সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
দেরীতে হলেও বাংলাদেশে রঙ-ফর্সাকারী ক্রিম ফেয়ার এন্ড লাভলীর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ করার দাবি উঠেছে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসনের কাছে দাবি তোলা হয়েছে ত্বকের ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দিকটি বিবেচনা করে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের।
মার্চ মাসের (২০০৬) শেষ সপ্তাহে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ফেয়ার এন্ড লাভলি নামক রঙ-ফর্সাকারী ক্রিমের মূলত স্বাস্থ্যগত তির দিকটি ফোকাস করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পরপরই নারীগ্রন্থ প্রবর্তনাসহ বিভিন্ন নারী-সংগঠন, নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, জেন্ডার ইন মিডিয়া ফোরাম ফেয়ার এন্ড লাভলির বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি তোলে এবং সরকারকে আহ্বান জানায় প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ করতে। এই তৎপরতার মধ্যে দুইটি ঘটনা লক্ষ করার মতো: ক্রিমটির প্রস্তুতকারক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার জনকণ্ঠের প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পরদিন থেকেই পণ্যটি সম্পর্কিত নানা তথ্য হাজির করে দাবি করতে থাকে যে ক্রিমটিতে তিকারক কিছু নেই।
আর বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতার খবরাখবর, প্রেসরিলিজ অল্প কটি পত্রিকা ছাড়া সব মিডিয়াই ব্ল্যাকআউট করে, উল্টো ইউনিলিভারের দাবি গুরুত্বসহ ছাপে।
এই দুটি ঘটনাকে অন্তর্ভুক্ত করলে ফেয়ার এন্ড লাভলি ক্রিমটিকে ঘিরে আপাতত কয়েকটি ইস্যু সামনে চলে এসেছে: স্বাস্থ্য, নারীর প্রতি অবমাননা, বর্ণবাদ, বিজ্ঞাপনদাতার কাছে নতজানু সাংবাদিকতা, শক্তিধর বহুজাতিকের লাগাতার প্রতারণা ও মিথ্যাচার।
স্বাস্থ্য: চর্মরোগীরা ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখেন
জনকণ্ঠের প্রতিবেদনগুলোতে ফেয়ার এন্ড লাভলিসহ অন্যান্য রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের স্বাস্থ্যগত তির দিকটি বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। ডার্মাটোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, চর্মবিশেষজ্ঞ ডাক্তার সবাই বলেছেন মানুষের গায়ের রং ফর্সা করতে পারে এরকম কোনো কিছুই পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি। ডাক্তাররা অনেক সময় মেছতা বা অন্যান্য শারীরিক দাগের স্থানে অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য অয়েন্টমেন্ট দিয়ে থাকেন, যা ঐ স্থানের কালো ভাবটি দূর করে; কিন্তু স্বাভাবিক ত্বকে দীর্ঘসময় ধরে ঐরকম কেমিক্যালসমৃদ্ধ ক্রিম মাখলে ত্বকের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হবে এবং অতিবেগুনীসহ অন্যান্য তিকর রশ্মি প্রতিরোধমতা কমে যাবে, ফলত ত্বকে ক্যান্সারসহ অন্যান্য অনেক চর্মরোগ এবং কিডনির সমস্যা দেখা দেবে।
চর্মরোগের ডাক্তাররা এরকমও বলেছেন যে তাদের কাছে আসা নারীদের বেশিরভাগই ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখেন বলে স্বীকার করে থাকেন। জনকণ্ঠের রিপোর্টে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বিদেশী গবেষণার ফলাফলও উপস্থাপন করা হয়েছে।
'বিশ্বের এক নম্বর রঙ-ফর্সাকারী ক্রিম' ফেয়ার এন্ড লাভলি ত্বকের মেলানিন ছড়িয়ে পড়া রোধ করে, ফলে এটা নিয়মিত ব্যবহার করলে ত্বক ফর্সা হয়ে ওঠে বলে এর উৎপাদকরা এতোদিন দাবি করতো। কিন্তু এই মেলানিন ছড়িয়ে পড়া রোধ করা হলে ত্বকে কী প্রতিক্রিয়া হয় সে-সম্পর্কিত তথ্য তারা দেয় না। সত্য হলো, মেলানিন বেশি থাকলে ত্বকের রঙ কালো হয় এবং কম থাকলে ফর্সা হয়।
