আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৪

আমি একজন অতি সাধারন মানুষ। সুন্দরের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। এই ব্লগে প্রচারিত ধারাবাহিক উপন্যাস এবং কবিতা আমার নিজ ব্লগ নীল নক্ষত্রে প্রচার করছি।


পাকিস্তানের করাচী শহরেই এতদিন বড় হয়েছে। সবে মাত্র স্কুল ফাইনাল শেষ হবার পর পরই শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।

যুদ্ধ চলা কালীন জুলাই মাসে ওরা করাচীর সব ছেড়ে চলে এলো নিজ দেশে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগেই প্লেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেল পাকিস্তানি আর্মিরা নানা রকম অস্ত্র হাতে এয়ারপোর্ট ঘিরে রেখেছে। দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল। বাবা মা যেতে দিক বা না দিক আমিতো অবশ্যই মুক্তি বাহিনীতে যাব, তখন দেখবি মজা। ব্যাটারা পরের দেশ দখল করে রেখেছ আবার অস্ত্র দেখাচ্ছ? এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখে মেঝ মামা দড়িয়ে আছেন।

বাবা আগেই টেলিগ্রাম করে জানিয়ে রেখেছিলেন।
মামার গাড়িতে করে তার ধানমন্ডির বাসায় এলো। পথে বৃষ্টি ভেজা, কাদা মাখা চাপা রাস্তা, শেওলা ধরা দালান কোঠা দেখে মনটা দমে গেল। পরক্ষনেই আবার মনে জোড় ফিরে এলো যাই হোক এই হলো আমার নিজ দেশ। পরের চাকচিক্য দেখে ভুলে থাকলে চলবে না, নিজের যা আছে তাই নিয়েই মাথা উঁচু করে বাচতে হবে, এরই নাম জীবন, এরই নাম স্বাধীনতা।

আবার মনে হলো এইতো যুদ্ধ শুরু হবার পর এখানে আসার মাস দুয়েক আগে বাবা দাদির জন্য কিছু টাকা পাঠাতে দিয়েছিলেন। করাচী শহরে তাদের স্থানীয় পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা সহ মানিঅর্ডার ফরমটা পোস্ট অফিসের কেরানির হাতে দেয়ার পর যখন সে দেখল ইস্ট পাকিস্তানে যাবে তখনই সে ফরমটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো মুখে বলেছিল ইস্ট পাকিস্তানমে রুপিয়া নেহি যায়গা, ভাগো ইহাছে।
টাকার নোট গুলি ঘড় ভরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো। তার পিছনে কিউতে দাঁড়ানো পাকিস্তানি লোকেরা তামাশা দেখছিল। নিশাত স্থির থাকতে পারেনি, কাচের কাউন্টারের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটার মাথার চুল টেনে ধরে বলেছিল ‘কিউ নেহি যায়গা ইয়ে তেরা বাপকা রুপিয়া হায় কিয়া দিখা তেরা সরকারি হুকুম দিখা।

পিছন থেকে এক পাঞ্জাবি লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কিতনা রুপিয়া? যাদা নেই স্রেফ ৫০ রুপিয়া। শুনে সে কেরানীকে বলে বুঝিয়ে তারপর সে টাকা পাঠায়। সেই দিনই বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতা আমরা এখনো পাইনি। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। মামার বাসায় ২/১ দিন থেকে তারা সোজা চলে এসেছিলো ঢাকা ছেড়ে মানিকগঞ্জের অদূরে ছয়য়ানি গালা নামের ছোট্ট এক গ্রামে।

মামার গাড়িই তাদের মালামাল সহ বানিয়া জুরি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলো। বর্ষা কাল বলে গাড়ি আর যেতে পারেনি। সেখানে থেকে নৌকায় করে এসেছিলো গালা ইউনিয়নের ছয় আনি গালা গ্রামে। তখন মুক্তি যুদ্ধের তোলপাড়। নিশাত সেই পোস্ট অফিসের ক্ষত এখনো ভুলেনি।

গ্রামে তার সমবয়সী চাচা, অন্যান্য চাচাত ভাইদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে মুক্তি যুদ্ধে যাবার দিন তারিখ ঠিক ঠাক করে ফেললো। গোপন চুক্তি হলো। কে কে যাবে, কখন কোথা থেকে কি ভাবে যাত্রা শুরু হবে সব পরিকল্পনা অত্যন্ত চুপি চুপি করা হলো। কাক পক্ষীতেও টের পায়নি।
লুঙ্গী, গামছা, গুড় চিরা সব কিছুই বেধে রেডি।

