হেথায় কিছু লিখব বলে চায় যে আমার মন, নাই বা লেখার থাকল প্রয়োজন!
ইফতার সম্পর্কিত একটি ঘটনা নিয়ে প্রণব ভট্টের একটি চমত্কার অসাম্প্রদায়িক মানবিক গল্প ...
গত কয়েক বছর পূজার ছুটিতে বাড়ি যাওয়া হয়নি দয়াময়ীর। এর মধ্যে তো টানা দু বছর সে দেশেই ছিল না। সে আর হেমন্ত এমএস করতে দেশের বাইরে গিয়েছিল। ওই পর্ব অবশ্য শেষ, তারা দেশে ফিরেছে। কিছুদিন তারা দেশে থাকবে।
তারপর পিএইচডি করার জন্য আবার বাইরে চলে যাবে। সুতরাং এ বছর যদি পূজার সময় বাড়ি যাওয়া না হয়, তাহলে বেশ কয়েক বছর আর যাওয়া হবে না। হেমন্তকে সে আগেই বলে রেখেছে, হেমন্তরও কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি না থাকার কারণও আছে। দয়ামীয়কে সে ভালোবাসে প্রচণ্ড।
এটা আপত্তি না করার পেছনে বড় একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণটিও কম বড় নয়, এ দেশে হেমন্তর কেউ নেই। সুতরাং পূজার সময়টা সে যদি দয়াময়ীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে কাটায়, সেটা বউ নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকার মতোই হবে।
পূজার সময় বাড়ি যাচ্ছে, এটা দয়াময়ীর ভেতরে উত্সাহ সৃষ্টি করেছে খুব। তার বাবা-মা দুজনই বেঁচে আছেন।
খুব বড় না হলেও বড় দাদা ওই শহরেই ব্যবসা করছেন। ঠিকাদারি। দু দিদি অবশ্য দু জায়গায় ছড়িয়ে। দেশে ফিরে যাদের সঙ্গে কথা বলেছে দয়াময়ী, তারাও বলেছে এবারের পূজায় তারাও যাবে। বহুদিন পর সবাই একসঙ্গে হলে কী যে মজা হবে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে!
তাদের দেশের বাড়ি সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায়।
একসময় বেশ কয়েক ঘর হিন্দুর বসবাস ছিল সেখানে। এখন নানা কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো যে কয়েক ঘর আছে, তারা খুব জাঁকজমক আর হইচইয়ের সঙ্গেই পূজা করে। হয়তো সেটা ঠিক দয়াময়ীদের ছোটবেলার মতো হয় না। যেটুকু হয়, তাতেও আনন্দ অনেক।
এই আনন্দের মধ্যে একটু খচখচানি শুধু থাকে - ছোটবেলার সব বন্ধুকে যদি একসঙ্গে পাওয়া যেত, সবার সঙ্গে যদি দেখা হতো!
হেমন্ত তাকে বলে, ‘খামোখা একটা আশা করলেই হবে না, সব পুরনো বন্ধুকে তুমি কী করে পাবে!’
‘পাব না। আমি জানি। ’ দয়াময়ী বলে, ‘কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে। ’
হেমন্ত হাসে।
‘হেসো না।
আমার কী মনে হয়, জানো?’ দয়াময়ী বলে, ‘আমার মনে হয় গেলাম বাড়িতে, শিমুলতলীতে, আর দেখলাম ছোটবেলার সব বন্ধু এসে হাজির। অঞ্জু, বীণা, জাহেদা, সালমা, আফরোজা, বেলী, নাগমা, শ্যামলী, সুমিত্রা ... আরো কত কে!’
‘ওদের অনেকের সঙ্গে তোমার হয়তো আর কোনো দিন দেখা হবে না!’ হেমন্ত বলে।
‘কীভাবে হবে?’ দয়াময়ী জানায়, ‘ওদের অনেকে এখন দেশেই নেই। কেউ কেউ বিয়ের পর কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে কিছুই জানি না! তবে কেউ কেউ তো এখনো আছে, তাই না?’
