আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রাজুয়েশন পার্টির পর: বিদায়বেলায় বন্ধুদের জন্য



[আমার বন্ধুদের জন্য,আমার প্রিয় মুখগুলোর জন্য] এই প্রথমবার লিখতে গিয়ে লেখা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে,চিন্তাগুলো দৌড় দিয়েছে এদিক-সেদিক,ধরে আনতেও ইচ্ছা করছে না। মাথা না,বুকের ভিতরটাই তো ফাঁকা হয়ে গেছে। কার জন্য লিখবো,কিসের জন্যই বা? যাদের নিয়ে বাঁচতাম,সবাই চলে যাবে আজ থেকে,একটু দূরে,তারপর অনেক দূরে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পার হয়ে গেছি অনেকটা পথ একসাথে,ভুলেই গিয়েছিলাম একদিন পথ বেঁকে যাবে,অনেকদিকে। শেষবেলায় একটু আনন্দ করবো বলে গেলাম গ্রাজুয়েশন পার্টিতে,ফিরতে হলো কাঁদতে কাঁদতে।

ভিতরটা ৩ দিন ধরেই জ্বলছিলো,যেদিনটা থেকে বুয়েট থেকে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। চেপে ছিলাম,এত আনন্দ চারদিকে,হইহল্লা,খানাদানা,কনসার্ট,ছবি,নাচানাচি,হাত মেলানো,কাঁধ মেলানো আরো একবার,এর মাঝে বিষাদের জায়গাটাই কোথায়? শেষ মুহূর্তেও সবার মুখে হাসি,গেম শো টাও ভালই গেলো। কিন্তু গত ৫ বছরের ছবিগুলো দেখিয়ে সবার শেষ ছবিটা যখন গ্রে-স্কেলে ধূসর করে দিলো,ভেতরটাও যেন কেউ জ্বালিয়ে বর্ণহীন ছাইরংয়ে ঢেকে দিলো। কোন বদমাশের মাথায় যে শেষে "গুডবাই ব্যাচ ০২" লেখাটা এসেছিলো কে জানে,দেখামাত্র চোখে কিছু পড়ার অভিনয় করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রজেক্টরের আলোটা নিভে যেতেই এক অবাক দৃশ্য,খুব কঠিন মনের বলে ভেবে আসা ছেলেগুলোর চোখ ভেজা,একজনের,তার থেকে সবার,আমার,ওদের,তাদের।

ঐটুকু হলেও ভালো ছিলো,পরের পর্বটা খুব খারাপ,একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নার সমাবেশ। যে ছেলেটার সাথে হয়তো জীবনে ২-১ বারের বেশি কথাও বলিনি,সেই ছেলেটা যখন এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,ভালো থাকবি,দেখা হবে,কান্না কি খুব ছেলেমানুষি হয়ে যায়? একদফা কান্নাকাটি শেষে ভাবলাম,কেটেই পড়ি,যা ধরে রাখতে পারবো না তার জন্য মাথা নষ্ট করে কি লাভ? বের হয়ে এলাম ক্যাফে থেকে। যাওয়া হলোনা এত সহজে। চারদিকে কত কত প্রিয় মুখ,চেনা মুখ,আমার বন্ধুদের মুখ। ৫টা বছর ধরে এই একা মানুষটাকে দু'হাতে আগলে রেখেছে যারা,কিভাবে যাবো তাদের ছেড়ে? ক্লাস থেকে ক্যাফেতে যাবার পথে "আরে বেংস" বলে হুংকার শুনবো না ১০টা ছেলের,হাত বাড়িয়ে দেবে না আরো কতজন,ভাবতেই কেমন কেমন লাগে।

প্রথম যেদিন এসেছিলাম,নিতান্তই এক বাচ্চা ছেলে,স্কুল আর কলেজের বন্ধুরা অন্য ডিপার্টমেন্টে যাওয়াতে মন খারাপ একা এসে,শেষ এই দিনে মেলাতেই পারছিনা কিভাবে এক বিশাল পরিবারের অংশ হয়ে গেছি এইটুকু সময়ে,যাবার সময় মনে হচ্ছে নিজের ঘর,নিজের আত্মীয় ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছি,যাদের ছেড়ে নিজের অস্তিত্বের কথা কল্পনাও করটে পারতাম না গত কয়টা বছর। কতজনের কথা বলবো? চুলপাকা রাসেল,যাকে প্রথম দিনেই স্টেজে গলাবাজি করতে দেখে ভেবেছিলাম ব্যাটা ইঁচড়ে পাকা? রোকন নামের মোটা ছেলেটা,প্রথম দিনেই কাঁধে হাত রেখে কথা বলায় মনে মনে যাকে অসভ্য বলেই ধরে নিয়েছিলাম?রাহাত,হু,ভাব বেশি। মাশুক,রাশেদ,ইমতিয়াজ,সুযোগ পেলেই যাদের কাজ বাঁশ দেয়া? মামা হাফিজ? হাসান,যার আসল নাম হারিয়ে গেছে আক্কু মামা নামের আড়ালে? ডিসকো মোল্লা রিয়াল? সুমন মুনশি? আদনান,ফার্স্ট বয় হয়েও যার নাম হয়ে গেছে আদু ভাই? তালগাছের মত লম্বা মাহফুজ? নেতা রাসেল? রাজু? ব্যাড বয় সুরন্জ্ঞিত? রোমিও রোমেল? টাক্কু বরিশাইল্যা দোলন? গুড বয় সুপন আর মতিউর? অথবা মেকানিক্যালের মাজহার,জাহিদ,সামিন,ইলেকট্রিক্যালের সুমিত,রাজু আর পারী,আইপির জুবায়ের,ওয়াটারের বাদল,নাহ্,নাম তো শেষ হবেনা। ৫টা বছর,কম কথা তো না। বড় হয়েছি ৫ বছরে,বদলাইনি অবশ্য কেউই তেমন,কিন্তু বদলে গেছে আমাদের সম্পর্কের রেখা।