রাত ১২টায় চাচাতো ভাই শিহাব আরও কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসলে এক সাথে রওয়ানা হবে। রাত জেগে বসে রইলো, এক সময় মোরগে বাগ দিল, কাকের কা কা ডাক শুরু হলো, পাখীরা কিচির মিচির করতে করতে বাসা ছেড়ে রওয়ানা হলো, ঘড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভোরের মৃদু আলো এসে ঢুকল কিন্তু শিহাব এলো না। তার বদলে এলো বাবা।
কি, মুক্তি যুদ্ধে যাওয়া হলো না?
বাবা টের পেলেন কি ভাবে? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না! কি জানি কোথায় কোন ভুল করে ফেলেছি সব পরামর্শ ফাঁস হয়ে গেছে! বাবা বললেন
তুমি কখনো গ্রামে থাকনি, গ্রামের কাচা রাস্তায় খালি পায়ে হাটনি, গাছে উঠতে পারো না, সাতার জানো না তুমি মুক্তি যুদ্ধ করবে কি ভাবে, তার চেয়ে চল বিজয় নগরে সুশীল বাবুর কাছে নিয়ে যাই উনি অন্তত তোমাকে মুক্তি যোদ্ধা না হোক উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে তাদের সহকারী বানিয়ে দিবেন। এই দিয়েই মোটা মুটি দেশের কাজ করার সুযোগ পাবে।


যুদ্ধে যাওয়া হলো না বলে যতটা খারাপ লাগছিল নিজেকে যতটা নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো, অকর্মণ্য মনে হচ্ছিলো বাবার কথা শুনে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলো। তখনই সুশীল বাবুর বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। পনের বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। এখানে এসে দেখে তার মত অনেকেই সেখানে উপস্থিত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো শিহাবও ওখানে রয়েছে। শিহাবের সাথে চোখা চোখি হতেই একটা ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পেলো ওর চোখে মুখে।

ও! আচ্ছা, তাহলে তুমিই এই কাজ করেছ?
স্কুলে যেমন স্কাউটিংয়ের ক্লাস হোতো, সুশীল বাবুও সেই ভাবে তার হবু মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে একটা রাইফেলের মত কি এক অস্ত্র নিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। পাশে মেশিন গান রাইফেল এইগুলিও রয়েছে, পরে জেনেছে ওটার নাম স্টেন গান। বাবা আর সুশীল বাবু একই স্কুলে পড়তেন। বাবাকে দেখেই সুশীল বাবু থেমে গেলেন। এসো বাদশা, বাবার গ্রামের নাম বাদশা।

বাবা নিশাতকে দেখিয়ে বললেন এই হলো আমার বড় ছেলে, একে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম কাজে লাগাবেন। ওর খুব ইচ্ছা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে। সুশীল বাবু খুশি হয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন এমন ছেলেই আমার দরকার, যাও বাবা ওই ওখানে বস বলে হাত দিয়ে তার সামনের ব্যাটেলিয়ন যে খেজুর পাতার মাদুরে বসেছে সে দিকে দেখিয়ে দিলেন, বাবাও এক পাশে বসলেন। সুশীল কাকা আবার শুরু করলেন। কি ভাবে শত্রু পক্ষের এলাকা পার হয়ে নিজ দলের কাছে পৌঁছান যায়, কি ভাবে শত্রুকে আক্রমণ করতে হয়, নিজেকে রক্ষা করা, অস্ত্র রক্ষা করার নানা খুঁটিনাটি কৌশল তিনি বলে যাচ্ছেন।

এই ভাবেই বেশ কয়েকদিন গেল। ভোরে আজানের পর থেকেই শুরু হয় আর বেলা একটু উপরে উঠলে যখন মানুষের চলা ফেরা শুরু হয় তখন শেষ হয়।

নিশাতের সারা দিন কাটে এ গ্রামে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে, সুযোগ পেলেই শিহাবদের বাড়ি। ওই বাড়িতে কি যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা কি একটা আকর্ষণ আছে যা এখনো বুঝে উঠেনি। এদিকে শিহাবও ওর ঘনিষ্ঠ জনদের মধ্যে এক জন।

