তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো... ♫ ♫♫ ♫ ♫
সোনাপুর নোয়াখালী পৌরসভার সর্বদক্ষিণের একটি ছোট গ্রাম। এর চারপাশে মহব্বতপুর, শ্রীপুর, জালিয়াল, করিমপুর, গোপাই ও পশ্চিম বদরীপুর। কবি বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতি বিজড়িত নোয়াখালী শহরটি এর দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে ছিল একদা। পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের গোটা সময়টা সোনাপুর ছিলো নোয়াখালীর প্রাণকেন্দ্র। এখানে জেনারেল আইয়ুবের প্রতি বিক্ষোভ হয়েছে, মেজর জেনারেল আজম খানের প্রতি ‘ফিরে যাও’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে, পাকিস্তানি জান্তার দালাল ফ.কা চৌধুরীর প্রতি ঘৃণামিশ্রিত কালো পতাকা উথ্বিত হয়েছে।
সৈরশাসকের দোসর এখানে জনগণের সম্মানসূচক রায় পায়নি। ২৩ মার্চ ১৯৭১ সনের পরবর্তী প্রথম দশ দিনের মধ্যে অপরিণত মুক্তিযোদ্ধাদের দল সংগঠিত হয়েছে। স্থানীয় মিশনারী উচ্চ বিদ্যালয়ে বোমা বানাতে গিয়ে পশ্চিম বদরীপুর গ্রামের কৃতিসন্তান বাহারুল আলম চৌধুরী আহত হয়েছেন। পরবর্তীকালে আহত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে এই সোনাপুর এলাকার আধ কিলোমিটার দূরত্বে স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হয় একটি হিন্দু সাধুর আখড়া ও একটি খ্রীস্টানদের গীর্জা।
৪০০ বর্গ কিমি বিন্যস্ত বিশাল চরের পশ্চাতে শান্তিপূর্ণ জনপদ বেষ্টিত সোনাপুর বাজার ও সংলগ্ন শ্রীপুর গ্রামের উপর পাকিস্তানি আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ এক বিরল নিষ্ঠুর গণহত্যা।
ইসলামপ্রীতির কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানিদের একটা অহমিকা ছিলো তাদের সৈন্যবাহিনীর ক্ষমতা ও যোগ্যতা নিয়ে। ১৮ জুন ১৯৭১ সালের বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কারণ কি এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সাথে এই ধ্বংসযজ্ঞের সম্পর্ক কোথায়- তা নির্ণয় করা কঠিন। জাতিসংঘের সদস্যপদপ্রাপ্ত ইসলাম রক্ষার সংগঠন পাকিস্তানের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী নি:সন্দেহে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোর ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেছে। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ক্ষমতাকে করেছে সুসংগঠিত।
এরকম অহমিকায় প্রদীপ্ত দেশের সৈন্যবাহিনীর আচরণ ও শিক্ষার বাস্তব প্রকাশ ভাবার বিষয়। যে কোন রাষ্ট্রের নিজস্ব সংগঠন তার সৈন্যবাহিনী। হত্যা, ধ্বংস, আক্রমণ বা প্রতিরোধ যে কোন কাজেই তার উদ্দেশ্য থাকে। কারণহীন সামরিক এ্যাকশন সৈন্য, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র পরিচালকদের ব্যাপারে ভীতির সঞ্চার করা ছাড়া আর কোন অর্থ বহন করে না। সময়ে ভাড়াটিয়া বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পোষাকি মানবপ্রীতি, তথাকথিত মুসলিম দেশ পাকিস্তানের প্রতি মমতাবোধ ও ইসলামদরদী সেজে সাধারণ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারলেও ওদের আসল চরিত্র উন্মোচিত হতে সময় নেয়নি।
অকারণে গণহত্যা, সম্পদ লুন্ঠন ও গণতন্ত্র হত্যার কাজে পাকিস্তানি শাসক মহলের জুড়ি নেই। আজ স্মৃতিরোমন্থন করে শিহরিত হচ্ছি- কেমন করে প্রতারক শোষকশ্রেণীর খপ্পরে ছিল বাংলার মেহনতী সাধারণ মানুষ চব্বিশটি বছর।
এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাতে শহর পতনের পর থিতিয়ে আসছিলো উত্তেজনা। নোয়াখালী শহরে জেঁকে বসে গেছে মুসলিম লীগ ও জামাতের পাকিস্তানি দালালদের প্রশাসন। গঠিত হয় শান্তি কমিটি, ঘাপটি মারা নিরীহ সেজে থাকা পাকিস্তানি দোসররা বাঘ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের উপর।
