গভীর কিছু শেখার আছে ....
নিউ মার্কেটের কাচা বাজারে মাহবুব এবং সুজানার প্রথম পরিচয়। সুজানার চোখে চোখ পড়তেই অনেকটা গায়ে পড়ে মাহবুব বলেন, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি। সুজানা মুচকি হাসে। চমৎকার একটা হিরন্ময় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে সে হাসিতে।
হাসতে হাসতে বলে,
স্কুলে দেখেছেন। আপনার এবং আমার ছেলে একই স্কুলে পড়ে।
তাই নাকি? কোন ক্লাসে আপনার ছেলে?
ক্লাস ওয়ানে।
ও আমার ছেলেও তো ক্লাস ওয়ানে। তাইতো বলি আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।
আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে চিনি। আপনি মাহফুজের বাবা, তাই না?
হ্যা, হ্যা, আমার ছেলে মাহফুজ। আপনার ছেলের নাম?
আদনান।
সুন্দর নাম। বাচ্চার বাবা কি করেন?
বিদেশে থাকে।
ও তাহলে তো আপনার অনেক দায়িত্ব।
হ্যা, আর বলেন না। অনেক দায়িত্ব। হাট-বাজার করা, রান্না করা, ছেলেকে আনা নেয়া, লেখাপড়া করানো। সবই আমাকেই করতে হয়।
পুরুষদের সঙ্গে কথাবলার কৃপণতা সুজানার নেই বললেই চলে। সুজানা অনিন্দ্য সুন্দরী এবং স্মার্ট নারী। বয়স পয়ত্রিশের কাছাকাছি। প্রতিমার আদলের মতো দেহ গঠন। চঞ্চল দুজোড়া চোখ, নাকটা উচু আর সরু, ঠোট দুটো পাতলা, গোছানো দাতের পাটি।
মুক্তার মতো ঝকঝকে দাত। প্রাণকাড়া অপূর্ব হাসি। মোনালিসার হাসিকেও যেন হার মানায়। ও হাসিতে শরবিদ্ধ বিহঙ্গের মতো আহত হয়ে বিদায় নেন মাহবুব।
পরদিন স্কুলে আবার দেখা।
সুজানার পরনে হলুদ রঙের শাড়ি। পিঠময় ছড়ানো চুল। দূর থেকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মাহবুব। অতঃপর চেতনার অলক্ষ্যে দুজন মুখোমুখি হয়। কথা বলতে বলতে স্বভাবসুলভ হাসে সুজানা।
অদ্ভুত সুন্দর প্রাণ খোলা সলজ্জ হাসি। দেখলেই ভালো লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মানসপটে তার স্ত্রীর মুখচ্ছবিটা ভেসে ওঠে।
মাহবুবের স্ত্রী সুরমা। সুন্দরী তবে স্মার্ট নয়।
বিয়ের পর থেকে অনেক চেষ্টা করেও মাহবুব পারেননি স্ত্রীকে স্মার্টনেস করে তুলতে বরং সব সময় তাদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে বয়ে চলেছে একটা বিপরীত স্রোত। যা মাহবুবের মনকে দিনে দিনে বিষিয়ে তুলেছে গোলাপের কাটার মতো। স্ত্রীর কথা মনে হতেই হঠাৎ মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু তা স্থায়ী হতে পারে না। সুজানার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপে মেতে ওঠেন।
কিন্তু ছুটির ঘণ্টা বেজে গেলে তাদের গল্প আর বেশি দূর এগোতে পারে না।
পরদিন স্কুলের মাঠে আবার দেখা। সকালে শিশির পড়ে ভিজে আছে ঘাস। হিম ভেজা ঘাসের ওপর মায়েরা পলিথিন, বিছানার চাদর বিছিয়ে বসে আছে। ছোট ক্লাসের মায়েরা বসে থেকেই বাচ্চা নিয়ে যায়।
দশ-বারোজনের এক একটি গ্রুপ। সুজানার গ্রুপটি বসে কদম গাছের তলায়। গাছে ছোট ছোট কদম ফুল। বর্ষার আগমনের আভাস দিচ্ছে যেন। সুজানার আজ আর মায়েদের গাল-গল্পে মন নেই।
তার চঞ্চল দুজোড়া শুধু চোখ মেইন গেটের দিকে। চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মিলে যায় তার কাক্সিক্ষত মানুষটির দর্শন।
অভূতপূর্ব এক আকর্ষণে সুজানা ছুটে যায় তার কাছে।
কেমন আছেন ভাই?
