আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সময়ের নিদর্শন : মনিকা আলি ( পর্ব ১ )

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

বাবাই আমাকে আর কে নারায়ণের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি তখন কিশোরী। বাস করতাম উত্তর লন্ডনের একটি মিল টাউনে। এর কয়েক বছর আগেই আমি উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমার বাবার গ্রাম জীবনের গল্প এবং নারায়ণের ম্যাজিকাল টাউন অফ মালগুড়ির মাধ্যমে আমি ইনডিয়া সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।

যেমনটা আমি জানতাম ইংল্যান্ড সম্বন্ধে। মালগুড়িতে প্রতিটি সফল ভ্রমণের মাধ্যমে যে কেউ আরও বেশি করে এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়বে। সুপরিচিত চরিত্রগুলো ধরা দেবে চোখের সামনে। পাঠকদের মাথায় তখন দি পেইন্টার অফ সাইন-এর নায়ক রমনের অনুভূতি ভর করবে। তা হচ্ছে পারিপার্শ্বিকতায় গভীরভাবে প্রোথিত হওয়া।

তার গল্প অ্যা স্টোরি টেলারস ওয়ার্ল্ড-এ নারায়ণ রামায়ণ এবং অন্যান্য এপিক-এর ওরাল স্টোরি ট্রাডিশন সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, গল্পগুলোর মধ্যে এতো অফুরন্ত জীবনীশক্তি আছে যে, লোকেরা বারবার তা শুনতে পছন্দ করে। কোনো লোককেই বলতে শোনা যায়নি যে, বন্ধ কর, আমি আগেই এটি শুনেছি। তারা বারবার শোনে, পড়ে এবং গল্পে অবগাহন করে। গল্প শ্রোতাকে জীবনের বোধের গভীরতা, মৃত্যু এবং পরের পরিণতি সম্বন্ধে ধারণা দেয়।

নারায়ণের মালগুড়ির গল্প সম্বন্ধে আমরা তারই বলা কথাগুলোকে ব্যবহার করতে পারি। মালগুড়িতে আমরা গীর্জার পাশ দিয়ে উড়ে বেড়াই না কিন্তু ধুলায় আচ্ছাদিত সরু রাস্তা ধরে স্বচ্ছন্দ গতিতে হেটে যাই, মার্কেট স্কয়ারে ভবঘুরের মতো আনন্দে মাতি কিংবা নদীর তীরে গোধূলির লীন আলোতে স্নানকারীদের দেখি। সাহসকে প্রতিদিনের বৈচিত্র্য বলা যায়। কফি পান করা এবং পৃথিবী ও রাস্তার ঘটনাবলি সম্বন্ধে আলোচনা করা ছাড়া সাধারণত কিছুই করার থাকে না। বড় উপন্যাস এবং উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে উঠে আসে চলমান পৃথিবীর ঘটনা।

যুদ্ধ কিংবা সাম্রাজ্যবাদের পাশাপাশি বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এমনকি গ্ল্যামারও এ প্রেক্ষাপটের বাইরে নয়। দি পেইন্টার অফ সাইনস নারায়ণের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ কমিক নভেল। রমন হচ্ছে সাইন পেইন্টার (যদিও সে নিজেকে আর্টিস্ট ইন লেটারিং ভাবতে চায়)। সে খুবই যুক্তিবাদী এবং সব সময়ই ব্যাচেলর থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে এইমত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নর-নারীর সম্পর্ক কখনোই অনিবার্য ছিল না।

জীবনে বিয়ে করা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ডেইসির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই তার বদলে যাওয়া শুরু হয়। পেছনে প্রেক্ষাপটে ছিল রমনের ফুফুর জীবনকাহিনী। ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আকৃষ্ট রমনের ফুফু। দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের বিন্যাসে নারায়ণের স্টাইলের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করার মতো।

দুটি চরিত্রই অত্যাধুনিক বহির্দৃষ্টি এবং যুক্তিবাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী। ডেইসির ক্ষেত্রে চিন্তা-চেতনার প্রসারতা আরো বেশি। সব ক্ষেত্রেই তাকে একই রুটিন মেনে চলতে হয়। স্থানীয় স্কুলে যাওয়া, রমনকে বাইরে পাঠানো, দর্শকদের সামনে আলোচনা করা, তাদের জন্ম পদ্ধতি এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা। জন্ম নিয়ন্ত্রণ ইসু নিয়ে রমন এবং ডেইসির অনুভূতি এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে নারায়ণ পূর্ব এবং পশ্চিমের বিরোধিতার বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন।

১৯৭০ সালের প্রথম দিকে আমার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে কলকাতায় শরণার্থী হিসেবে বাস করতেন। তিনি তার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা করতে যেতেন। হিন্দু ভদ্রলোকটি কয়েক বছর আগেই পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসিত হয়েছিলেন। বাবার বন্ধুটি ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। তিনি বলতেন, তার সাধারণ কাজের পরও তাকে এবং তার সহকর্মীদের অতিরিক্ত আরো দায়িত্ব পালন করতে হতো।

এর ওপর তাদের বেতন নির্ভর করতো। তারা স্থানীয় লোকদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে জ্ঞানদান করতো। তারা লোকজনকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতো। যদি এ সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট লেভেলের কম হতো তাহলে শিক্ষকগুলোর বেতন বাড়তো না। এ স্কিমটি ছিল খুবই কড়াকড়ি।

এগুলো ছিল বৃহত্তর আধুনিকীকরণের কিছু অংশ। ইন্দিরা গান্ধী এবং তার সরকার দেশকে আধুনিক যুগে নিয়ে যাওয়ার জন্যই হয়তো এমনটা করেছিলেন। দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্বন্ধে অধিক কথা বলা, বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রম এবং আলোচিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য করাÑ সবই এতে অন্তর্ভুক্ত। এই ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধেই নারায়ণ তার বইয়ে লিখেছেন। একটি লেখায় (দি রাইটারলি লাইফ) নারায়ণ সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তিনি বিশ্বকে আলোকিত করা অথবা এর উন্নতি করার ধারণার বাইরে নন।

এতোকিছুর পরও আমরা সচরাচর লুকানো অর্থ খুজে বেড়াই। এর পাশাপাশি সামাজিক প্রেক্ষাপট, আলোচনা, জাতীয় মূল্যবোধ এবং কমিটমেন্টের মতো বিষয়গুলোতে মূল্য নেই। নারায়ণের মতে, তার অধিক পছন্দ হচ্ছে পাঠক একটি বই ক্যাজুয়ালি গ্রহণ করুক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।