ঘর-বাড়ী, দোকান-পাট লুট হয়ে ছারখার। শহরের হিন্দু বসতি প্রায় নিশ্চিহ্ন। সোনাপুর এলাকার খ্রীস্টান জনগোষ্ঠী নিশ্চিত কোনপক্ষই তাদের প্রতি বিরাগ হতে পারবে না। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পক্ষে নানা সাহায্য সহানুভূতিতে আগুয়ান।
তখনকার নোয়াখালীর চালচিত্র অনেকটা শোকাহত মায়ের শোক সামলে ওঠার পর ধীর মন্থর গতিতে সংসারের হাল ধরার মত অবস্থা।
স্বাধীনতার দীপ্তি আগুনের মতো বাংলা প্রেমিকদের হৃদয়ে জ্বলছে। অসহায় মানুষেরা প্রত্যক্ষ করছে রাজাকার, মুসলিম লীগ, আর জামাতিদের জঘন্যতম কাজগুলো। মনে পড়ে এক হিন্দুর বাসা দখলের পর টাইটেল পাস জামাতের শহর নেতা স্বহস্তে গাছ কেটে সাফ করে ফেলছেন। বিস্ময়াভিভূত দর্শকের জিজ্ঞাসা, “গাছের কি দোষ”? ইসলামপন্থী মাওলানার সংক্ষিপ্ত জবাব- “হিন্দুর চিহ্ন ও রাখবো না, হিন্দু কাফের, হিন্দুর ফুল ও কাফের”। এই ছিলো পাকিস্তানিপ্রেমীদের মানসিকতা।
শোনা যায় এই মাওলানা এখনও রাজনীতি করেন। এখনও বাংলাদেশে ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন দেখেন। আরেক কোরআনে হাফেজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের অজুহাতে খলিফারহাট এলাকায় তিনমাসের প্রসূতি মহিলাকে গণধর্ষণের পর তার গোপন অঙ্গে লবণ-মরিচ মেখে দিয়ে বীরের মতো যুদ্ধ জয় করে পাষন্ডরা। নাদির শাহীর কায়দায় লুন্ঠিত দ্রব্য এরা পরস্পরের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করত। এ সবই পাকিস্তানের বজায় রাখার লড়াইয়ের ইতিহাস।
ইসলামের মহত্ত্বকে কালিমা লিপ্ত করার জন্য ধর্মব্যবসায়ী ও ক্ষমতালিপ্সু পিশাচেরা দায়ী। মুসলমান ও ইসলাম কখনও মানুষের মঙ্গল ছাড়া ক্ষতির চিন্তা করে না। কোন অত্যাচারী জুলুমবাজ শোষকের সাথে অন্তত আর যাই হোক মুসলমানদের সম্পর্ক থাকতে পারে না।
সোনাপুর নামের অবতারণা দিয়ে এই টুকরো কথা লেখা শুরু করেছিলাম। সোনাপুরে সংগঠিত পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরর্থক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা কোথাও বিবৃত হয়নি।
আগেই বলা হয়েছে বাংলার দক্ষিণে রেল আর পাকা সড়কের থমকে যাওয়া জনপদ ‘সোনাপুর’ সাহসী মানুষের সুখী ও অসাম্প্রদায়িক জীবন আর চিরদরিদ্র খেটে খাওয়া জনস্রোতের এক আশ্চর্য আশ্রয়। মাত্র এক বর্গকিলোমিটার এলাকাকে রিক্সার চারণভূমি বলা যাবে। মসজিদ মাদ্রাসার পীঠস্থান বলা যাবে। হিন্দু-খ্রীস্টানের মিলনস্থান বলা যাবে, আর বলা যাবে শিক্ষার কেন্দ্রভূমি। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন।
মাত্র ৪০০ গজ রাস্তার দুই ধারে ‘টি’ অক্ষরের মত সাজানো ছোট ছোট দোকানের পসরা বসেছে। একপাশে অলসভাবে শুয়ে থাকা লাল রেলস্টেশন ঘর, তারের পুকুর, বকশির মসজিদ, দরিদ্রতম মানুষের গায়ে লাগা ঘরের চরিলাই, রসিদ হিমাগার, কয়হাত পরেই বেড়ী বাঁধের কোলঘেঁষে নেমে গেছে দক্ষিণে বহুদূরে জেগে ওঠা চরের সমারোহ। সুপারি চারা, নারিকেল ও কলার পাতার আড়ে ছোট ছোট ঘরের বিরল বসত। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, দুপুরের ঘুম স্তব্ধতা ভেঙ্গে চা-দোকানের কোলাহল- বিকাল নামছে ধীরে ধীরে। মসজিদ-মাদ্রাসার আজান আর বৈকালিক ট্রেনের শব্দে জেগে উঠছে মহব্বতপুর, শ্রীপুর, পশ্চিম বদরীপুর আর করিমপুর।
বেলা চারটায় উত্তরের পাকাসড়ক ধরে ছুটে এল শব্দময় দানব বাস, ট্রাক, লরি। স্থানে স্থানে উগরে দিলো চাইনিজ অটোমেটিক হাতে পাকিস্তানি সেনাদের। সর্বদক্ষিণে ছুটে এসে একটি বাস থামলো। ‘টি’ –এর পশ্চিম বাহুতে ছুটে গেলো একদল। উত্তর দিকের শ্রীপুর ও করিমপুর গ্রামে ঢুকলো একদল সেনা।