‘আর তাদের সঙ্গে দেখা হলে কী মজাটাই না হয়!’ হেমন্ত দয়াময়ীর মতো করে বলে।
দয়াময়ী সেটা বুঝতে পারে, ঠোঁট টিপে হাসে, ‘সেটা তুমি বুঝবে কী! শেষবার যখন গেলাম, পুরনো বন্ধু অনেকের সঙ্গে দেখা তো হলোই, লাইজু আপার সঙ্গেও দেখা হলো।
স্কুলে আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। আর কী ভালোই না বাসতেন আমাকে! পথে আমার সঙ্গে দেখা। আমাকে একদম জড়িয়ে ধরে বললেন - আরে ময়ী, তুই এত বড় হয়ে গেছিস! বলো, তখন কত ভালো লাগে!’
‘সে নাহয় বুঝলাম। ’ হেমন্ত কৃত্রিম গম্ভীর গলায় বলে, ‘কিন্তু আমি ছাড়াও কেউ কেউ তোমাকে ময়ী বলে ডাকে, একি কথা, অঁ্যা!’
‘ডাকে, ডাকে। ’ দয়াময়ী হাসে, ‘কেউ কেউ কিন্তু শুধু দয়া বলেও ডাকে।
আমার নামটা বড় আর পুরনো ধরনের। তাই ছোট করে দয়া বা ময়ী, বুঝেছ?’
‘বুঝলাম। ভালো। তবে আমার জন্য আর কিছুই থাকল না। দেখা গেল এবার শিমুলতলীতে গিয়ে তুমি আর ফিরলেই না।
যারা তোমাকে দয়া বা ময়ী বলে ডাকত, তারা তোমাকে রেখে দিল!’
‘তুমি ছাড়িয়ে আনবে। তুমি আছ কেন!’
‘তাও বটে। ’
‘শোনো, আগেভাগেই একটা কথা বলে রাখি। এবার কিন্তু শিমুলতলীতে গিয়ে খুব ঘুরব আমি। বন্ধুদের বাসায় যাব।
আপাদের বাসায় যাব। লাইজু আপা, রেখা আপা, ওহাব স্যার ...’
‘তোমার জাহানারা আপার বাসায় যাবে না?’
‘কী বললে!’ দয়াময়ী তখনই কঠিন চোখে হেমন্তর দিকে তাকায়। দেখে, হেমন্তর মুখে ফিচকে হাসি। তাকে অমন চোখে তাকাতে দেখে হেমন্তর ফিচকে হাসিটা একটু একটু করে মিলিয়ে যায়। সে গম্ভীর মুখে নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আমি বলছিলাম, তোমার জাহানারা আপার বাসায় যাবে না?’
‘তোমাকে না বলেছি, ওই মহিলার কথা তুমি কখনো আমার সামনে তুলবে না!’
‘কিন্তু তিনি তো তোমার হেডমিস্ট্রেস ছিলেন।
’
‘থাকুক। ’
‘শোনো। ’ হেমন্তকে সিরিয়াস দেখায়, ‘তোমাকে কথাটা আরেকবার বলি। ওই ভদ্রমহিলা সম্পর্কে তুমি আমাকে অনেক কিছুই বলেছ। কিন্তু আমি আমার যুক্তি দিয়ে ওনাকে তোমার মতো করে দেখতে পারিনি।
কোথাও তোমার একটা ভুল ...’
‘আমার ভুল নেই কোথাও। ওই মহিলা আমাকে স্কুলে পড়ার সময় অনেক জ্বালিয়েছেন। ’ দয়াময়ী গম্ভীর চোখে তাকায়, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করি তিনি আমাকে শুধু ছাত্রী হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন হিন্দুছাত্রী হিসেবে। ’ ...
চলবে ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।