আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেমচাঁদের গল্প--লটারি--১

চাঁদটা গোল হলেই গোল বাধে ভেতরে...!!!

আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের জনক মুনশি প্রেমচাঁদের 'লটারি' গল্পটি বাংলায় রূপান্তর করেছিলাম মূল হিন্দি থেকে। প্রকাশিত হয় 'আজকের কাগজ'এর সাহিত্যসাময়িকী 'সুবর্ণরেখা'তে। ........ সংক্ষেপে প্রেমচাঁদ: প্রেমচাঁদের আসল নাম ধনপত রায় শ্রীবাস্তব। আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম এই কথাশিল্পী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালের ৩১ জুলাই অবিভক্ত ভারতের বারাণসী জেলার লমহী গ্রামে। উর্দু ভাষায় তাঁর সাহিত্যের হাতে খড়ি, তখন তিনি ‘নবাব রায়’ ছদ্মনামে লিখতেন।

১৯০৭ সালে যখন বৃটিশ সরকার কতৃক তাঁর ‘সজ-এ-বতন’ গল্প সংকলনটি নিষিদ্ধ করা হয়, এবং এর সবকগুলো কপি জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন থেকে তিনি ‘মুনশি প্রেমচাঁদ’ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন এবং এই নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অতি অল্প বয়সে প্রেমচাঁদের মা-বাবা মারা যান, ফলে শৈশব কাটে তাঁর দারুণ দারিদ্র্যের মাঝে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। তারপর গ্রামের সরকারি স্কুলে মাসে ১৮ রুপি বেতনে চাকরি নেন। পরে সাব-ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে শিক্ষা বিভাগে কাজ করেন।

১৯২১ সালে গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেন। এরপর একটি ছাপাখানা খোলেন, এবং নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ‘হংস’ নামক সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা ছিলো- গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, চিত্রনাট্য কোনো কিছুই বাদ যায় নি। দুইযুগের সাহিত্যিক জীবনে লেখা প্রায় তিনশো ছোটো গল্প আট খন্ডে ‘মানসরোবর’ নামে প্রকাশিত হয়। তাঁর তেরোটি উপন্যাসের মধ্যে ‘গো-দান’, ‘রঙ্গভূমি’, ‘সেবাসদন’, ‘কর্মভূমি’, ইত্যাদি বিখ্যাত।

প্রেমচাঁদ তাঁর গল্পে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করতেন। যে-কারণে চরিত্র অনুযায়ী উর্দু এবং ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখা যায় তাঁর গল্পে। গি দ্য মপাসাঁ’র গল্পের মতোই সমাজের সবশ্রেণির, সব পেশার মানুুষের কথা উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায় তাঁর গল্প এবং উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৩৬ সালের ১৮ অক্টোবর পরলোক গমন করেন এই কালজয়ী সাহিত্যিক।

......... তাড়াতাড়ি বড়োলোক হতে কে না চায়? আমাদের এখানে যখন প্রথম লটারির টিকেট বিক্রি শুরু হয় তখন আমার বন্ধু বিক্রমের বাবা-মা,চাচা এবং বড়ো ভাই প্রত্যেকে একটা করে টিকেট কেনে। কে জানে কার ভাগ্য খুলে যায়! কারো নামে যদি লটারি লাগে তো টাকাটা ঘরেই রইলো, এই ভেবে একাধিক টিকেট কেনা। কিন্তু ব্যাপারটা বিক্রমের সহ্য হলো না। অন্যদের নামে লটারি উঠলে তার কী লাভ? খুব বেশি হলে পাঁচ-দশ হাজার টাকা তার হাতে ধরিয়ে দেবে, এই-ই তো! কিন্তু এতো অল্প টাকায় তার কী হবে! তার চায় অঢেল টাকা! জীবনের রঙ-রস উপভোগ করার অনেক স্বপ্ন তার, অনেক পরিকল্পনা আছে। সে সারা পৃথিবীত ঘুরে বেড়াতে চায়,একেবারে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত।

পেরু, ব্রাজিল, টিম্বাকটু, হনলুলু এসব জায়গায় যাওয়ার খুব শখ তার। তাও কোথাও গিয়ে দু-একমাস থেকে ফিরে আসা নয়, যেখানেই যাবে লম্বা সময় সেখানে থেকে সেখানকার সংস্কৃতি, রীতি-নীতি পর্যবেক্ষণ করবে। কারণ, বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাপনের ওপর বৃহদাকার একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে তার। বড়ো একটা লাইব্রেরি খোলার ইচ্ছেও তার আছে, যেখানে থাকবে পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের বই। প্রয়োজনে দু’লাখ টাকা খরচ করবে সে লাইব্রেরির জন্যে।

বাংলো, গাড়ি আর ফার্নিচারের কথাতো বলাই বাহুল্য! বাপ-চাচা কারো নামে লটারি লাগলে পাঁচ হাজারের বেশি পাওয়া যাবে না। মায়ের নামে যদি ওঠে হয়তো বিশ হাজার টাকা তিনি দেবেন। কিন্তু বড়ো ভায়ের নামে উঠলে যে এক কানা কড়িও পাওয়া যাবে না, এটা হলফ করে বলা যায়। খুব অভিমান হলো বিক্রমের। নিজের বাপ-ভায়ের কাছ থেকেও সাহায্য কিংবা দান-খয়রাত হিসেবে কিছু নেওয়া তার কাছে অপমানজনক মনে হলো।

