রাজনীতির একটা নিজস্ব ভাষা আছে। অবশ্যই সেই ভাষা হবে শালীনতাপূর্ণ ও ভদ্রোচিত। অন্যপক্ষকে তীব্র সমালোচনা করার সময় অথবা সংগ্রাম, বিদ্রোহ, বিপ্লবের ডাক দেওয়ার সময়ও শালীনতার সীমা সত্যিকারের সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতারা অতিক্রম করেন না। আমাদের দেশে কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাজনৈতিক নেতার দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টিকারী জ্বালাময়ী ভাষণ আমি শুনেছি। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অথবা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী।
ব্রিটিশ যুগে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর তেজোদীপ্ত বক্তৃতার হুবহু বিবরণ শুনেছি বাবার মুখ থেকে। এসব মহান নেতার কণ্ঠ ও আচরণে থাকে দৃঢ়তা অথবা প্রয়োজনে নমনীয়তাও থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত আচরণে ও ভাষা প্রয়োগে তাদের সব সময়ই বিনয়ী ভাব থাকে। বিনয়ও যে একটি শক্তি হতে পারে তা হয়তো আজকের অপরিপক্ব রাজনীতিবিদদের জানা নাও থাকতে পারে। অহেতুক দাম্ভিকতা ও অশোভন বাক্য মানুষকে কাছে টানে না, দূরে সরিয়ে দেয়।
এই বোধ ও উপলব্ধি বর্তমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের ক'জনের আছে।
বিনয়, ভদ্রতা, যুক্তিপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য উচ্চারণ প্রধান ধারা বুর্জোয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন খুবই বিরল। একে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতন বলা যেতে পারে। কিছু দিন আগে বিএনপি দলীয় দুই মহিলা সংসদ সদস্য সদস্যকক্ষে যে ধরনের অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন তা আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরাও কম যান না।
গত নব্বই দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংসদ সদস্যরা নারায়ণগঞ্জের নিষিদ্ধ পল্লী উচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংসদীয় বিতর্কের সময় পরস্পরের প্রতি যে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তা ছাপার অক্ষরে লেখা যায় না বলে পত্রিকাগুলো মন্তব্য করেছিল। কোনো কোনো সংবাদপত্র লিখেছিল, পার্লামেন্ট যেন অশ্লীলতার চর্চাকেন্দ্র। এতে আমাদের তথাকথিত মূলধারার রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত নেতা ও সংসদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মান পরিমাপ করা যায়। বড় নিচু মাপের সংস্কৃতি। দুর্ভাগ্য! এরাই আমাদের দেশের ভাগ্য বিধাতা!
অশ্লীলতার প্রকারভেদ আছে।
শুধু ছাপার অক্ষরে লেখার অযোগ্য অশ্লীল গালি ব্যবহার করাকেই অশ্লীল বললে সেটা বলা হলো না। হেফাজতে ইসলামের প্রধান শফী যখন তেঁতুল তত্ত্ব বর্ণনা করেন, সেটাও অশ্লীলতার উদাহরণ বটে। এসব হলো সরাসরি অশ্লীলতার উদাহরণ। এ ছাড়াও অতি দাম্ভিকতা অথবা অশোভন আক্রমণের ভাষাও অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়তে পারে। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
গত ২৬ আগস্ট এক সভায় পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী যে ভাষায় যে ধরনের কথা বলেছেন তাকে কোন পর্যায়ভুক্ত করা চলে? তিনি বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যারা হরতাল দেবে 'তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যা করতে হবে। ' ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে হরতাল আমিও সমর্থন করি না এবং এ ধরনের 'আদালত অমান্যকারী ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের' বিচার হওয়া দরকার। এ বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। কিন্তু একজন মন্ত্রী কীভাবে বলেন, 'বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যা করতে হবে। ' এ তো ফ্যাসিস্টদের ভাষা।
