চাঁদটা গোল হলেই গোল বাধে ভেতরে...!!!
লটারি--৩য় পর্ব
মূল: মুনশি প্রেমচাঁদ
রূপান্তর(মূল হিন্দি থেকে): মোসতাকিম রাহী
........
আমি বিক্রমের দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলাম। সে আমার ইশারা বুঝতে পারলো। চোখেচোখে দু’জনে পরামর্শ করে নিলাম। বিক্রম কুন্তিকে বললো,‘আচ্ছা তোকে একটা কথা বললে কাউকে বলবি নাতো? না না, তুই খুব লক্ষ্মী মেয়ে, আমি জানি তুই কাউকে বলবি না। এখন থেকে আমি তোকে ভালো মতো পড়াবো, এবার তুই ঠিকই পাশ করতে পারবি।
আসলে হয়েছে কী, আমরা দু’জনেও একটা লটারি কিনেছি। তুই ঈশ্বরের কাছে আমাদের জন্যেও একটু প্রার্থনা করিস, বোন। যদি লটারি পেয়ে যাই তাহলে তোকে সুন্দর সুন্দর গয়না গড়িয়ে দেবো। সত্যি বলছি!’
কিন্তু কুন্তি বিশ্বাস করলো না বিক্রমের কথা। আমরা দু’জনে শপথ করলাম।
তারপরও সে শয়তানি করতে লাগলো। শেষমেশ কসম খেয়ে যখন বললাম তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা আর হিরে দিয়ে মুড়ে দেবো, তখন সে রাজি হলো আমাদের জন্যে প্রার্থনা করতে।
কিন্তু তার পেটে যে এই সামান্য কথা হজম হবে না সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। সে সোজা ভেতরে গিয়ে কথাটা মুহূর্তের মধ্যে রাষ্ট্র করে দিলো। শুরু হলো বকাবকি।
মা-বাবা-চাচি যে-ই সামনে পাচ্ছে সে-ই দিচ্ছে বকুনি: কী দরকার ছিলো টাকা খরচ করার? নিশ্চয়ই মাস্টার এই বুদ্ধি দিয়েছে! এতোগুলো টাকা পানিতে ফেলে দিলি! বাড়িতে কতোজনে টিকেট কিনেছে, তোর কী প্রয়োজন ছিলো কেনার! ওরা পুরস্কার পেলে সেখান থেকে কি তোকে ভাগ দিতো না!
এরপর শুরু হলো আমাকে ধোলাই:‘আর তুমিও মাস্টার, একটা অপদার্থ! ছেলেমেয়েদের ভালো কিছু শেখাবে কি, উল্টো তাদের কুমন্ত্রনা দিচ্ছো!’
বিক্রম আদরের ছেলে, তাকে বেশি আর কী বলবে! রাগ করে দু’-এক বেলা খাওয়া বন্ধ করে দিলেই সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে, উল্টো তাকে সাধাসাধি করতে করতে সবার জান বেরিয়ে যাবে। সবার রাগ এসে পড়লো আমার ওপর। ‘এই মাস্টারের সহচর্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা!’ সবাই রায় ঘোষণা করলো।
ছোটোবেলার একটা ঘটনা মনে পড়লো আমার। আমিও বিক্রমের মতো কৌশল অবলম্বন করে একবার বেঁচে গেছিলাম মারের হাত থেকে।
সেবার দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে একটা মদের বোতল আনা হয়েছিলো বাড়িতে। মামু অই সময় বেড়াতে এসেছিলেন আমাদের ওখানে। আমি করলাম কী, চুপিচুপি ভাঁড়াড়ে ঢুকে একটা গেলাসে করে কিছুটা শরাব নিয়ে খেয়ে ফেললাম। গলা জ্বলতে শুরু করলো, আর চোখ হয়ে গেলো টকটকে লাল। এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে মামু এসে হাজির হলেন।
ধরে ফেললেন হাতেনাতে। আর এতোটা রেগে গেলেন তিনি যে, ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে গেলো। মা-বাবা সবাই মিলে বকাবকি শুরু করলেন। ভয়ে যখন আমি কাঁদতে শুরু করলাম, তারা শান্ত হলেন।
আর সেদিন দুপুরে মামু বেহেড মাতাল হয়ে গান গাইতে লাগলেন।
এরপর শুরু হলো হলো মড়াকান্না, তারপর মাকে গালাগালি করলেন, আর দৌড়ে দাদুকে গেলেন মারতে । শেষে বমি করতে করতে একসময় মাটিতে পড়ে গেলেন অজ্ঞান হয়ে।
বিক্রমের বাবা বড়ো ঠাকুর সাহেব এবং চাচা ছোটো ঠাকুর সাহেব দু’জনেই ছিলেন জড়বাদী। পূজা-অর্চনায় তাঁদের কোনো আগ্রহ ছিলো না, বরং হাসি তামাশা করতেন তা নিয়ে: পুরোপুরি নাস্তিক। কিন্তু এখন দেখলাম দু’জনেই খুব ঈশ্বর ভক্ত হয়ে উঠেছেন।
বড়ো ঠাকুর সাহেব তো সকালে উঠেই চলে যান গঙ্গাস্নান করতে। আর পুরোটা সকাল মন্দিরে কাটিয়ে দুপুরবেলা সারা শরীরে চন্দন ঘষে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আর ছোটো ঠাকুর তো গরমজলে স্নান করার সময়ও রামনাম জপতে থাকেন। এরপর চলে যান পার্কে, সেখানে গিয়ে চড়ুই-কবুতরদের দানা খাওয়ান পরম আদরে।