ওই ঘটনার পর থেকে শিহাবের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। একটু দূরে দূরেই থাকে। বুঝতে পেরে শিহাবই একদিন এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলল দেখ তুই আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে কাজ করতে পারবি না জেনে বুঝেই আমি মইন চাচার সাথে পরামর্শ করে চাচাকে বলে দিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবি না, তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে এখানেও আমরা সবাই এক সাথে থাকতে পারবো।
নিশাতদের একটা চার ব্যান্ডের ট্রানজিস্টার ছিল।

সন্ধ্যা হলেই পাড়ার প্রায় সবাই এসে জমা হতো ওদের বাড়ি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য। নিশাত, শিহাব, মইন চাচা এরাও শুনত। বিশেষ করে চরম পত্র আর দেশাত্মবোধক গানগুলি।
দেশ স্বাধীন হবার আশা নিরাশার স্বপ্ন আর নানান আলাপ আলোচনার মাঝে দিনগুলি বৈশাখী ঝড়ের মত উত্তাল গতিতে ছুটে চলেছিল।

সুশীল বাবুর দেয়া ট্রেনিং শেষ এখন তা কাজে লাগাবার পালা। এখন তার আদেশে সঙ্গী সাথিদের সাথে নিয়ে গোলা বারুদ, সংবাদ, রসদ ইত্যাদি পৌঁছানোর কাজ চলছিল। সুশীল বাবু নিশাতকে দূরে কোথাও পাঠাতেন না। তাই কাজ শেষ হতেই শিহাবদের বাড়ি। ওখানে না গেলে কি জানি কি একটা অপূর্ণ থেকে যায়, নানা ছল ছুতায় ও বাড়িতে যেতেই হয়।

মূলত এই এখন থেকেই শিহাব আর যুঁইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। ও বাড়ি গেলেই যুঁইয়ের লাগামহীন ইয়ার্কি ফাজলামি সত্যেও যেতে হয়। বেশি দূরে না, ওদের বাড়ি থেকে দেখা যায়। মাত্র কয়েক পা পথ। পথই যেন কেমন করে টেনে নিয়ে যায়, সারা দিন যেখানে যাই হোক দিনের শেষে এক বার অন্তত যেতেই হয়।

গায়ের সবুজ প্রান্তর, খোলা আকাশ, খোলা বাতাস নিশাতকে কানে কানে বলে যায় কি হলো নিশাত আজ তুমি এখনো যাওনি! বেচারা নিশাত আর কি করে তাই যায়। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। এই যে মইন চাচা এতো কাছের মানুষ কোথায় কি হচ্ছে কি করছে তার সব কিছু চাচার কাছে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই সেই মইন চাচাকেও বলতে পারছে না। যা আছে তা শুধু তার একান্ত আপন মনেই আছে। কারো কাছেই তা প্রকাশ করতে পারছে না, কেমন একটা চাপা অস্থিরতা নিয়েই দিন গুলি চলে যাচ্ছে।


দিন কারো জন্যই থেমে থাকছে না। নিশাতের দিন গুলিও থেমে নেই, চলে যাচ্ছে। সুশীল বাবুর নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে এলাকার অনেক কিছুই চেনা হয়ে যাচ্ছে, অনেক লোক জনের সাথে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। এই ভাবেই এক দিন দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করল।

রেডিওতে খবর শুনে সবাই একে একে জড়ো হলো সুশীল বাবুর বাড়িতে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। আনন্দ হবে, উৎসব হবে, স্বাধীনতার উৎসব। বাসি স্বাধীনতার উৎসব নয়। স্বাধীনতা বার্ষিকী নয় একেবারে জীবন্ত স্বাধীনতা।

সদ্য স্বাধীনতার উৎসব। এর কি কোন তুলনা আছে না কারো সাথে এর তুলনা করা চলে! কয়জনের ভাগ্যে এই উৎসব জোটে? এই দেশে আরও কত কোটি কোটি মানুষের জন্ম হবে কত কি হবে কিন্তু আজকের এই দিনের স্বাদ কজনে দেখবে? সুশীল বাবু নিশাতের হাতে এক টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন যাও ঝিটকা থেকে বাংলাদেশের পতাকা কিনে আন। কোন রকম টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়। দেড় মাইল পথ প্রায় দৌড়েই এলো। একটা মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই।