এই তো আছি। আপনি কেমন আছেন?
ভালো! ভাবী কোথায়? ভাবীকে দেখি না যে।
ও খুব কম আসে। বাচ্চা আনা নেয়ার কাজটা আমিই করি।
ও ভাবী বুঝি সার্ভিস করেন?
না সার্ভিস টার্ভিস কিছু নয়। অসুস্থ। বারো মাসই একটা না একটা অসুখ লেগেই থাকে।
বেশ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলেন মাহবুব।
ও আচ্ছা। ভাই নিশ্চয়ই ব্যবসা করেন?
হ্যা, কি করে বুঝলেন?
এই যে বাচ্চার ডিউটি পালন করতে দেখে।
হ্যা তা বটে। চাকরি করলে বারোটা বেজে যেতো।
ভালো। আদর্শ বাবা আপনি। কথা বলতে বলতে স্কুল-ক্যাম্পাস পেরিয়ে নির্জন, নিস্তব্ধ রাস্তায় চলে আসে তারা।
নীরবতা ভেঙে মাহবুব বলেন,
শুনতে পাচ্ছেন?
কি?
কোকিলের ডাক।
ও, হ্যা।
সুজানা প্রেমিকার মতো করে মিষ্টি হাসে। ও হাসি দেখে যে কোনো পুরুষের মতিভ্রম হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সুজানা অত্যন্ত মার্জিত ও অমায়িক। ব্যক্তিগত দুঃখ, কষ্ট আর হতাশার কথাগুলো বলার জন্য এতোদিন এমন একজনকেই যেন খুজছিলেন মাহবুব। যতোক্ষণ বাচ্চারা ক্লাসে থাকে ততোক্ষণই দুজন পাখির মতো ঘুরে ঘুরে গল্প করে।
সময়টা বেশ ভালোই কাটে। ধীরে ধীরে তাদের মেলামেশা এতোটাই মুক্ত হয়ে ওঠে যে, তা সব গার্ডিয়ানের চোখে দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ে। অনেকেই বাকা চোখে দেখে। সেদিকে সুজানার লক্ষ্য নেই। সুজানা বরাবরই নিজেকে খোলামেলা উপস্থাপন করে।
আসলে সে একটু বেশি স্পষ্ট। মেয়েদের পক্ষে এটাকে অনাবৃতই বলা চলে। এতোটা খোলামেলা, চলাফেরা দেখে আবার অনেকেই আত্মীয়ও ভাবে। এ নিয়ে গার্ডিয়ানদের মধ্যে কম কানাকানিও হয় না।
তাই নিজেদের আড়াল করার জন্য মাহবুব একদিন সুজানাকে প্রস্তাব করেন,
চলুন, আমরা না হয় কোনো রেস্টুরেন্টে বসি।
যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।
হ্যা, হ্যা, সিওর, সিওর। চলুন।
ভূত রেস্টুরেন্টের দোতলায় নিরাপদ আস্তানা খুজে নেয় তারা। মাহবুবকে অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে।
প্রেমে পড়া যুবকের মতো। খাবারের অর্ডার দিয়ে মাহবুব কথা শুরু করেন,
কি আশ্চর্য! দেখেন এতোদিন ধরে আমাদের জানাশোনা অথচ কেউ কারো নাম জানি না। আমার নাম মাহবুব। আপনার?