মোক্তারবাড়ীর চারপাশ ঘিরে ঘনবসতির ঘেরে ঢুকে গেলো পাকিস্তানি হানাদাররা। উত্তর সোনাপুর এলাকায় আগেই নেমে পড়েছিলো একদল। পাকিস্তানি সেনাদলের কোন ঘোষণা নেই, অনুসন্ধান তত্পরতা নেই, নেই কোন প্রতিরোধের প্রতীক্ষা। ‘টি’ –এর পশ্চিমপ্রান্ত থেকে প্রথমগুলির সংকেত পাওয়া গেলো। সন্ত্রস্ত ভীত দোকানে বসে-দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, অসহায় ছোটাছুটি, নির্বিচারে লুট করছে।
গুলি করছে আগুন লাগাচ্ছে তারা। মুহুর্তে চার’শ গজ এলাকা নরকে পরিণত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন, জ্বেলে গেল দোকান, ঘর-বাড়ী, খুন হয়ে গেলো শতাধিক জন মানুষ। পুড়ে ছাই হয়ে গেলো অনেকেই দু’ঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রতিবাদ প্রতিরোধহীন সোনাপুর আর তার চারপাশের গ্রামে নেমে এল এক শ্মশানের নিস্তব্ধতা। দোকানে লাশ, দোকানের সামনে লাশ, ডাক্তার, ডাক্তারের কাছে আসা রোগী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কোন স্তরের মানুষই বেঁচে থাকার আকুতি ছাড়া পাকিস্তানি বীর সৈনিকরা কোন প্রতিরোধের সম্মখীন হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধার হাতিয়ার দুরে থাকুক, চোর তাড়ানোর একটি লাঠি, বল্লম ও তাদের চোখে পড়েনি। তবুও তাদের জিঘাংসার আগুনে প্রাণ দিয়েছে এক’শ চব্বিশ জন মুসলমান ও এক জন মুচি। রিক্সাচালক, মুটে মজুরের মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠিত হয়েছে অগণিত। প্রবীণা, যুবতী পর্দানশিন নারীর ঘোমটা উন্মোচিত হয়েছে পাকিস্তানি বর্বরদের কামনিষ্ঠুর ভয়ালথাবায়। এই অপমানের কথা কেউ কোনদিন জানবেনা।
এই নিষ্ঠুর হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠনের ক্ষত কেবল তীব্র ঘ্রণা হয়ে জেগে আছে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে। বহু ছোট ব্যবসায়ী দোকান হারিয়ে চিরদিনের জন্য দরিদ্র হয়ে গেছে স্বাধীনতা পরবর্তী পুনর্বাসন তাদের জীবনে আর্থিক স্বস্তি আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি কোনদিন। দু’শ পঁচিশটি ছোট-বড় দোকানে লুন্ঠন চালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। পাঁচশটি পরিবারের প্রতিটি ঘরে ঢুকেছে হানাদার। এ লুন্ঠন, ধর্ষণ আর পালিয়ে যেতে না পারা মানুষদের হত্যা, প্রতিটি পরিবারে এনেছে শোকের করুণ ছায়া।
পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ছিলো দু ঘন্টা পনের মিনিট মাত্র। বর্বরতার নিদারুণ লজ্জ্বা এদের স্পর্শ করেনি। ঝড়ের বেগে এসে ঝড়ের বেগে নিরাপদে ফিরেছে, বিশ্ববেহায়া নির্লজ্জ বীরপুঙ্গবেরা। পাকিস্তানি লীগ-জামাতের সেদিনের সাথীরা মানুষের দুর্দশায় হেসে বিজয়ীর বেশে কোলাকুলি করেছে। সৈন্যবাহিনীর যে কোন “এজেল্ট” এ অন্তত শত্রুবাহিনীর কোন না কোন তত্পরতার নমুনা থাকে।
সোনাপুর অপারেশন ছিলো ঠান্ডা মাথার হত্যাযজ্ঞ। নিরীহ মানুষের রক্তে হোলিখেলার উত্সব। দেশরক্ষা ও ইসলামের নামে ক্ষমতার মসনদে বসে থাকা পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের নিষ্ঠুর হোলিখেলার জবাব একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দিয়েছে। কিন্তু ধর্মের নামে এ ধরনের নিষ্ঠুরতার অবসান কি হয়েছে এদেশে?
* লেখকঃ ত. ম ফারুক
প্রকাশকালঃ ২ জুলাই ১৯৯৮
** লেখাটি রবিউল হোসেন কচি সম্পাদিত নোয়াখালী পৌরসভা কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক স্মারকগ্রন্থ “নোয়াখালী” থেকে নেয়া হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।