কেবল যৌনতা-সংশ্লিষ্ট ভাষাকেই অশ্লীল বলা হয় না, এ ধরনের কুরুচিসম্পন্ন ফ্যাসিবাদী দাম্ভিকতাযুক্ত ভাষাকেও অশ্লীল বলা চলে। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী আরও বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে অধ্যাপক ইউনূসকে 'এতদিন জেলে থাকতে হতো'। ভাগ্যিস তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি! তাহলে দেশের জন্য বারোটা বাজার আর যতটুকু বাকি ছিল তা পূর্ণ হতো। মিথ্যাচার, দাম্ভিকতা ও সন্ত্রাস_ এই তিনটি হচ্ছে ফ্যাসিবাদীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জলজ্যান্ত মিথ্যাচারও তিনি করছেন।
তার নিজের ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে রাজাকার আখ্যায়িত করতে তার বাধেনি। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরও কাদের সিদ্দিকীকে একইভাবে চিত্রিত করতে চেয়েছিলেন। ভাবটা এমন, আওয়ামী লীগের পক্ষে না থাকলেই সে 'রাজাকার' আর পক্ষে থাকলেই 'দেশপ্রেমিক'। অথচ আমরা জানতে পেরেছি, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর '৭১ সালে দখলদার বাহিনীর অধীনে চাকরি করেছেন ময়মনসিংহ ও নোয়াখালীতে। হয়তো বাধ্য হয়েই করেছেন।
পালানোর সুযোগ পাননি। অথবা সাহসে কুলায়নি। ভীরুতা অবশ্যই গৌরবের নয়। তবে ভীরুতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা ঠিক হবে না। তাই ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে আমি কাদের সিদ্দিকীর মতো অভিযুক্ত করছি না।
তবে তার কিছুটা লজ্জাবোধ ও কুণ্ঠাবোধ থাকা উচিত ছিল। সেটা তার নেই। বরং চোরের মার বড় গলা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা ও আচরণে ফ্যাসিবাদী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে একাধিকবার। পাঠককে কিছু দিন আগের একটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই।
এক হরতালের দিন এক নিরীহ দোকান কর্মচারী বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা বা মাস্তান। এ ধরনের সন্ত্রাস ফ্যাসিবাদের আরেকটি লক্ষণ। তখন যে ডিউটিরত পুলিশ অফিসার নির্বিকার থেকে চমৎকার (!) পুলিশি ডিউটি পালন করছিলেন, সেই পুলিশ অফিসারই আবার বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে রাজপথে বেআইনিভাবে পিটিয়েছিল। পরে সেই পুলিশ অফিসারকেই যখন রাষ্ট্রপতির পদক দেওয়া হলো, তখন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। সমালোচনার জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বললেন, 'পদক দেওয়ার সময় ফারুককে পিটানোর ঘটনাটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল।
' কী ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা। এ রকম ঔদ্ধত্য আসলে মূর্খতার শামিল। পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মহীউদ্দীন খান আলমগীর যে এমন ভাষা ব্যবহার করবেন, তা ভাবা যায় না। বস্তুত, শাসক দল রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার করতে জানে না। উগ্রতা, মাস্তানি, সন্ত্রাসী চরিত্র তাদের ভাষার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।
সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও তারা অনেক অধঃপতিত। ফ্যাসিস্ট নেতা গোয়েবলস নাকি সংস্কৃতি শব্দটি পর্যন্ত সহ্য করতে পারতেন না। সংস্কৃতি শব্দটি শোনামাত্র তার হাত হিসপিস করত হাতের কাছে থাকা পিস্তলের ট্রিগার টানার জন্য।