আমি সুজানা। সুজানা চৌধুরী।
ও সুজানা, আপনি বলেছিলেন আপনার স্বামী বাইরে থাকে। কোথায়?
থাইল্যান্ড।
কি করেন উনি?
ব্যবসা।
কতোদিন পর পর আসেন?
আসেন না।
তার মানে?
তার কোনো মানে নেই।
কবে গেছেন?
আট বছর আগে।
আট বছর! আট বছরের একবারও আসেননি?
এসেছিল। একবার। আমাদের বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ নয় বছরের মধ্যে খুব বেশি হলে ছয় মাস আমি ওকে কাছে পেয়েছি।
আপনি কিছু বলেন না তাকে?
বলেছি, অনেক বলেছি।
তুমি চলে এসো। দেশে এসে একটা কিছু করো। আমরা একসঙ্গে থাকবো। কিন্তু সে আমার কোনো কথাই রাখেনি। হয়তো টাকার মোহে অন্ধ হয়ে গেছে।
আমি তো তার কাছে বেশি কিছু চাইনি। শুধু ছোট্ট একটি সুখী সংসার চেয়েছিলাম। তাও পেলাম না। একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে ডিভোর্সও করতে পারি না।
আমি জানি সে কোনোদিন ডিভোর্স করবে না আমায়। বিয়েটা লাইসেন্স হিসেবেই রেখে দেবে।
কিছু মনে করবেন না সুজানা। আপনার স্বামী আবার বিয়ে-টিয়ে করেননি তো?
না। বিয়ে করেননি।
বিয়ে করলে টাকা-পয়সা পাঠাতো না।
যোগাযোগ আছে?
আছে। টেলিফোনে। তাও যদি আমি ফোন করি।
সে করে না?
না।
ও মাই গড। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার স্বামী চারিত্রিক স্খলনজনিত কারণে এমনটা করছেন। তা না হলে একজন মানুষের পক্ষে এতোটা কঠিন হওয়া সম্ভব নয়। সুজানা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
তাইতো আমি একা। ভীষণ একা।
নিঃসঙ্গতা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
আমি বুঝতে পারছি আপনার এখন একজন ভালো বন্ধু প্রয়োজন। অনেকদিনের পরে একটু সহমর্মিতার আভাস পেয়ে সুজানার চোখের কোণে টলটল করে জ্বলজ্বলে অশ্রুবিন্দু। অগত্যা মাহবুব সুজানার হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে বলেন,
সুজানা, আমি আপনার বন্ধু হতে চাই। ভালো বন্ধু।
চিরদিনের বন্ধু। আজ থেকে আর আপনি সম্বোধন নয়, শুধু তুমি। ঠিক আছে? সব মানুষেরই কিছু না কিছু দুঃখ থাকে। একেকজনের দুঃখ একেক রকম। একজনের দুঃখের সঙ্গে আরেকজনের দুঃখের কোনো মিল নেই।
এই যে আমার কথাই ধরো, আমার স্ত্রী সুন্দরী বটে তবে আমার রুচিবোধের সঙ্গে তার রুচিবোধের কোনো মিল নেই। আমি মনে করি প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীর কাছে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। আবার স্বামীরও উচিত স্ত্রীর কাছে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। আমার দুঃখ একটাই আমি অনেক চেষ্টা করেও পারিনি স্ত্রীকে মানুষ করতে। আমি ডানে যেতে বললে সে বামে যায়।
আমি বামে যেতে বললে সে ডানে যায়। কিন্তু আমারও তো একটা মন আছে। আমারও তো ইচ্ছা করে জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে।
সুজানা, তুমিই পারো আমার সব অপূর্ণতা দূর করে দিতে। সুজানা নির্বাক চেয়ে চেয়ে শোনে।
কি এক মায়ামোহ বাধনে যেন বাধা পড়ে যায়। কিছুক্ষণ নীরবতা ভেঙে মাহবুব সাহেব বলেন,
তোমার বাসা কোথায়?