সন্ধ্যার সময় দু’ভাই বাড়ি ফিরে চলে যান ঠাকুরঘরে।
তারপর প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত শোনেন ভগবত গীতার শ্লোক। বিক্রমের বড়ো ভাই প্রকাশ সাধু-সন্ন্যাসীদের ওপর অগাধ আস্থা রাখে। প্রায়ই চলে যায় সে তাদের আস্তানায়, মঠে। সেখানকার ধুলোময়লা সাফ করে, আর দেবী মায়ের সেবায় লেগে থাকে সবসময়।
লোকে বলে লোভ-লালসা ভালো নয়,পাপ; কিন্তু আমার মনে হয় এই যে আমরা ধর্মকর্ম করছি, দেবদেবীর পূজা করছি, ব্রত পালন করছি, সবকিছুই কিছু না কিছু পাওয়ার লোভে।
আমাদের ধর্ম, আমাদের বিশ্বাস টিকে আছে স্বার্থসিদ্ধির গোপন আখাক্সক্ষার ওপর।
লোভ যে মানুষের চরিত্র, মন-মানসিকতা আমূল বদলে দিতে পারে, এটা আমার জন্যে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।
আস্তে-আস্তে যতোই লটারির ফলাফল ঘোষণার দিন ঘনিয়ে আসতো লাগলো ততোই আমাদের মানসিক শান্তি উবে যেতে লাগলো। সারাক্ষণ ঐ চিন্তায় শুধু মাথায় ঘোরে। মাঝেমাঝে নিজের ওপর আমার অকারণে রাগ হতে থাকলো যে, বিক্রম যদি আমাকে লটারির ভাগের টাকা না দেয় তাহলে আমি কী করবো! যদি সে অস্বীকার করে যে লটারিতে আমার কোনো ভাগ নেই, তাহলে? আমার কাছে তো কোনো সাক্ষীসাবুদ, প্রমাণপত্র কিছু নেই।
সবকিছু নির্ভর করছে বিক্রমের মর্জির ওপর। ওর মনে যদি বদ মতলব থাকে তাহলেই সেরেছে! কিছুতেই আমি দাবি করতে পারবো না যে, লটারিতে আমারও ভাগ আছে। টুঁ শব্দও করতে পারবো না, করলেও কোনো লাভ হবে না। যদি তার মনে কুমতলব থাকে তাহলে সেটা এখনই বোঝা যাবে, আর যদি তা না থাকে তবে আমার সংকীর্ণতার কথা জানতে পেরে খুব আঘাত পাবে।
আমি জানি, বিক্রম মোটেও এরকম নয়; কিন্তু ধনদৌলত হাতে এলে ক’জনাই বা ঈমান ঠিক রাখতে পারে! এখনো তো টাকা হাতে আসে নি, ঈমানদার সাজতে অসুবিধে কী! পরীক্ষার সময় তো আসবে তখন,যখন দশলাখ টাকা হাতে আসবে।
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, যদি টিকেট আমার নামে হতো, তাহলে আমি কি বিক্রম কে এতো সহজে পাঁচলাখ টাকা দিয়ে দিতাম? হয়তো বলতাম, ‘তুমি আমাকে পাঁচটাকা ধার দিয়েছিলে, তার বদলে দশটাকা নাও, একশো টাকা নাও, আর কী করবে!’
কিন্তু না, এরকম অমানুষ আমি হতে পারবো না।
পরদিন আমরা পত্রিকা দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বিক্রম বললো, ‘যদি সত্যি সত্যি এখন লটারির পুরস্কারটা আমাদের নামে ওঠে, তাহলে আমার আফসোস হবে এই ভেবে যে, কেন শুধু শধু তোমার সাথে মিলে টিকেট কিনলাম!’ মুচকি হেসে সরল ভাবে কথাটা সে বললো। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, এটা তার মনের প্রকৃত ছবি, যা দুষ্টুমির আড়ালে লুকাতে চাইছে সে।
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘সত্যি! কিন্তু এই একই রকম অনুভূতি তো আমারও হতে পারে!’
‘কিন্তু টিকেট তো আমার নামে নেওয়া হয়েছে।
’
‘তাতে কী?’
‘মনে করো, তুমিও যে টিকেটর ভাগিদার সেটা আমি অস্বীকার করলাম!’
মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার। দু’চোখে আঁধার দেখলাম।
‘কিন্তু আমি তোমাকে বদলোক মনে করি না,’ ফ্যাকাসে হেসে বললাম।
‘ঠিক, কিন্তু শয়তান সওয়ার হতে কতোক্ষণ! ভেবে দেখো, পাঁচলাখ! খুব কম টাকা নয় কিন্তু! মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। ’
‘তো ঠিক আছে, এখনো সময় আছে, লেখাজোকা করে নিলেই হয়! আর কোনো সংশয় থাকবে না।
’
বিক্রম হেসে বললো,‘তুমি বড়ো সন্দেহ বাতিক লোক,দোস্ত। আমি তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। আমি কি কখনো তোমাকে ধোঁকা দিতে পারি! পাঁচলাখ কেন, পাঁচকোটি টাকাও যদি হয়্, আমার মনে কখনো খারাপি আসবে না, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকো। ’
(ক্রমশ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।