উল্লাস কমে যাবে, আনন্দের গতি ধীর হয়ে যাবে। সুখের স্রোতে ভাটা পরে যাবে। পতাকা কিনেই তা বগল দাবা করে আবার দৌড়। বাজার থেকে বেড় হয়ে এসে পথে গ্রামের মেঠো পথের পাশে সবুজ গম খেতের গমের শীষে বেধে কখন যে পতাকাটা আটকে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। বাড়ির কাছে এসে যখন দেখে বগলের পতাকা নেই, কি হলো? আবার উলটো দৌড়।


বেশ খানিকটা পথ এসে দেখে গমের শীষের সাথে পতাকা ঝুলছে। নিয়ে আবার দৌড়। বাড়িতে এসে দেখে বিশাল আয়োজন। সমস্ত এলাকার মানুষ চলে এসেছে। সবুজের মাঝে রক্ত লাল আর তার মাঝে দেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা বাঁশের তৈরি মাস্তুলের মাথায় বেধে ওড়ানো হলো।

হারমোনিয়াম তবলা রেডি ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে সবাই স্বাধীন ভাবে, মনের উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে এক সুরে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইল। সে যে কি শান্তি, কি উল্লাস তা কি আর ভাষায় বলা যায়? সে শুধু অনুভূতি দিয়ে অনুভবের। জাতীয় সঙ্গীতের পর আরও দেশাত্মবোধক গান হলো। কে যেন কলতা বাজার থেকে মিষ্টি এনেছিল। গানের পরে মিষ্টি বিলানো হলো।

সুশীল কাকার বাড়িতে খেজুরের গুড় দিয়ে ক্ষীর রান্না হয়েছিল কলাপাতায় করে সে ক্ষীর বিলানো হলো। হৈ চৈ শেষ করে গভীর রাতে শিহাব এবং মইন চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। পথে আসতে আসতে ভাবছিল এমন দিনে নিরুকে এক নজর না দেখলে কি আর স্বাধীনতার সুখ পূর্ণ হয়? যে করেই হোক একবার যেতেই হবে। কি ছুতা ধরে এই এতো রাতে যাওয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল।
বেশি ভাবতে হলো না।

বাড়ির কাছে আসতে শুনতে পেল ওই শিহাবদের বাড়ি থেকেই গানের সুর ভেসে আসছে। স্বাধীনতার উৎসবের ঢেউ এখানেও তোলপাড় হচ্ছে। জোসনা রাতে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে তাতে বসে সব বোনেরা মিলে গাইছে। সবার মাঝে বসা নিরুর কণ্ঠটাই বেশি করে কানে বাজছে। যে গান শুনে বাঙ্গালির রক্তে উত্তাল স্রোত বেয়ে উঠেছিল, যে গান শুনে বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সেই সব গান।

বোনেরা হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিল। নিশাতরাও এসে যোগ দিলো পাটির এক পাশে বসে। শিহাব তাড়া দিলো ‘এই এইভাবে শুধুই হট্টগোল করে গান গেয়ে কি উৎসব হয়, যা চা নিয়ে আয়। শুনেই নিরু মাঝখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটা কাপ, জগ ভরে চা আর তার সাথে এক গামলা গুর মুড়ি নিয়ে এলো এক এক করে।

গুড় মুড়ি শেষ হলে আবার মেঘ বিহীন আকাশে বৃষ্টির মত সুরের ঝঙ্কার। চারিদিকে শীতের কুয়াশা ঢাকা মেঠো পথ বেয়ে সে ঝংকার ছড়িয়ে গেল দূরে অনেক দূরে। আজ যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উল্লাস!
এই গানইতো গত নয় মাস ধরে শুনছে কিন্তু আজ যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে, আজ এই গানের সুরে আলাদা একটা আমেজ, আলাদা এক অনুভূতি। আজ যে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে! সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল তখন সারা জীবনের জন্য একটা সোনালী স্মৃতি সৃষ্টি করে থেমে গেল শুধু গানের রেশটা রয়ে গেল। নিশাত উঠে মইন চাচা সহ বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পিছন থেকে নিরু একটু জোরেই বলল।