ধানমন্ডিতে।
কতো নাম্বারে?
১৪ নাম্বারে। মিনা বাজারের গলিতে। চারটা বাড়ির পরে সাদা রঙের ছয়তলা ফ্ল্যাট।
দোতলায় ডান পাশে আমি থাকি। বাম পাশে থাকে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ।
আপনার বাসায় কে কে থাকে?
আমি, আমার ছেলে আর একটি কাজের মেয়ে। আসেন একদিন আমার বাসায়।
যেতে পারি যদি তুমি সম্বোধন করো।
আপনি বা তুমি সম্বোধনে কি এমন এসে যায়।
এসে যায়। অনেক কিছুই এসে যায়। এই একটিমাত্র সম্বোধনে আপন হয় পর আবার পর হয় আপন।
কি জানি!
কি জানি বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না।
জানতে হবে। ঠিক আছে। এবারের মতো ক্ষমা করা গেল। আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় আমি আসছি তোমার বাসায়।
আচ্ছা তুমি কি খেতে পছন্দ করো?
আইসক্রিম।
সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে সুজানা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ভুল করেন না মাহবুব। এক বক্স ঈগলু ভেনিলা আইসক্রিম, দুই কেজি রসমালাই আর একটি খেলনার প্যাকেট নিয়ে সুজানার বাড়ি যান। ডোর বেল বাজতেই সুজানা এক ঝলক হাসি দিয়ে বরণ করে তাকে। ঘরে ঢুকে গৃহসজ্জার অপূর্ব নৈপুণ্য দেখে তিনি অনুভব করেন একজন মানুষের কতোটা শৈল্পিক রুচিবোধ থাকলে তার গৃহ এতো নিখুত করে সাজাতে পারে।
প্যাকেটগুলো সুজানার হাতে তুলে দিতে দিতে বলেন,
সুজানা, তুমি চারুকলার ছাত্রী ছিলে নাকি?
না। কেন?
এই যে তোমার ঘর সাজানোর ভিন্ন মাত্রা দেখে।
না, না। এ আর এমন কি। ভদ্রতার খাতিরে সুজানা আরো বলে, আচ্ছা এসব আবার কেন এনেছেন?
কেন তুমি খাবে।
তোমার ছেলে কোথায়? ডাকো ওকে।
আদনান, আদনান। সুজানা চেচিয়ে ডাকে।
আদনান লাফাতে লাফাতে এসে থমকে দাড়ায়। সুজানা বলে,
উনি তোমার আঙ্কল।
সালাম করো। আদনান হাত কপালে তুলে সালাম করতেই খেলনার প্যাকেটটি তুলে দেন মাহবুব। কালবিলম্ব না করে আদনান খেলনার প্যাকেটটি ছিড়ে খেলনাগুলো বের করে বিস্মিত হয়ে বলে, এতো খেলনা। কোথায় পেলে? সুজানা ছেলেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে বলে, যাও ও ঘরে গিয়ে বুয়ার সঙ্গে খেলো। মাহবুব বাধা দিয়ে বলেন, আহ ওকে তাড়াচ্ছো কেন? থাক না এখানে।
আদনান শোনে না। মায়ের আদেশ পালন করে।
আজ থেকে আমি মনে করবো আমার একটি নয়, দুটি সন্তান। মাহবুব সাহেবের কথা শুনে বুক ভরে যায় সুজানারও। কারণ অনেকদিন থেকে সুজানা এবং তার সন্তান একটুখানি ভালোবাসার কাঙাল।
সুজানার চোখের ভাষায় সব কিছু বুঝে ফেলেন মাহবুব সাহেব। এমনি করেই তাদের দিন যায়। কখনো স্কুলে কথা বলে, কখনো রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিয়ে, কখনো বাসায় সঙ্গ দিয়ে।
একদিন সন্ধ্যায় মোটরসাইকেল চড়ে উড়াল দেয় দুজন। উদ্দেশ্য দূরে কোথাও ঘুরে আসা।
