ধুলো থেকে আগমন আবার ধুলোতেই প্রত্যাবর্তন
আজ অনেকক্ষন রোদের ভেতর হাঁটলাম। ফাল্গুন মাসের রোদ, চৈত্র মাস আসি আসি করছে। নীলক্ষেত গিয়েছিলাম বই কিনতে। প্রখর রৌদ্র। রিক্শার ভেতর বসে থেকে মনে হচ্ছিল দোজখের ভেতর বসে আছি।
রাস্তার কঠিন পীচের ভেতর তরল তরল একটা ভাব চলে এসেছে। সদরঘাট থেকে ২০ টাকায় নীলক্ষেত ভাড়া করলাম কিন্তু রিক্শা ওয়ালার ঘামে ভেজা শরীর দেখে তাকে আরও ৪ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। জীবনের তাগিদে এদের এত প্রখর রৌদ্রে সক্ষম মানুষদের বহন করে নিয়ে চলতে হয়, শরীরের তেল পুড়িয়ে ডিজেল বানিয়ে রিকশার গতি ধরে রাখতে হয়!
সোজা চলে গেলাম ফ্রেন্ডস বুক কর্ণার। যেসব বই কিনলাম তার মোট দাম হল ৮০০ টাকা। বইগুলো কিনে দোকান থেকে বেড়িয়ে এলাম, ফুটপাথের উপর সাজানো বই থেকে সমরেশ মজুমদারের 'হৃদয়বতী' কিনলাম, কিনলাম হুমায়ূন আহমেদের 'লীলাবতী'।
সপ্তম শতকের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্য্যের একমাত্র কন্যার নাম লীলাবতী। মেয়েটির কপালে বৈধব্যযোগ-এই অজুহাতে কন্যা সম্প্রদানের আগে আগে বরপক্ষ মেয়েটির বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। লীলাবতী যখন গভীর দুঃখে কাঁদছিল তখন ভাস্করাচার্য্য বলেন, 'মাগো,তোমার জন্য কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই, তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহুযুগ তোমাকে মনে রাখে আমি সেই ব্যাবস্থা করছি। ' তিনি তাঁর বিখ্যাত গণিতের বইটির নাম দেন লীলাবতী।
নীলক্ষেতের একটা উপকারিতা রয়েছে-সস্তায় অনেক পুরোনো ও ভাল ভাল বই পাওয়া যায়।
কত লেখকের দীর্ঘ রাতজাগার ফসল পড়ে থাকে পায়ের কাছে, নিষ্প্রান বইয়ের পুরু মলাটের নীচে চাপা পড়ে থাকে কত মনের হাহাকার আর কত হৃদয়ের অতৃপ্ত, না বলা কথা। আমরা হাত বাড়ালেই পারি এইসব দিনরাত্রীর বহুযুগ ধরে চলে আসা চাপা ক্রন্দনে শামিল হতে, নিঃশ্বাস ফেলতে, কিন্তু অনেকেই চাইনা। সবার বুকেই বাজতে থাকে ভাঙ্গা রেকর্ড, " আমার জলেই টলমল করে আঁখি, তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি?"
দেখলাম জীবনান্দের 'কবিতা সমগ্র'। ১৪ কি ১৫ বছরের বই বিক্রেতাকে বললাম, 'কতরে এটা?'
'১৬০ টাকা'
'এত দাম? কম কত'
'একদাম ১০০ টাকা'
'৮০ টাকায় দিবি?'
'৮৫ টাকায় নিলে নেন' বলেই ছেলেটি বইখানা আবার জায়গামত রেখে দিল। আমি ফিরে যাবার ভাণ করে আবার এলাম।
ছেলেটি বলে উঠল,'৮৫ টাকায় বেঁচলে ৫ টাকা লাভ অইব। '
'দে, শুধুমাত্র জীবনানন্দ দাশ কে সন্মান করেই কিনছি, তোর লাভের জন্য না। জীবনানন্দ কে, জানিস তো?
'হ জানি, বিড়াট কবি। '
'তুইতো দেখি অনেক কিছু জানছ, বাড়ি কই তোর?'
'বরিশাল'
'খাইছে! তাইলে তো এই বই আমারে মাগনা দেওনের কথা, তুইতো জীবনানন্দের দেশের লোক!'
'হ, দ্যাশ খাইয়াতো আর পেট ভরব না। '
নীলক্ষেত থেকে ফিরে সদরঘাট নেমে দেখি ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে।
বাসায় গিয়ে খাওয়ার আগেই ভাবলাম একটা বারগার খেয়ে যাই। ১৮ টাকা নিল সেই জগতের নিকৃষ্টতম বারগারের দাম। হাকিমপুরী, শান্তি পুরী আর নুরানী জর্দা দিয়ে একটা পান খেলাম, সেটাও বিস্বাদ লাগতে লাগল। দোকানি বলল, এই বয়সে পান খাইলে দাঁত নষ্ট হইব। আমি বললাম, আমার দাঁত নষ্ট হইবনা, অভ্যাস আছে, আপনে পান দ্যান।
বাসায় এসে বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকলাম। উঠে দেখি ৪টা বাজে। এরপর শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে ১ ঘন্টা ভিজলাম, মাথার রগ দপদপানি সেরে গেল। এককাপ চা খেয়ে সতেজ হলাম। আচ্ছা কেউকি দেখেছে- চরম নিঃসঙ্গতায় গরম এক কাপ চা প্রানান্ত উষ্ণতা এনে দেয়? কেউ কি এ ব্যাপারটা খেয়াল করেছে যে যুগে যুগে চায়ের পেয়ালারা মানুষের ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে তাদেরকে সতেজ করে আসছে?
এভাবেই গেল আজকের দিনটি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে হাঁটতেই থাকি, অনন্তকাল ধরে হাঁটি। 'হাজার বছর ধরে' হাঁটার মত। আচ্ছা, হাঁটতে হাঁটতে পৃথিবী পার করে চলে যাওয়া যায়না? কেন পৃথিবী গোল হল? কেন নীরবে উদ্দেশ্যবিহীন এই জীবনের মোহময়তা কেটে যায় ? অনুভুতি গ্রহণ করার কোষগুলো ভোঁতা হয়ে যায় কেন অতি দ্রুত? আজ কেন আমার সেই হাল ভাঙ্গা,পথহারা নাবিক হতে বড় সাধ জাগছে!-
"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে;
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের মালয় সাগরে।
অনেক ঘুরেছি আমি বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে,
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রান এক; চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য্য; অতিদূর
সমুদ্রের' পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।
"
১৮.০৩.২০০৬
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।