খেজুর গাছ কাটার সময় আজ হান্নান ভাইকে দিয়ে হাড়িতে এলাচ দিয়ে রেখেছি কাল সকালে এসে রস খেয়ে যাবেন। কাকে উদ্দেশ্য করে বলা তা নিশাত ভালো করেই বুঝল আর বুঝল যুঁই। পিছন থেকে ডেকে যুঁই বলল শুনেছিস, তোর বৌ কি বলল? নিশাতের কানে আজকের এই রাতে যুঁইয়ের কথাটা সুমধুর হয়ে বাজলো। নিরুর চেহারা কেমন হয়েছিলো তা আর মৃদু চাঁদের আলোতে পিছন ফিরে দেখা হয়নি। তবে নিশাতের অন্ধ-দৃষ্টি তা ঠিক অনুমান করে নিয়েছিল।

পরদিন আর রাত পোহায় না, হে যামিনী কেন আজ বিদায় নিচ্ছ না তুমি?

দেশ স্বাধীন হলো। নতুন দেশ। নিশাতের বাবা তার ছুটির কাগজ পত্র নিয়ে ঢাকায় এলেন। সাথে নতুন দেশ, নতুন রাজধানী ঢাকা শহর দেখার জন্য নিশাতও এলো। নিশাতের মামার সেই ধানমন্ডির বাসায় উঠল।

পরদিন তার বাবা সেক্রেটারিয়েটে গেলেন কি করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। ভাগ্য ভালো সেক্রেটারিয়েটে তার কাগজ পত্র দেখে পর দিন থেকে কাজে জয়েন করতে বলে দিল। বাবার চাকরী হয়ে গেল। নিশাত ২/৪ দিন নতুন দেশের রাজধানী শহরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাবা ঢাকায় রয়ে গেলেন।

ফেরার দিন বাবা বলে দিলেন দুই এক মাসের মধ্যে একটা বাসা পেলে তোমাদের নিয়ে আসব, কলেজে ভর্তি হতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে বেশি ঘোরা ঘুরি করবে না।
সময় চলে যায়। আকাশে তারা জ্বলে, চাঁদ ওঠে, জোসনা ছড়ায়। আবার সূর্য ওঠে।

শীতের সোনালি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ইছামতী নদী দিয়ে পানি পদ্মায় গিয়ে মিশে আবার সেই পানি পদ্মা থেকে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মহা মিলনের জন্য মিশে যায়। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ঝাঁকা মাথায় হাটুরেরা হাট থেকে নানা সওদা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে। নিশাত পথের পাশে হালটে বসে বসে চেয়ে দেখে। কলই ক্ষেতে নীল ফুল ফোটে, সিম ধরে আবার সেগুলি ফসল হয়ে উঠে।

কৃষকেরা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসে। সোনালী গম ক্ষেতের আড়ালে আবার সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায়। দোয়েল, শালিক, ঘুঘু পাখি ডেকে ডেকে বিষণ্ণ দুপুরের মায়া ছড়িয়ে দেয়। এ ভাবেই প্রকৃতি তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, আমি আছি। সবাই তার নিজস্ব ভঙ্গিতে চলতে থাকে কিছুই থেমে থাকে না।

নিশাতের জীবনও থেমে থাকে না। নিরুর সাথে নিয়মিত না হলেও প্রায়ই দেখা হয়। ক্ষণিকের জন্য চারটি চোখে কি যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা হয়। সে কথার মানে অন্য কেউ বোঝে না। তবে এটুক বোঝে যে কিছু একটা আদান প্রদান হলো।

এই আদান প্রদানের রেশ কোথা থেকে কোথায় যাবে দুইজনের কেউ অনুমান করতে পারে না।

এক দিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে নিশাত দেখল বাবা এসেছেন। রাতে খাবার পর বাবা বললেন ঢাকায় বাসা পেয়েছেন। তোমরা সবাই আগামী শুক্রবারে চলে এসো। একটু কাগজ আন আমি ঠিকানা লিখে দিই।

নিশাত উঠে তার রাফ খাতা আর একটা কলম এনে বাবার হাতে দিলে বাবা ঠিকানা লিখে নিশাতকে বুঝিয়ে দিলেন গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে নেমে কি ভাবে যেতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। নিশাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি চিনে আসতে পারবে না কি আমি আসব?
না, আপনাকে আসতে হবে না, আমি যেতে পারব।
[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]




সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।