সন্ধ্যার আলো-আধারিতে সুজানার গোলাপি চিজেল্ট গাল দুটো দেখে একবার বলতে চান, গোলাপ সুন্দর, না তুমি? কিন্তু পারেন না। তবে মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করেই মোটরসাইকেলের ব্রেক কষে সুজানার দেহের উষ্ণতা অনুভব করেন। সুজানা মাহবুবের কোমরে হাত পেচিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো জড়াজড়ি করে বসে থাকে। আশপাশের যানবাহন থেকে কিছু কৌতূহলী দৃষ্টি তাকিয়ে থাকে সেদিকে। বাতাসের বেগে ছুটে চলে মোটরসাইকেল।
এ শহরের এতো লোকের ভিড়ে কে কার খবর রাখে! সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ঘুরে বা দিকে টার্ন নিতেই হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মিনিবাসের ধাক্কায় বিকট শব্দ হয়। দুর্ঘটনায় পতিত হয় মোটরসাইকেলটি। চিৎকার দিয়ে দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ে। পথচারীরা ছুটে এসে ঢাকা মেডিকালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায়।
সুজানার মাথা ফেটেছে।
কপালে স্টিচ পড়েছে। মাহবুব সাহেব কোমরে আঘাত পেয়েছেন প্রচ-। পাশাপাশি শয্যায় সারা রাত কাতরায় দুজন।
পরদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবরটি স্কুলে পৌছে যায়। স্কুলে মায়েদের মধ্যে ছিঃ ছিঃ রি রি পড়ে যায়।
বাবাদের মধ্যেও চলে মুখরোচক গুঞ্জন। একদল মা যায় হসপিটালে। আরেক দল মাহবুব সাহেবের বাসায়। একদলের উদ্দেশ্য ব্যাপারটি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করা। আরেকদলের উদ্দেশ্য ব্যাপারটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মাহফুজের আম্মা অর্থাৎ মাহবুবের স্ত্রীর প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা।
কুকথা সব সময় বাতাসের আগে ছড়ায়। তাই মহিলাদের কাছ থেকে শোনার আগেই স্বামীর অপকর্ম সম্পর্কে অবগত হয়ে যান মাহবুবের স্ত্রী। রোগাক্রান্ত মুখে ভদ্রমহিলা মায়েদের উদ্দেশে শুধু বলেন, আসলে পৃথিবীতে নিজস্ব বলে কিছু নেই। আমরা যে মানুষকে আপন ভাবি এটা হচ্ছে একটা মায়ার বাধন। পৃথিবীতে কেউ কারো আপন নয়।
কাউকে আপন ভাবা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বোকামি।
অবশেষে মায়েরা তাদের মিশন পূর্ণ করে স্কুলে ফিরে আসে। সবার মুখে একই গল্প। কেউ মাহবুব সাহেবের চরিত্রের দোষারূপ করে। কেউবা সুজানার।
কেউ বলে স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তাই ভদ্রলোক হয়তো দ্বিতীয় বিয়ের পায়তারা করছেন।
কেউ বলে আদনানের মায়েরই বা দোষ কোথায়? স্বামী তার থেকেও নেই। তাই নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর চেষ্টা করছিল। আরেকদল বলে, আচ্ছা ধরলাম আদনানের মায়ের স্বামী নেই তাই তিনি স্বামী খুজছেন। কিন্তু মাহফুজের বাবার তো স্ত্রী আছে, সে কেন এ অপকর্মে লিপ্ত হলো।