বস্তুত, বুর্জোয়া দলগুলো এখন সব দিক দিয়েই অধঃপতিত। নীতি-নৈতিকতা বলে কিছুই নেই।
গণতন্ত্রের ধার ধারে না। না দেশের ক্ষেত্রে, না নিজের দলের মধ্যে। তাদের ছাত্রসংগঠন হচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন মাস্তান বাহিনী। অবশ্য সরকারি ছত্রছায়াতেই তারা মাস্তানি, সন্ত্রাসী ও খুনখারাবি করতে পারে। প্রশাসনিক আশীর্বাদ একবার সরে গেলে তারা কাপুরুষে পরিণত হয়।
এহেন দলের সাংস্কৃতিক মান তো নিচু হবেই। তাদের রুচিবোধও তেমনই হবে। ভাষাও সেই রূপ।
ভাষা প্রয়োগে বিএনপিও কম যায় না। তাদের মহিলা সংসদ সদস্যদের কথা তো আগেই বলেছি।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে স্বয়ং খালেদা জিয়া যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেত্রীর মুখে মানায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে তার পূর্ববর্তী অবস্থানে দৃঢ় থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন গত ১৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেছিলেন, 'একচুলও নড়ব না। ' যেখানে দেশবাসী সমঝোতা ও আলোচনার কথা বলছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতে পারিনি। কিন্তু এ ধরনের ভাষা প্রয়োগকে আমি আপত্তিকর মনে করি না।
'একচুলও নড়ব না'_ বাক্যাংশটি বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত। কিন্তু চুল শব্দটিকে নিয়ে তারপর যে ধরনের বাক্যবিনিময় হয়েছে দুই দলের মধ্যে তা কারোর কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলেও আসলে সেটাও উন্নত রুচির পরিচয় বহন করে না। বাংলা সাহিত্যে শিবরাম চক্রবর্তীর খ্যাতি ছিল যে, তিনি শব্দ নিয়ে খেলা করতে পারদর্শী ছিলেন। যাকে ইংরেজিতে বলে 'চঁহ'। হয়তো আমাদের দুই বড় দলের নেতারা এই খেলায় বেশ দক্ষতা অর্জন করেছেন।
হাসিনার কথার জবাবে বেগম খালেদা জিয়া বললেন, 'তিনি এমন আন্দোলন করবেন যে, 'সব চুল উড়ে যাবে'। নাম উল্লেখ না করলেও বোঝা যাচ্ছে ইঙ্গিতটি শেখ হাসিনার প্রতি। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার পক্ষে এরকম চঁহ করার ব্যাপারটি ভালো দেখায় না। আবার তার প্রতিউত্তরে শেখ হাসিনা যা বললেন, সেটাও রুচির পরিচয় বহন করে না। তিনি বললেন, 'যিনি পরচুলা পরেন, যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত নকল, উড়ে যাওয়ার ভয় তারই বেশি।
'
চুল নিয়ে চুলাচুলি, বাদানুবাদ এবং ব্যঙ্গাত্দক চর্চা খবরের কাগজে ও আড্ডায় বেশ জমে উঠেছে। আড্ডাপ্রিয় বাঙালির আড্ডায় আবার প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে রাজনীতি। একটি দৈনিক পত্রিকায় রম্যরচনার আদলে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। তিনি নিজেও উঁচুমাপের কবি। বাংলা কবিতা সম্পর্কেও তার জ্ঞান যথেষ্ট।
তিনি বাংলা কবিতায় কোথায় কীভাবে চুলের ব্যবহার হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ সবারই উদ্ধৃতি আছে। পড়ে মজা পেলাম। কিন্তু চুল নিয়ে বিবাদ ও চুলাচুলি যা হচ্ছে তা তো সাহিত্য জগতে নয়। তা হচ্ছে রাজনীতির ক্ষেত্রে।
এই চুলাচুলির রাজনীতি, এই ফ্যাসিসুলভ আচরণ ও ভাষা প্রয়োগ রাজনীতিকে গভীরতর সংকটে নিক্ষিপ্ত করবে। তার পরিণতিতে যেটুকু গণতন্ত্র আছে, সেটাও নির্বাসিত হয়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কা কী একেবারেই অমূলক? একটু দূরদৃষ্টি রেখে আমরা কি আচরণে সংযত এবং ভাষা প্রয়োগে ভদ্র হতে পারি না?
লেখক : রাজনীতিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।