এটা একেবারে জৈবিক ব্যাপার, জিনগত ব্যাপার। এও সত্য যে কালো মানুষদের চর্মরোগ ফর্সাদের তুলনায় কম হয়ে থাকে। অথচ এই মেলানিনের বিকাশ রোধ করা অর্থ হলো চর্মরোগকে সেধে ডেকে আনা।
এইসব তথ্য জনকণ্ঠের প্রথম দিনের রিপোর্টে প্রকাশিত হবার পরদিনই ফেয়ার এন্ড লাভলি প্রায় সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায় 'বিশ্বের ১ নম্বর ফেয়ারনেস ক্রিমের ওপর আপনিও আস্থা রাখুন নিশ্চিন্তে'। এপর্যায়ে তারা সানস্ক্রিনকে ফেয়ার এন্ড লাভলির অন্যতম মূল উপাদান হিসেবে দাবি করতে থাকে।
এক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞদের মত হলো, অধিক সূর্যালোকে যাওয়ার আগে সাময়িকভাবে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা গেলেও রঙ ফর্সা করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সানস্ক্রিন ব্যবহারের কোনো ভিত্তি নেই। বরং একাধারে দীর্ঘ সময় সানস্ক্রিন ব্যবহারে ত্বকের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ মতা কমে যায়। ফলে 'মেলানোমা' জাতীয় মারাত্মক স্কিন ক্যান্সার হতে পারে। অন্যদিকে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমে অপরিকল্পিতভাবে হাইড্রোকুইনন জাতীয় উপাদান ব্যবহার করা হয়, এর ফলে ব্যবহারকারী নারীদের কিডনির নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।
বিয়ে ও চাকরিতে ফেয়ার এন্ড লাভলি
ফেয়ার এন্ড লাভলি কেবল শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই তিকর নয়, সামাজিক স্বাস্থ্যও নষ্ট করে দিচ্ছে।
রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের ধারণাটিই নারীর জন্য অবমাননাকর। বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখা যায় কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, চাকরি জুটছে না, পরিবারে ছেলের অভাব সে পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। সে ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখলো, মাত্র চার থেকে ছ সপ্তাহের মধ্যে ফর্সা হয়ে উঠলোÑ ব্যস পাত্র বিয়ে করতে চাইলো 'এক্ষুণি', বিমানবালার মতো মোটা বেতনের চাকরি নিমেষেই জুটে গেল, ছেলের অভাব পূরণ হয়ে গেল। নারীর চাকরি হচ্ছে তার যোগ্যতায় নয়, সাদা রঙের কারণে। সাদা হওয়া ও সুন্দর হওয়াকে এক করে ফেলা হচ্ছে।
তাহলে অশ্বেতাঙ্গদের এই দেশে যে কালো মেয়ের সংখ্যাই বেশি, এতো এতো মেয়ের চাকরি-বাকরি-বিয়ে হবে না? বিজ্ঞাপন বলছে, হবে নাÑ অন্তঃত ফেয়ার এন্ড লাভলি না-মাখা পর্যন্ত হচ্ছে না। এই বিজ্ঞাপন কালো মেয়েদের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি করছে, আর সাদাদের দিচ্ছে নির্ভারবোধের মুক্তি। এভাবেই সামাজিক স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। এই বর্ণবাদ গোরা সাহেবদের প্ররোচনায় আমাদের মর্মমূলে গেঁথে গিয়েছিলো। আজ এতো বছর পরেও সেই বর্ণবাদ সুপ্ত রয়েছে উপমহাদেশের মানুষদের মনে।
আর ফেয়ার এন্ড লাভলি সেই বর্ণবাদকেই উস্কে দিচ্ছে, বাড়িয়ে তুলছে।
'আমরা তো ইউনিলিভারের প্রেসবিজ্ঞপ্তি ছেপেছি'
বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে সাংবাদিকতা কতখানি নতজানু হয়ে রয়েছে তার টাটকা উদাহরণ হলো এদেশের পত্রিকাগুলো ফেয়ার এন্ড লাভলির প্রতারণার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদের খবর না ছেপে উল্টো ফেয়ার এন্ড লাভলির অনুকূলে যায়, এরকম প্রেসরিলিজ ছাপানোর ঘটনাটি। আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রচুর কথা বলি, সরকারের নিয়ন্ত্রণ-হুমকি-ধামকির বিরুদ্ধে কথা বলি, সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলিÑ অর্থাৎ কারও কারও কাছ থেকে আমরা স্বাধীনতা চাই। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে আমরা স্বাধীনতা চাই না, তার পদলেহন করে আরও বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তির পথ প্রশস্ত রাখতে চাই। নারী সংগঠন, জেন্ডার ইন মিডিয়া ফোরামের খবরাখবর কেবল জনকণ্ঠ, অবজারভার ও আমাদের সময়Ñ এই তিনটি পত্রিকা ছেপেছে।
জেন্ডার ইন মিডিয়া ফোরামের সদস্য ওমর তারেক চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যাচ্ছে:
''সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগের কারণ, ফেয়ার এন্ড লাভলি নিয়ে প্রতিবাদকারী সংশ্লিষ্ট সকলের অভিজ্ঞতা হচ্ছে তাদের সংবাদ প্রকাশ না হওয়া সম্পর্কে তারা বিভিন্ন সংবাদপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে ধারণা পেয়েছেন যে, এই বিষয়ে সংবাদপত্রগুলো কোনো বিরুদ্ধমত প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। এমনকি নারীর প্রতি সহিংসতা, মাদকাসক্তি ইত্যাদির মতো সামাজিক ইস্যুতে সক্রিয় একটি দৈনিক থেকে হাস্যকরভাবে বলা হয়েছে যে, 'আমরা তো ইউনিলিভার কোম্পানির প্রেসবিজ্ঞপ্তি ছেপেছি, ওরা বলেছে ফেয়ার এন্ড লাভলি নিরাপদ'। ''
আসলে প্রচারমাধ্যমগুলোর আয়ের প্রধান যোগানদাতা হলো সেলফোন-কোম্পানি, ইউনিলিভারের মতো কয়েকটি কোম্পানি। তাই 'বড়ো' পত্রিকাগুলোর পক্ষে এদের বিরোধী কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। অপোকৃত 'ছোট' পত্রিকাগুলো বরং এেেত্র অনেক সাহসী।
ভারতে ফেয়ার এন্ড লাভলির বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে, বাংলাদেশে নয় কেন?
ভারতে ২০০৩ সালেই অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ওমেন্স এসোসিয়েশন-এর আন্দোলনের পরিপ্রেেিত নারীর জন্য অবমাননাকর বিমানবালার বিজ্ঞাপনটি প্রচার বন্ধ হয়েছে। হিন্দুস্তান লিভারের কর্মকর্তা তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, 'একটি দায়িত্বশীল কোম্পানি হিসেবে আমরা ঐসব আপত্তিকে গ্রহণ করেছি এবং সেমতো পদপে নেবো'। তাহলে বাংলাদেশের ইউনিলিভার কেন আজকের আপত্তিকে গ্রহণ করবে না? এর কারণ সম্ভবত এই যে, আমরা ভারতের মতো আপত্তিটা এখনও জোরালো করে তুলতে পারিনি। কেবল জনগণের দিক থেকে নয়, সরকারের দিক থেকেও সেখানে এধরনের পণ্য ও তার বিজ্ঞাপনকে ঘিরে একধরনের সক্রিয় মনোভাব বিরাজ করে। বিজ্ঞাপনটি বন্ধ হবার আগে, ২৬ এপ্রিল ২০০২ সালের একটি সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে যে মহারাষ্ট্র স্টেট কমিশন ফর ওমেন প্রথম যে 'রোল অব ডিজঅনার' প্রদান করে তাতে নারীর জন্য সবচেয়ে অসংবেদনশীল বিজ্ঞাপন হিসেবে ফেয়ার এন্ড লাভলি পেয়েছিলো 'দুর্যোধন পুরস্কার'।
এখানে আমাদের জন্য কাজটা তাই আরও খানিকটা কঠিন। আমাদের আরও সংগঠিত হতে হবে, ক্রমাগত দাবি-আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়াজ তুলতে হবে: বন্ধ হোক আনফেয়ার এন্ড আগলি এই ক্রিমের বিজ্ঞাপন।
তথ্যসূত্র
জনকণ্ঠ রিপোর্ট, ২৯-৩১ মার্চ ২০০৬ ও ২ এপ্রিল ২০০৬; আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সম্পাদিত; ঢাকা।
চৌধুরী, ওমর তারেক; ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী আসলে আনফেয়ার এন্ড ডেডলি’; জনকণ্ঠ, ১৯ এপ্রিল ২০০৬; আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সম্পাদিত; ঢাকা।
Click This Link
Click This Link.
এপ্রিল ২১, ২০০৬।
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক সংবাদ, ৩০ এপ্রিল ২০০৬।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।