একজন যুক্তি খ-ন করে বলে, ওই যে স্ত্রী অসুস্থ, সেই অজুহাতে আরেকটি বিয়ে। অন্যরাও সায় দিয়ে বলে, আসলে পুরুষজাতটাই এমন। স্বামী কুষ্ঠ রোগী হলেও স্ত্রীরা কোনোদিন পারে না স্বামীর অসুস্থতার অজুহাতে আরেকটি বিয়ে করতে। স্ত্রীদের জন্য এমন কথা চিন্তা করাও যেন পাপ। সমাজই তাকে বর্জন করবে।
অথচ অসুস্থতার অজুহাতে স্বামীরা যখন বিয়ে করে, সমাজ তখন অন্ধের ভূমিকা পালন করে। যেন এটাই স্বাভাবিক। কারো স্ত্রী যদি মারা যায় তাহলে তো আরো সোনায় সোহাগা। চল্লিশ দিন যেতে না যেতেই আবার বিয়ের সানাই বেজে ওঠে। প্রথম স্ত্রীর অলঙ্কার আর শাড়িতেই সম্পন্ন হয় বিয়ের কাজ।
অথচ স্বামী মরে গেলে একজন স্ত্রীকে দীর্ঘ চার মাস দশ দিন ইদ্দতকাল পালন করতে হয়। অর্থাৎ শোক পালন করতে হয়। অথচ এতো দীর্ঘ সময় পুরুষদের শোক পালন করতে হয় না। শোক শুধু নারীর জন্য। এভাবেই তর্কে বহুদূর এগিয়ে যান মাদাররা।
লজ্জার মাথা খেয়ে সুজানা এবং মাহবুব হসপিটালের বেডেই পড়ে থাকেন। তবে এখন আর ইমার্জেন্সিতে নয়, ক্যাবিনে। মাহবুব তার কোনো এক ডাক্তার বন্ধুর বদৌলতে ক্যাবিন পেয়েছেন। হসপিটালের ক্যাবিনে চলে তাদের মধুচন্দ্রিমা যাপন। এক সময় তারা বাড়ি ফেরার তাগিদ অনুভব করলেও লোকলজ্জা তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলে।
সুজানার তেমন একটা ভাবনা নেই। কারণ সে জানে তার অভিবাসী স্বামী সংবাদটি পেলেও বিশ্বাস করবে না। তবে মাহবুব বড় বেশি চিন্তিত। এবার ঘরে নিশ্চয়ই স্ত্রী তাকে জায়গা দেবে না।
এদিকে সুজানার শাশুড়ি-ননদ ব্যাপারটি তার স্বামীকে অবহিত করে।
কিন্তু সুজানার স্বামী সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে না। তিনি সুজানাকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেন। সুজানা এ ঘটনা অস্বীকার করলে তার স্বামী আজই দেশে ফিরছেন বলে জানান। সুজানার রোগগ্রস্ত মলিন চেহারাটা আজ অনেক বেশি সুন্দর দেখায়।
হঠাৎ এক ঝলক আলো যেন খেলা করে সুজানার চোখে-মুখে।
সুজানা মুখ ফুটে মাহবুবকে কিছু বলতো না। আজ দুজন দুজনার এতো কাছাকাছি যে নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যায়। সুজানার মুখ থেকে ভেসে আসে জলপাইয়ের আচারের মতো এক ধরনের নেশাযুক্ত গন্ধ। মাহবুব সুজানার স্পর্শিত ঠোটে চুমো খায়। সুজানা আজ আর কোনো বাধা দেয় না।
বরং চোখে-মুখে ফুটে ওঠে আত্মতৃপ্তির আভাস। সুজানা পরিতৃপ্তির সুরে বলে, মাহবুব, আমাদের আরো আগে কেন দেখা হলো না। মাহবুব সাহেব সুজানার শরীরে আদর করতে করতে বলেন, সুজানা চলো, আমরা কিছুদিন অজ্ঞাতবাসে চলে যাই।
সুজানা সরে গিয়ে বলে, না মাহবুব আজ আমার স্বামী আসবে। তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যাও।
[ গতকালের যায়যায়দিন 'আর্ট এন্ড কালচারে' লেখিকার ঝরঝরে ভাষা ও লেখনি সম্বলিত এই গল্পটি পড়ে বেশ ভালো লাগলো। ব্লগে তাই গল্পটি শেয়ার করলাম অন্যান্যদের সঙ্গে। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।