টুংটাং করে গিটারিস্ট হয়ে যাওয়া রাসেলের গান না শুনলে এখন ছুটির দিনটা কাটে না,মোটা রোকনের ঘাড়ে হাত না রেখে আমিই এখন আর হাঁটতে পারিনা,ক্যাফের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বিশালদেহী দীপের "ইয়ো মামা সিতা,মুহাহাহাহাহাহা" বলে বিকট হাসি না শুনলে সব নীরব লাগে। রাহাতের ভাব নিয়ে বলা "তুই আমার দেশী ভাইদের কলংক" শুনলেও স্বাভাবিকই লাগে,সুরনজিতের "তুই একটা চরম ফাউল পোলা" শুনে দাঁত বের করে হেসে নিজেকে আরেকটু ফাউল প্রমাণ করে দিই, মাশুকদের সাথে বাঁশ খাওয়া আর দেয়ার খেলাও নিত্যকার রুটিন হয়ে গেছে। কতবার মামা হাফিজ বলেছে আমার রুমে যাতে তুই না ঢুকিস সেজন্য ভাবছি ৩ তলায় ১টা নোটিশ কালকেই লাগাবো,সেই নোটিশ আর লাগেনি,৫টা বছর মনের আনন্দে সব ক'টা হল ঘুরে আড্ডা দিয়ে সবার পড়া নষ্ট করে গেছি। পরেরদিন সকালে পরীক্ষা বলে পড়তে গেছি,রুমে ঢুকেই মেহরাব আর আমিনের আর্জেন্টিনা খেলতে পারেনা শুনে পরীক্ষার খেতা পুড়ি বলে তর্কে নেমে বাকি রাত পার করে দিয়েছি। সমস্যা,বিপদ,ঝামেলা,শব্দগুলোর অস্তিত্ব খুব ১টা টের পাইনি যতদিন প্রিয় মুখগুলো চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে।

পরীক্ষা নিয়ে ঝামেলা? চিন্তা নাই,আমি পাস করলে তোকেও করাবো। টিউশনির পয়সা দিচ্ছেনা রে,বলতেই মানিব্যাগ থেকে বের করে দিলো কেউ একজন। বাসায় ঝগড়া করেছি,সমস্যা নাই,হলে থেকে যা ২-৪ দিন,ঠিক হয়ে যাবে। ছ্যাকাঁ খেয়েছিস? ব্যাপার না,কে না খায়? কিভাবে শোধ করবো এত ঋণ? কান্নায় ভেঙে পড়ে এদের কাঁধে মাথা রেখে আরেকবার মনে হলো,একটা শেকড় বোধহয় আমার এখানেও গেড়ে বসেছিল,এদের সবার মাঝে। ভাবছি।

অঝোর বৃষ্টি হচ্ছে। ছেলেগুলো ভিজছে বৃষ্টিতে,ভিজছি আমিও,দ্বিতীয় দফা কান্নাকাটি দেখছি,আর ভাবছি,অথবা ভাবছি না,শুধু দেখছি,জলে ভেজা আর কান্নায় ভেজা আপন মুখগুলো,আপনের চেয়েও আপন। অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যে ছেলেগুলো চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নিয়ে গেলো আমার কাছ থেকে,মুখগুলো চেনা,কিন্তু কতজনেরই তো নাম জানিনা। তবুও আপন। ভিজছি।

দেখছি। একটু দূরে কেমিক্যালের সোহান আসর জমিয়ে ফেলেছে,দরাজ গলায় চলছে "হায় চিল,হায় সোনালি ডানার চিল"। সোনালি স্বপ্ন নিয়ে আমরা ধূসর ডানার চিলেরা একটু পরেই উড়ে যাবো একটা জন্মকে পিছনে ফেলে। জীবনটাকে ঘুরিয়ে নিতে পারলে হয়তো আবার এখানে ফিরে আসতে চাইতাম,ঈশ্বরের কাছে স্বর্গ চেয়ে নেবার ক্ষমতা থাকলে সেখানেও এই বন্ধুর ভালোবাসা নিয়ে যেতাম,কিন্তু এখন উড়ে যাবো নতুন কোন জীবনে,একা,বন্ধুর হাতের রক্ষাকবচ ছাড়া। আমাকে কি বন্ধুরা মনে রাখবে? যদি কেউ রাখো,একবারের জন্য হলেও আমার নাম মনে পড়ে,আমার দরজায় একবার খটখট করে জিজ্ঞেস করো,বন্ধু কি বাড়ি আছ? আমার দরজা তোমাদের জন্য খোলা থাকবে,আমার হাত তোমাদের জন্য বাড়ানো থাকবে।

পুনশ্চ: লেখাটা লেখার সময় বারবারই চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে,ভাবনা হয়েছে এলোমেলো,বিদায়ের ১ দিন পরে যখন এক জুনিয়রকে শোনাচ্ছিলাম একের পর এক গল্প,বলেছে,ভাইয়া আপনি এখনো ঘোরের মাঝে আছেন। তা আছি,কখনো কাটবে কিনা,জানি না। ঘোরের মাঝে লেখা এলোমেলো কথাগুলোর মাঝে ভালো মানের কিছু খুঁজে না পেলে,ক্ষমাপ্রার্থী।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।