীম বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ হিসেবে, আমরা তাকে মনে রাখব আমাদের মাঝে জ্বলে ওঠা ক্ষণকালের তারা হিসেবে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েও যে হারিয়ে গেল, আমরা তাকে মনে রাখব তার উদাত্ত কন্ঠ আর গানের জন্য...যুগ থেকে যুগান্তরে আমরা তারায় তারায় রটিয়ে দেব...এক সিংহের গল্প।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।