কথায় আছে, কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে কুয়োর পানিতে ডুবে মরা অনেক ভালো। কেউ যদি সংসারে নিজের স্থান তৈরি করতে না পারে, তো সংসার ত্যাগ করা-ই তার উচিৎ। বিক্রম বেকার মানুষ, লটারির টিকেট কেনার জন্যে কে ওকে টাকা দেবে! অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে আমাকে বললো, ‘আচ্ছা আমরা দু’জনে মিলে লটারির টিকেট কিনলে কেমন হয়?’ ওর প্রস্তাব আমার পছন্দ হলো। আমি তখন একটা স্কুলে মাস্টারি করি। মাসে বিশ টাকা মাইনে পাই।

কোনোমতে খেয়েপরে দিন যাপন করি। আমার মতো মানুষের দশটাকা খরচ করে লটারির টিকেট কেনা আর হাতি কেনা একই কথা। হ্যাঁ, লটারি পেয়ে গেলে সেই টাকা কোথাও খাটিয়ে কিংবা ব্যাংকে রেখে নিশ্চিন্তে খাওয়া-পরা চলতে পারে। মাসে চার হাজার টাকা যদি আসে, জনের ভাগে দুই হাজার করে মন্দ নয়। বিক্রমকে বললাম, ‘আমারতো মনে হয় দু’হাজার টাকায় তুমি আরামসে চলতে পারবে।

উত্তেজিত হয়ে বিক্রম বললো,‘ ভিখারির মতো আমি থাকতে পারবো না, আমি রাজার হালে থাকতে চাই। ’ ‘দু’হাজার টাকায় সেটা তুমি সহজেই পারো। ’ ‘কিন্তু তুমি তোমার হিস্যা থেকে আমাকে দু’লাখ টাকা না দিলে আমি তো লাইব্রেরি বানাতে পারবো না। ’ ‘এটাতো অপরিহার্য নয় যে, তোমাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে লাইব্রেরি বানাতে হবে। ’ ‘আমার লাইব্রেরিকে অবশ্যই অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে হবে।

’ ‘এটা তুমি দাবি করতে পারো। কিন্তু আমার ভাগের টাকা থেকে তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারবো না। আমার প্রয়োজনটা দেখো, তোমাদের অনেক সয়-সম্পত্তি আছে। তোমার ওপর তেমন কোনো দায়িত্বও নেই। কিন্তু আমার ওপর পুরো সংসারের বোঝা।

দুই বোনের বিয়ে দিতে হবে, ভাইদের লেখাপড়া করাতে হবে। একটা বাড়ি তৈরি করতে হবে। আমিতো টাকাগুলো সোজা ব্যাংকে রেখে দেবো। তা থেকে যা সুদ আসবে সেটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবো। এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেবো, যাতে আমার অবর্তমানে কেউ অই টাকায় হাত লাগাতে না পারে।

’ বিক্রম সহানুভুতির সুরে বললো,‘ ঠিক বলেছো, এই অবস্থায় তোমার কাছ থেকে কিছু চাওয়াটা অন্যায়। যাক, আমিই কোনো একটা ব্যবস্থা করে নেবো। কিন্তু একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছো, ব্যাংকের সুদের হার তো আজকাল অনেক কমে গেছে। ’ আমরা বেশ কয়েকটা ব্যাংকে গিয়ে তালাশ করলাম। আসলেই সুদের হার খুব কম দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

শতকরা দু’-আড়াই টাকা সুদে টাকা ফেলে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারচেয়ে সুদে টাকা ঋণ দেওয়া শুরু করলে কেমন হয়? বিক্রমও সফরে যাবে না, দু’জন মিলে কারবার দাঁড় করে ফেলতে পারবো। কিছু অর্থ হাতে এসে গেলেই বিক্রম সফরে যাবে। লেনদেনের ব্যবসায় সুদও পাওয়া যাবে প্রচুর। কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত কারো জন্যে বিশ্বস্ত জামানত পাওয়া না যাবে, তাকে ঋণ দেওয়া হবে না।

সে যতো সম্মানী মানুষই হোক না কেন। অবশ্য এর চেয়ে সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ রেখে টাকা দিলে আরো ভালো হয়, কোনো খটকা থাকবে না। যাক, টাকা খাটানোর রাস্তা তো ঠিক হলো। এখন টিকেটে কার নাম থাকবে সেটা হলো কথা। বিক্রমের নাম থাকবে, নাকি আমার? বিক্রম তার নাম,লেখানোর আগ্রহ দেখালো।

যদি তার নাম না থাকে টিকেটই কিনবে না সে। কোনো উপায় না দেখে আমি মেনে নিলাম। কোনোরকম লেখাজোকা না করেই, যে-কারণে পরে আমার সমস্যা হয়েছিলো। শুরু হলো অপেক্ষার প্রহর গোনা, কবে টিকেট কিনবো! সকালে ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই আমার চোখ চলে যেতো ক্যালেন্ডারের পাতায়। বিক্রমের বাড়ি আর আমার বাড়ি ছিলো পাশাপাশি।

স্কুলে যাওয়ার সব খরচ বাঁচিয়ে পাঁচটাকা কোনোরকমে যোগাড় করা যায়। তারপরও ভাবতাম, যদি কিছু বাড়তি টাকা অন্য কোনোভাবে জোগাড় করা যেতো তাহলে খুবই ভালো হতো! বিক্রম বললো,‘আচ্ছা, আমার আঙটিটা বেচে দিলে কেমন হয়? বাড়িতে বলবো যে হারিয়ে গেছে!' (ক্রমশ...)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।